মুক্তিযুদ্ধ

কামালপুর অপারেশন

জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী বিওপি। এটি ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর, ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জের খুব কাছে। ওখানে পাকিস্তানিদের বাঙ্কার ছিল সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে হিটলার বাহিনীর বাঙ্কারের মতো। প্রচুর বুবিট্র্যাপ বিছানো থাকত। ফলে এগোনো খুব কঠিন ছিল। আগেও কামালপুরে বেশ কয়েকটা অপারেশন হয়েছে।

এবারের অপারেশনটা ভিন্নরকমের। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের মারাঠা রেজিমেন্ট, গুরখা রেজিমেন্ট আর গার্ড রেজিমেন্ট। সব কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। সিদ্ধান্ত হয়, অপারেশনটির নেতৃত্ব দেবেন সেক্টর কমান্ডার মেজর (পরে কর্নেল) আবু তাহের।

পরিকল্পনাটা কী? আমাদের লেভেলে জানানো হয়নি। তবে বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের অপারেশন হবে। কারণ প্রচুর ইন্ডিয়ান আর্মি আসে, সঙ্গে সিক্সটিন পাউন্ডার ক্যাননের মতো অস্ত্রও। হেভি ও মিডিয়াম আর্টিলারিগুলো সাজানো হয় একের পর এক।

১৩ নভেম্বর ১৯৭১। দুপুরে মেজর তাহের কমান্ডারদের নিয়ে বসলেন। বলা হলো, রাত ১২টার পরেই অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর কামালপুর অ্যাটাক করা হবে। ওইদিন ছিল মেজর তাহেরের জন্মদিন। বলা হলো, মেজর তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’। যে কেউ যোগাযোগ করবে ‘কর্তা’ বলে।

রাত ১১টায় রওনা হলাম। কামালপুরের আগেই বানরোড। তারও পেছনে ছিল মেজর তাহেরের কমান্ড পোস্ট। আমরা ওখানেই পজিশন নিই। পাশেই ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, গুরখা রেজিমেন্টের কর্নেল বারাখ, মারাঠা রেজিমেন্টের কর্নেল বুলবুল, গার্ডস রেজিমেন্টের বারাট।

আর্টিলারি ফায়ারের পর শুরু হবে অপারেশন। রাত তখন ১২টা। মুহুর্মুহু শেল ড্রপিং হচ্ছে কামালপুর বিওপির ওপর। প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর্টিলারি ছোড়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারাও ফায়ার করছে। ট্রেসার ফায়ারও যাচ্ছে। চরম এক উত্তেজনা।

নির্দেশ ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করবে ‘জয় বাংলা’ বলে। কিছুক্ষণ পর চারপাশ থেকে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার। মেজর তাহেরের কাছে একটা ওয়াকিটকি। সেখানে লেফটেন্যান্ট মিজান জানাল‘কর্তা, আমরা পাকিস্তানিদের প্রথম লাইনের বাঙ্কার দখল করে নিয়েছি।’ তখন আনন্দে জয় বাংলা স্লোগান তুলি।

রাত তখন ৩টার মতো, মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। ওয়াকিটকিতে মেজর তাহের বারবার বলছিলেন ‘মিজান, তুমি কোথায়? ওপাশে কোনো সাড়া নেই। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাহেরের ফিলিংস সবসময় অন্যরকম ছিল। ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ উনি কমান্ড পোস্ট থেকে উঠে গেলেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারকে বললেন ‘আমি ফ্রন্টে যাব।’ ক্লেয়ার বলেন ‘হোয়াট!’ তাহের বলেন ‘আই হ্যাভ টু সি মাই বয়।’

বলেই আমাদের নিয়ে উনি সামনে রওনা হন। বানরোডের কাছে গিয়ে বর্ডার ক্রস করি। এরপরই একটা আমবাগান। শেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারগুলো ভেঙে গেছে। ওরা বেরিয়ে আখক্ষেতে লুকাচ্ছে। দূর থেকে তা দেখছি আমরা।

তাহের ভাই বানরোডের ঢালে এসে বসলেন দুই পা ভাঁজ করে। এক পাশে আমি, আরেক পাশে বাহার; পেছনে তিন-চারজন পজিশনে। তিনি গলফ স্টিক দিয়ে পাকিস্তানিদের দেখালেই ওদিকে ফায়ার করি আমরা। হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। খেয়াল করলাম, মেজর তাহের আমার ওপর পড়ে যাচ্ছেন। দেখলাম, তার বাঁ পা-টা প্রায় বিচ্ছিন্ন, দু-তিনটা ভেইনের সঙ্গে ঝুলে আছে কোনোরকমে।

তখন মনে হয়েছিল শেলের আঘাত। পরে অনেক হিসাব করে দেখলাম, শেল ড্রপিং হলে উনি বেঁচে থাকতেন না। উনার শরীরের অন্যান্য জায়গাও ইনজুরড্ হতো। ওটা আসলে অ্যান্টিপারসন মাইন ছিল, যা তার পায়ের চাপে বিস্ফোরিত হয়।

উনাকে ধরতে গেলে উনি বলেন ‘আমার কিছু হয়নি। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও।’ রক্তক্ষরণে মেজর তাহের নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। আমি তখন ভুল করে ওয়াকিটকিতে বলে ফেললাম ‘কর্তা’ ইজ ডেড।

পাকিস্তানি সেনারা তখন এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। আমরাও তাদের ফায়ার করি। মুক্তিযোদ্ধারা একটা কুঁড়েঘরের দরজা ভেঙে নিয়ে আসে। ওটায় শুইয়ে প্রথমে টেনে নেওয়া হয় মেজর তাহেরকে। বেশ দূরে একটা আরআর গান আনা হয়েছিল জিপে করে। দৌড়ে গিয়ে আমি ওই জিপটা এনে তাকে তুলে নিই। মনোবল তখনো তার ভাঙেনি। এর মধ্যেই আনোয়ার ভাই চলে আসেন। তাকে দেখেই মেজর তাহের বললেন ‘দেখ, আমার মাথায় ওরা হিট করতে পারে নাই। তোমরা কামালপুর মুক্ত করবে। আমি ফিরে এসে যেন দেখি কামালপুর মুক্ত হয়েছে।’ চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে তাকে প্রথমে তুরা এবং পরে গৌহাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

কামালপুর অপারেশনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক)। তিনি ভারতের তুরা থেকে দুই মাসের বেসিক ট্রেনিং শেষে এক্সপ্লোসিভের ওপর বিশেষ ট্রেনিংও সমাপ্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন প্রথমে হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁও বিওপি এলাকায়। এরপর সেক্টর গঠিত হলে চলে যান ১১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানেই বড় ভাই কর্নেল তাহেরের অধীনে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।

মেজর তাহের যেদিন আহত হন ওইদিনই জামালপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুজ্জামান হেলাল বীরপ্রতীক (এখন প্রয়াত) স্পিøন্টারে বিদ্ধ হয়েছিলেন। কামালপুরে কী ঘটেছিল ওইদিন? ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বলেন

ফার্স্ট কমিশনের বেশ কজন অফিসার তখন জয়েন করেছেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজান আর বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক হাবিলদারকে দেওয়া হয় আমার সঙ্গে। কামালপুর অ্যাটাকের জন্য একটা কনফারেন্স হয় কমান্ডারদের নিয়ে। মেজর তাহের ব্রিফ করেন। সমরে পাকিস্তানিদের অংশে ফার্স্ট লাইন, সেকেন্ড লাইন ও সেন্টার এ তিনটি ভাগ ছিল। রাতে পাকিস্তানি সেনারা সেন্টারে গিয়ে থাকছে। তাই সোলজার আজ কম। এটা ছিল কর্নেল তাহেরের ইনফরমেশন।

তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন তুই অ্যাটাক করে ফার্স্ট লাইন ও সেকেন্ড লাইন দখল করে ফেলবি। ওদের বাঙ্কারেও ঢুকে যাবি, দখল নিয়ে থাকবি। সকালে আমি যাব। ওয়াকিটকি ভোর ৬টার আগে খোলা যাবে না। কোনো ফায়ারও ওপেন হবে না।

আমরা তা-ই করি। ফার্স্ট লাইনের পাঁচটা বাঙ্কার ফাঁকা পেয়ে পজিশনে চলে যাই। রাত তখন ১টা। মানে ১৪ নভেম্বর ১৯৭১। সেকেন্ড লাইন সার্চ করি। সেগুলোও খালি। দুটি বাঙ্কারে পজিশন নিই। লে. মিজান বললেন ‘দখল তো হয়েই গেছে। এবার চলেন। সকালে এসে সেক্টর কমান্ডারকে নিয়ে ঢুকে পড়মু।’ আমি বলি, ‘স্যার তো বলেছেন দখল করে বসে থাকতে।’ তিনি বললেন ‘দখল তো হয়েই গেছে। আমরা বরং বানরোডে অপেক্ষা করি।’ হাবিলদারও আমাকে কনভিন্স করে বলেন ‘উনিও তো অফিসার। তার কমান্ডও শোনা দরকার।’ আমরা তখন বাঙ্কারগুলো ছেড়ে চলে আসি বানরোডে।

ভোরে মেজর তাহের ওয়াকিটকিতে কথা বলেন। তুই কোথায়? ‘বানরোডে’। সঙ্গে সঙ্গে রেগে যান। বানরোডে কেন? বাঙ্কার খালি ছিল না? আমি পুরো ঘটনা খুলে বলি। বলেন সর্বনাশটা করছিস তুই। দেখ তো পাখিটা আছে কি না। পাকিস্তানি সেনাদের একজন একটা বড় গাছের ওপর বসে নির্দেশ দিত। ওরা তখন নির্দেশ অনুসারে টু-ইঞ্চ মর্টার মারত। ওটাকে ওপি বা পাখি বলতাম আমরা। দেখলাম ওপি আছে। তাহের সাহেব বললেন, ওটা আগে ফেল। গুলি করে মেরে ফেললাম।

বানরোডের ওপরে রাইফেল তুলে দেখতে বললেন, কী হয়। সেটা করতে যেতেই সমানে গুলি আসতে থাকে। বুঝে যাই ওরা বাঙ্কারগুলোতে এসে পজিশন নিয়ে বসে আছে। উনি বললেন সব লস করলি। পুরো প্ল্যানটাই মাটি হয়ে যায়। এরপরই মেজর তাহের আসেন এবং আহত হন। তখনো ফুল সেন্স ছিল তার। পা উড়ে গেছে। তবু যাওয়ার সময় বলছেন ‘খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসতেছি। এ পথে তোদের নিয়েই ঢাকা যাব। সবার আগেই যাব আমরা।’ এতটা কনফিডেন্ট ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। ওইদিনই আমরা কামালপুর দখল করে ফেলতে পারতাম।

তখনো আমি রণাঙ্গনে। মেজর তাহের আহত হয়েছেন। ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রাণপণে লড়ছি। খানিক পরেই শেলের স্পিøন্টার এসে লাগে আমার ডান পায়ের ঊরু ও হাঁটুর নিচে। পিনপিন করে রক্ত বেরোতে থাকে। জখমটা খুব মারাত্মক ছিল না। ফলে চিকিৎসা নিয়ে আবার রণাঙ্গনে ফিরি। কর্নেল তাহেরের স্বপ্নটা পূরণ হয়েছিল। ইন্ডিয়ান সেনাদের সহযোগিতায় ৪ ডিসেম্বর কামালপুরে পাকিস্তানি সেনারা সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়।

একাত্তরে কামালপুরে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি এক মেজরসহ দুই কোম্পানি সেনা নিহত হয়। আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় বেলুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিকসহ বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবি ১৬২ জন সেনা। ধানুয়া কামালপুর শত্রুমুক্ত হলেও সেখানে শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীরউত্তম), গাজী আহাদুজ্জামান, তসলিম উদ্দিনসহ ১৯৭ জন বীর মুক্তিযাদ্ধা। আহত হন অনেকেই। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২৯ জনকে বীরত্বের জন্য বিভিন্ন খেতাব (বীরবিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক) প্রদান করা হয়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৮ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button