কলামকীর্তিমান বাঙালি

নিষ্ফলা মাঠের সফল কৃষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় কিংবা যদি বলা হয় ‘আলোকিত মানুষ চাই’, তখন অবলীলায় মনের ভেতর যার মুখচ্ছবি বা নামটি ভেসে ওঠে তিনিই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, আমাদের স্বপ্নের বাতিঘর। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন মানুষকে জীবনের সফলতার পথ বাতলে দেয়। স্বপ্নই পারে মানুষকে সার্থক ও সমুন্নত করতে। এমন হাজারো বাক্যের মাধ্যমে তিনি লাখো তরুণ মনকে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করেছেন, এখনো করছেন। স্বপ্নের পথে চলতে ও স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিতে যে অসীম সাহস তিনি নিজের জীবনে দেখিয়েছেন, তা শত বছর পরও মানুষের প্রেরণা জোগাবে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। ষাটের দশকের প্রতিশ্রুতিময় কবি। সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে বেগবান করে রেখেছিলেন প্রায় এক দশক ধরে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকেই রুচিমান ও বিনোদনসক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় পথিকৃৎ ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব তিনি।

২৫ জুলাই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পূর্ণ করলেন ৮২ বছর। দীর্ঘ এই জীবনে জনপ্রিয়তার মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কেন? তিনি বলেন, ‘আমার কোনো দিন জনপ্রিয়তার মোহ ছিল না। কিন্তু মানুষ একটু জানুক, একটু দেখুক! মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই—এই জনপ্রিয়তা তো সবাই আশা করে। মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই—কথাটার মধ্যে একটা মৃত্যু আক্রান্ত মানুষের আকুতি, কান্নার শব্দ শোনা যায়। এই পৃথিবীতে সবই থাকবে, অথচ আমি থাকব না। কিন্তু একটা মাত্র উপায় আছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার, যদি হৃদয় মাঝে স্থান করে নেওয়া যায়। সুতরাং মানুষের হৃদয়ের মাঝে আমি বাঁচতে চাই। এটা জনপ্রিয়তা নয়, অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা। জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী। অমরত্ব দীর্ঘস্থায়ী। জনপ্রিয়তা একটা বাজারের বিষয়। অধিকাংশ সময় এটা ব্যবসার বিষয়ও।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর কাজের মাধ্যমে সত্যিকারভাবেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবে তাঁকে এ পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে। তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে, খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরে ঢাকা কলেজেই জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেছেন।
নানা বাস্তবতার মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট থাকেন। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল, জীবনীমূলক গ্রন্থ ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। প্রকাশিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। যেখানে তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন, শিক্ষার পরিবেশ, শৈশবের মজার ঘটনা এবং সর্বোপরি তাঁর শিক্ষকদের নিয়ে লিখেছেন, যা শিক্ষকদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি’, ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’, ‘আমার বোকা শৈশব’, ‘ওড়াউড়ির দিনগুলি’, ‘আমার উপস্থাপক জীবন’, ‘রসস্ট্রাম থেকে’, ‘স্বপ্নের সমান বড়’, ‘বিস্রস্ত জার্নাল’, ‘নদী ও চাষীর গল্প’ প্রভৃতি। র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জাতীয় পরিবেশ পদকসহ দেশ-বিদেশি বহু সম্মাননা পেয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধ, বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ আন্দোলনসহ নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনে উদ্যোগী ভূমিকার জন্য দেশব্যাপী অভিনন্দিতও হয়েছেন তিনি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন সুবক্তা। মনের কথাগুলো সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে জুড়ি নেই। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রায় সব দিক সমন্বিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক সত্তায়। বই পড়ানোর মধ্য দিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। নানা প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে একটি বইবিমুখ জাতিকে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বলে আসছেন জীবনের বেশির ভাগ সময় ধরেই। বলেই শুধু ক্ষান্ত হননি; সবার বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও হাতে নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি, যা চলছে সারা দেশে। তাঁর পরিকল্পনায় এ পর্যন্ত বইপড়াসহ নানামুখী কার্যক্রম নিয়ে প্রায় কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

মানুষকে জাগিয়ে তোলার এক জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমাদের নিষ্ফলা মাঠের সফল কৃষক তিনি। তাঁর আলো ছড়ানো স্বপ্নগুলো সঞ্চারিত হোক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকণ্ঠের শিলালিপিতে, প্রকাশকাল: ৩০ জুলাই ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button