মুক্তিযুদ্ধ

কাকরাইল পেট্রলপাম্প ওড়াল গেরিলারা

মেলাঘর থেকে ৫২ জনের গেরিলা দল নিয়ে আমরা আসি রোহা গ্রামে। ধামরাই-মানিকগঞ্জ বর্ডারে গ্রামটা। কমান্ডার ছিলেন রেজাউল করিম মানিক (পরে তিনি শহীদ হন)। সহ-কমান্ডার ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তখন রোহা গ্রামের আশপাশে রাজাকারদের আধিপত্য ছিল। প্রথমেই তাদের নিউট্রালাইজড (নিষ্ক্রিয়) করার কাজে নামি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অ্যাটাক করেছি। সন্ধ্যায় ভাত খেয়েই অপারেশনে বের হয়ে যেতাম। ফলে পুরো এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু আমাদের অপারেশন করতে হবে মূলত ঢাকায়; যাতে বিশ্বগণমাধ্যমে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মানিক ভাই মগবাজার, তেজগাঁও, সিদ্ধেশ্বরী, মোহাম্মদপুরে পরিচিতদের বাসায় অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা করেন। তেজগাঁওয়ে অস্ত্র থাকত সাহার বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে রাজাকাররা সে কথা জেনে যায়। সাহা ও তার ভাইদের গুলি করে হত্যা করে তারা।

রোহা গ্রাম থেকে নৌকায় সাভারে; সেখান থেকে বাসে ঢাকায় ঢুকতাম। পরিচিতদের বাসায় আত্মগোপন করে থাকতে হতো। ট্রেনিংয়ে বলা ছিল, তোমরা এক জায়গা থেকে গিয়ে অপারেশন করে উঠবা আরেক জায়গায়। অন্যরা জানবে না তুমি কোথা থেকে আসছ এবং কোথায় যাবে। তবে সবাই জানবে কোন জায়গায় তোমরা মিট করবে। কেউ মিট না করলে বুঝতে হবে সে নিউট্রালাইজড হয়েছে বা ধরা পড়েছে। পাকিস্তানি সেনারা তাকে মেরে ফেললেও যেন অন্য গেরিলাদের ঠিকানা না পায়, এ কারণেই ছিল এই কৌশল। অপারেশনের সময় অস্ত্র কোথা থেকে তুলব, কোথায় ড্রপ করব, এটা শুধু জানতে চাইতাম। গেরিলা হিসেবে এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হতো আমাদের।

একাত্তরে ঢাকার গেরিলাদের নানা কৌশল ও বীরত্বের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান।

আবু নাঈম মো. মুছাদ্দিকুর রহমান ও মাহবুবা রহমানের বড় সন্তান তৌফিকুর রহমান। বাবা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সচিব। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়, কাঁঠালবাগানে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা শাহীন স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চলে যান ভারতে। ১২ নম্বর প্লাটুনে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন মেলাঘরে। ২ নম্বর সেক্টরের অধীন গেরিলা অপারেশন করেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। তার নেতৃত্বেই কাকরাইল পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়া হয়।

কীভাবে হয়েছিল সেই অপারেশন?

তৌফিকুর রহমান বলেন, একদিন মানিক ভাইকে বললাম আমদের যেহেতু এক্সপ্লোভিস ট্রেনিং আছে; সঙ্গে আছে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ও ফসফরাস গ্রেনেড। তাই ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মি বা পুলিশ থাকে এমন জায়গার আশপাশে বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই। তিনি বলেন, কেমনে করবা? বললাম, দুটো দিন সময় দিলে পুরো প্ল্যানটা করা যাবে। তিনি সময় দিলেন।

আলতাফ হোসেন টুনিকে নিয়ে রেকি করতে বের হই। কাকরাইল পেট্রলপাম্পটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের খুুব কাছে। সেটাই বেছে নিই। পাম্পের উল্টোদিকে ছোট একটা টং দোকান ছিল। সেখানে চা খেতে খেতে কোথায় এক্সক্লোসিভ লাগাব, ওয়েট (চাপা দেওয়ার মতো ভারী জিনিস) দেওয়ার মতো কী আছে, কয়জন ডিউটি করে সব দেখে আসি। ক্যাম্পে এসে মানিক ভাই ও বাচ্চু ভাইকে নিয়ে পুরো প্ল্যানটা করি। চারজন লাগবে। আমি আর টুনি যাব। সঙ্গে থাকবে আরও দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে পুলিশ আসতে এক মিনিটও লাগবে না। পালাব কীভাবে?

খন্দকার মাহাবুব উদ্দিনের ছেলে নেহাল ছিল বন্ধু। তার কাছে গাড়ি চাইলাম। সে বলল, রোজার মাস। আব্বা তো গাড়ি বের করতে দেয় না। শুধু ইফতারের সময় বের হই। তখনই মাথায় ক্লিক করে ‘দ্যাট ইজ দ্য বেস্ট টাইম।’ তাকে রাজি করালাম। ক্যাম্পে ফিরে মানিক ভাইকে বললাম, একটা স্টেনগান লাগবে দুটো ম্যাগাজিন ফুল লোডেড। তারা বললেন, মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে গেলে ফেরদৌস নামের একজন তোমাদের আর্মস দেবে। অপারেশন শেষে সেটা রাজারবাগের শেল্টারে রেখে যাবে।

১ নভেম্বর ১৯৭১। মানিক ভাই দুটো ছেলে দিলেন। ওরা বাজারের ব্যাগে করে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আসে। আমি আর টুনি রিকশায় মহাখালী ওয়্যারলেস থেকে একটা কম্বলে মোড়ানো স্টেনগান নিয়ে গন্তব্যে যাই। নেহালও গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে; স্টার্ট দেওয়া অবস্থায় গাড়ির তিনটি দরজাও খোলা রাখে। ইফতারের ঠিক আগে চোখের ইশারায় চারজন মুভ করলাম। আমি আর টুনি স্টেনগান নিয়ে পাম্পের বাইরে যে দুজন কাজ করছিল তদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পর্দা টেনে দিয়ে সবাইকে বললাম, চুপ করে বসেন। আপনাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। একটা বোমা লাগানো হচ্ছে এখানে। এরপর আপনারা দৌড়ে সরে যাবেন।

দুজন গেরিলা আমার নির্দেশ মোতাবেক বাইরে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে থাকে। বালিভর্তি দুটি বালতি এক্সপ্লোসিভের ওপর চাপা দেয়। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের সঙ্গে ডেটোনেটর সেট করে দুই মিনিটের ফিউজ লাগায়। ফিউজে আগুন দিয়েই ওরা ডাক দেয় আমাদের। তখন পাম্পের লোকদের বলি, তোমরা শুধু দৌড়াতে থাকবে। নইলে মারা পড়বে। এটা বিশাল বোমা। আমরাও দ্রুত গাড়িতে উঠে সরে পড়লাম।

একদম টাইমমতো সব হয়েছিল। রাজারবাগ এলাকায় ওমর নামে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটি ছিল শেল্টার। সেখানে আমাদের নামিয়ে দিয়ে নেহাল মাত্র গাড়িটি স্টার্ট দিয়েছে; তখন বিশাল বিস্ফোরণ। গোটা পেট্রলপাম্প ওই বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল। পুরো ঢাকা কেঁপে ওঠে। আমরা আনন্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। আমি টুনির, টুনিও আমার হাত চেপে ধরে। মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে বলি ‘জয় বাংলা’। এরপর শেল্টারে অস্ত্র রেখে রিকশায় যে যার মতো সরে পড়ি।

ঢাকায় পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দিয়েছে গেরিলারা এ সংবাদ প্রচার করে বিবিসি। পরদিন ইত্তেফাকসহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে শিরোনাম হয় ‘ঢাকার কাকরাইলে বোমা বিস্ফোরণ’। ইত্তেফাকের ওই সংখ্যাটা এখনো সংগ্রহে আছে। ঢাকা যে শান্ত না, ঢাকায় গেরিলা ঢুকে পড়েছে ওই অপারেশনের পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সব দিক থেকেই অপারেশনটা সাকসেসফুল ছিল। মনে হলে এখনো শিহরিত হই।

স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সহ্য করতে পারেন না এই গেরিলা যোদ্ধা। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাসী হিসেবে তৈরি করতে হলে নিজেদের আগে অনেস্ট হতে হবে। দেখাতে হবে, আমরাও ভালো কাজ করছি। না হলে প্রজন্মও তৈরি হবে না, মনে করেন এই সূর্যসন্তান। বর্তমান প্রজন্মের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা খুব কষ্ট করেছি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। তোমরা আমাদের একাত্তরের ত্যাগের ইতিহাসটুকু জেনে নিয়ো। মনে রেখো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button