কলাম

লকডাউনের বিকল্প হোক মাস্ক

দেশে করোনা পরিস্থিতি কি ভয়াবহ অবস্থার দিকে এগোচ্ছে? পরিচিতজনদের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে একের পর এক। সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলার নাম উঠে এসেছে গণমাধ্যমের খবরে। কিন্তু সেই দুটো জেলাতে নেই মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই। রাজধানীতে চলছে বাণিজ্যমেলাসহ নানা অনুষ্ঠান। রাঙ্গামাটিতেও রয়েছে পর্যটকদের ভিড়। গণপরিবহনগুলোও মানছে না স্বাস্থ্যবিধিসহ সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশনা। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আর সেটি যদি সত্যিকারভাবেই ঘটে তাহলে এর দায় কার ওপর বর্তাবে? সরকারের নাকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিষয়ে মানুষের উদাসীনতায়! সরকার এরই মধ্যে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু সেটিও কার্যকর হয়নি পুরোপুরি।

যখন লিখছি ওইদিনে ৮ হাজার ৪০৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬ হাজার ৫৯৭ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৭৮ শতাংশের বেশি। কেবল রাজবাড়ী ছাড়া দেশের বাকি ৬৩ জেলাতেই গত এক দিনে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশে। সে হিসাবে গত এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো জিম্বাবুয়েফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের শরীরে কভিড-১৯ এর ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে ২২ ডিসেম্বর থেকে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের হার ছিল গড়ে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারির প্রথম ৭ দিনেই শনাক্তের হার বেড়ে ৬ শতাংশে পৌঁছায়। ৫ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ১২ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত শনাক্তের হার বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডেলটা ও ওমিক্রন দুটো ভ্যারিয়েন্টই সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।

সরকার করোনার প্রতিষেধক হিসেবে টিকাপ্রদান কার্যক্রম গতিশীল করছে। সেটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো বা মাস্ক পরা বিষয়ে আগের মতোই কঠোর থাকাও উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। এ যেন টেনে ধরা ইলাস্টিকের মতো। ছেড়ে দিলে আবার আগের অবস্থায় চলে আসে। সরকারিভাবে কঠোরতা না থাকায় মাস্ক পরাতে মানুষের সচেতনাবোধও শূন্যের কোঠায় চলে আসছে।

আবার রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের ১১ দফা নির্দেশনা উপেক্ষা করে নানা কর্মসূচি এখনো পালন করছে। চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণা ও নির্বাচনও। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ কর্তাব্যক্তিরা যখন নানা বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলছেন তখন তারাও মুখে মাস্ক রাখছেন না। তাদের আশপাশে ঘিরে থাকা অনেকের মুখেও থাকে না মাস্ক। এতে মন্ত্রী ও এমপিদের যেমন করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে পাশাপাশি মাস্ক পরা বিষয়েও সমাজে নেতিবাচক  মেসেজ যাচ্ছে। তাই মন্ত্রী, এমপিসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিকা নিলেও মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন। আবার শীতে বাংলাদেশের তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন এ সময় মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। যেহেতু মানুষ শীতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখে সে সুযোগে বদ্ধ ঘরে করোনাভাইরাস বাড়ার সুযোগ ঘটে। কেননা ঘরে আলো-বাতাস ঠিকমতো চললে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও কম থাকে। এছাড়া ভাইরাস থেকে বাঁচতে নিয়মিত হাত ধোয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। শীতের সময় ঠান্ডার কারণে মানুষের এ প্রবণতা কম থাকে। পাশাপাশি এখন যেভাবে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি উদাসীন হয়ে উঠছে তাতে মানুষের ক্লোজ কনট্যাক্টও বাড়বে। ফলে পুরো শীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি ব্যাপক পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেসমাস্ক পরলে শরীরের ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাস্ক পরলে তা যে শুধু অন্যদেরই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তা শুধু নয়, যিনি মাস্ক পরছেন তিনিও সুরক্ষিত থাকেন। তাই ভাইরাসের বর্তমান সংক্রমণ ঠেকাতেও মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু মাস্ক পরা নিয়ে সরকারের নানা নির্দেশনা থাকলেও বর্তমানে হাটবাজার, গণপরিবহন, জনসমাগমস্থলে মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতা কমে এসেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনে যে আতঙ্ক ও ভয় ছিল ক্রমেই তা কেটে যাওয়ায় মাস্ক পরাতে উদাসীন হচ্ছে অনেকেই। সরকার ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও এখন এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হচ্ছে আগের চেয়ে ধীর গতিতে। ফলে এ নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধও কমেছে প্রবলভাবে। প্রত্যেক পরিবারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা বর্তমানে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও টিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মানুষের ভেতর সচেতনতাবোধ শতভাগ তৈরি না হলে জনসমাগমস্থল থেকে সংক্রমণ বাড়বেই। যা ক্রমাগতভাবেই ঘটছে।

করোনা সংক্রমণে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমলেই আমাদের ভেতর এক ধরনের আত্মতুষ্টি ও উদাসীনতা দেখা দেয়। ফলে আমরা করোনার পরবর্তী ঢেউ মোকাবিলার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবি না।

কীভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে? এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলাকাবাসী যদি এ বিষয়ে সতর্ক ও সংগঠিত না হয় তাহলে শুধু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে খুব বেশি কিছু হবে না। জনগণ, সরকার এবং প্রশাসনকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যেখানে জনগণের কাজ হবে, শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা, সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা এবং করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া। প্রশাসনের কাজ হবে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে না, তাদের মানতে বাধ্য করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া। সরকার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার সময়েই পাড়া বা মহল্লার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছে। এখনো ওই কমিটিগুলো আবার সচল করা গেলেই মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। এই কাজটি শুরু করতে হবে অবিলম্বে।

নিজের সুরক্ষা নিজের হাতে। আবার একজন অরক্ষিত থাকলে বাকিরাও তার মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই মানুষকে সম্মিলিতভাবে আবারও সচেতন করতে হবে। লকডাউন অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এটি যেমন সত্য, তেমনি মাস্ক না পরলে করোনা সংক্রমণও বাড়বে। তাই সবাইকে জানাতে হবে লকডাউনের বিকল্প হলো মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২০ জানুয়ারি ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button