মুক্তিযুদ্ধ

ফিরব স্বপ্নেও ভাবিনি

 রাজনৈতিক দল না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না এখন রাজনীতিবিদদের মধ্যে লোভ অনেক বেড়েছে, আর সুবিধাবাদী একটি গ্রুপ আছে যারা সবসময় লেবাস পরিবর্তন করে

 “একাত্তরের মে মাসের শেষে পরিকল্পনা হয় টাঙ্গাইল শহরে গেরিলা অপারেশন করার। একদিন বলা হলো টাঙ্গাইল শহরে রাজাকার ও পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে হবে। দায়িত্ব নেবে কে? সবার আগে হাত তুলি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু নজরুল ইসলাম বাকু। বাকু পরে এক অপারেশনে শহিদ হন।

গ্রেনেড ট্রেনিং তখনও ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে আবদুল গফুর বীরপ্রতীক গ্রেনেড চার্জ করাটা দেখিয়ে দেন। পাঁচ মিনিটেই তা রপ্ত করে ফেলি। আমাকে আর বাকুকে আটটা করে গ্রেনেড দেওয়া হলো। একটা পিস্তল এবং বাইনোকুলারও ছিল আমার কাছে।

একদিন খুব ভোরে টাঙ্গাইল শহরে যাই। আবদুল রশিদ লেবু নামে এক চেয়ারম্যান ছিল বন্ধু। তার বাড়িটা পাচকাহুইনায়। ওর বাড়িতে গিয়ে উঠি। পাশেই ছিল আরেক বন্ধু আলমগীর। তাকে ডেকে পরিচিতদের নাম লিখে দিলাম। সে শাহজাহান, বোরহান, ওয়াজেদ, বাদশা প্রমুখ দশ-বারোজনকে ডেকে আনে। সবাইকে তখন রেকি বুঝিয়ে দিলাম। তাদের রেকির ভিত্তিতেই টাঙ্গাইল শহরে প্রায় সবগুলো অপারেশন করেছি। একাত্তরে ওদের সহযোগিতার কথাও ভুলে যাওয়ার নয়।

টাঙ্গাইলে রাজাকার খোকা কমান্ডারের বাবা ছিল মুসা তালুকদার (প্রয়াত নায়ক মান্নার দাদা)। দুর্গাপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুসা একাত্তরে দুর্গাপুর ও পটল এলাকায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে সে শহরে চলে আসে। খবর নিতে থাকি সে কোথায় উঠেছে। জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের পাশেই একটি দোতলা বাসায় মুসা থাকত। আওয়ামী লীগ অফিসের পেছনে জঙ্গলে ঠাসা। রেকি এ খবরটা নিয়ে আসে।

আমি আর বাকু রাজাকার মুসার বাড়িতে অপারেশনের পরিকল্পনা করি। এক সন্ধ্যায় নিজে গিয়ে দেখলাম দোতলায় ঘরের জানালাটা খোলা থাকে। নিচ থেকে গ্রেনেড থ্রো করতে পারলেই হয়ে যায়।

ফজরের সময় অপারেশন করে মুসল্লিদের সঙ্গে মিশে যাবো। ওইসময় পাকিস্তানি আর্মির টহলও তেমন থাকবে না। দুজন থাকব দু-দিকে। বাকু হিট করবে সদর থানার পূর্বপাশে। আমার গ্রেনেডের শব্দ পেলেই সে থানায় গ্রেনেড মারবে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। রাত নয়টা হবে। দুজন দু-দিকে চলে যাই। আওয়ামী লীগ অফিসের পেছনের ঘন জঙ্গলে সারারাত বসে থাকি। হাজার হাজার মশা আর শ্রমিকদের মলত্যাগের জায়গা ছিল ওটা। তবুও সেখানেই বসেছিলাম। ফজরের আজানের পরপরই মুসার বাড়িতে পরপর দুটি গ্রেনেড থ্রো করি। বিকট শব্দে পুরো শহরটাই কেঁপে ওঠে তখন।”

একাত্তরের একটি অপারেশন এভাবেই তুলে ধরেন বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় টাঙ্গাইলের যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা প্রসঙ্গে। কাশেম উদ্দিন সরকার (ওরফে আবদুল মজিদ) ও ছালেহা বেগমের তৃতীয় সন্তান আবুল কালাম আজাদ। বাড়ি টাঙ্গাইল সদরের পারদিঘুলিয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

আবুল কালাম আজাদের বীর বিক্রম সনদ, ছবি: সালেক খোকন

সত্তরের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের কথা তিনি তুলে ধরে বলেন, “১ মার্চ ইয়াহিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। ওইদিন বিকালেই টাঙ্গাইল শহিদ মিনারে প্রতিবাদ সভা হয়। রাতেই আমাদের নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী একটা গোপন বৈঠক করেন। সেটা হয় প্যারাডাইস পাড়ায়, লুৎফর মিয়ার বাড়িতে। আলোচনা হয় ইয়াহিয়া খান যেহেতু পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ করে দিয়েছে। তার মানে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া উপায় নেই।

প্রশ্ন করি: ‘লতিফা ভাই, এই যে সশস্ত্র আন্দোলনের কথা বলছেন। আমাদের অস্ত্র কোথায়। আমরা তো বাঁশের লাঠি দিয়ে আন্দোলন করছি।’

লতিফ সিদ্দিকী মুচকি হেসে বললেন, ‘পথে নামলে পথের দিশা পাওয়া যায়।’

সিদ্ধান্ত হয় ৩ মার্চ থেকেই বাঁশের লাঠি আর ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং হবে, কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ মাঠে। ওই রাতেই আমি, ফারুক, আহমেদ, খন্দকার আশরাফুউজ্জামান স্মৃতি, মতিয়ার রহমান খান, ফজলুল হক বীরপ্রতীক, এনএ খান আজাদ, আমীর হোসেন তুলা, মিঠু, তিনু, সোহরাওয়ার্দী সাতজন লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কোরআন শপথ করি।

শপথটি ছিল এমন, ‘আমরা আল্লাহর নামে শপথ করছি যে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের জন্য আমরণ যুদ্ধ করে যাব। নিজের স্বার্থের দিকে তাকাব না। অন্যায় যদি নিজের লোকও করে তাকে হত্যা করতেও পিছপা হবো না। আমাদেরকে দেশ স্বাধীন করতে হবে, অধিকারও ফিরে পেতে হবে।’

পরদিনই চলে যাই কাগমারী কলেজ মাঠে। বাঁশের লাঠি আর কলেজের ক্যাডেটদের ডামি রাইফেল দিয়েই শুরু হয় ট্রেনিং। প্রথমে ছিলাম ১৭ জন। ট্রেনিং করান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, জয়নাল আবেদীন, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। পনের দিন করেছি ওই ট্রেনিং।”

এর পর কী ঘটল?

“২৫ মার্চ ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। ২৬ তারিখ আদালত পাড়ায় অ্যাডভোকেট নূর ইসলাম সাহেবের বাসায় সকল নেতাদের উপস্থিতিতে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। সেটার আহ্বায়ক ও সামরিক শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। চেয়ারম্যান করা হয় বদিউজ্জামান খানকে।”

পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল অভিমুখে যাত্রা করলে ৩ এপ্রিল সীমিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়েই আজাদরা মির্জাপুরের গোড়ান সাটিয়াচড়া এবং নাটিয়াপাড়ায় প্রতিরোধ গড়েন। কিন্তু টিকতে পারেন না।

আজাদ বলেন, “শহর তখন থমথমে। মানুষের ভেতর আতঙ্ক। আমাদের সঙ্গে কার্টুনিস্ট সৈয়দ আবদুল মতিনও ছিলেন। ট্রেজারি ভেঙে আমরা অস্ত্র নিয়ে নিই। কাদের সিদ্দিকী এক ট্রাক বোঝাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চলে যান। আমাকে বলেন বাকিদের নিরাপদে নিয়ে আসতে।

পাকিস্তানি সেনারা করোটিয়ায় এসেই টাঙ্গাইল শহরের দিকে শেলিং শুরু করে। বাড়ির পেছনে ছোট্ট নদী। পানি খুব কম। একটা রাইফেল ছিল সাথে। ওটা নিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই শেল এসে পড়ছে। অনেকেই হতাহত হয় সেখানে।

স্কুলে থাকতে স্কাউট করতাম। বোমা আসলে কী করতে হবে– সেটা জানা ছিল। কিন্তু চোখের সামনেই ভাতিজা আবদুল কুদ্দুস ও এক বন্ধুর ভাই সানোয়ার হোসেন অনু মারা যায়। আনসার সদস্যরা ওখানে কয়েকটা রাইফেল ফেলে রেখে চলে যায়। রাইফেলগুলো তুলে নিয়ে চলে যাই বিন্নাপুরা। পরিচিত একজনের বাড়িতে লুকিয়ে রাখি অস্ত্রগুলো।”

পরে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করে জোগারচরে মোকছেদ মিয়ার বাড়িতে তারা মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। এর প্রধান ছিলেন সোহরাওয়ার্দী অ্যাডভোকেট।

এর পর কী করলেন তারা?

আজাদ বললেন এভাবে, “চর্তুদিকে ডাকাতের ভয় ছিল তখন। টাঙ্গাইলে ছিল রাজাকার খোকা কমান্ডার। তার জ্ঞাতিগুষ্টি সবাই ডাকাতি করত। ওরা মগড়াতে ঘোড়া নিয়ে হিন্দু এলাকায় ডাকাতি করতে আসত। তখন মিস ফায়ার করতাম। গুলির আওয়াজে ওরা আর এগোত না।

ধীরে ধীরে জোগারচরে যোগ দেয় টাঙ্গাইলের অধিকাংশ ছাত্রনেতারা। অনেক অস্ত্রও কালেকশন হয়ে যায়। ট্রেনিংও চলে নদীর পাড়ে। এক্স আর্মি ও যারা ছুটিতে পাকিস্তান থেকে চলে আসছিল তারাও খোঁজ পেয়ে চলে আসে। ক্যাম্পের মূল নেতৃত্ব ছিল সোহরাওয়ার্দী, সোহরাব আলী খান আরজু ও আমার ওপর।”

কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে তখন আপনাদের যোগাযোগ ছিল না?

“না। তিনি তখন বহেরাতলীতে মুক্তিবাহিনী গঠন করে ফেলেছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন থাকলে তো হবে না। আনোয়ারুল আলম শহিদ ও এনায়েত করিম সাহেবকে বললাম যোগাযোগ করতে। তাদের মাধ্যমে মে মাসে ভূঞাপুর ডাক বাংলোয় আমাদের সঙ্গে বসেন কাদের সিদ্দিকী।

আমাদের উদ্যোগকে ভালোভাবে নিলেন না তিনি। কৌশলে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গ্রুপটাকে দুর্বল করে দেন, যাতে তার নেতৃত্ব সকলেই মেনে নিই। গ্রুপের নেতা সোহরাওয়ার্দী খানকে ডাক বাংলোর বারান্দায় কাদের সিদ্দিকী নানাভাবে অপদস্থ ও মানসিকভাবে টর্চার করেন। এ ঘটনায় অধিকাংশই কাদের সিদ্দিকীর আচরণ পছন্দ করিনি। পরে আমাদের গ্রুপটি কাদেরিয়া বাহিনীতেই একীভূত হয়।”

এরপর কাদের সিদ্দিকী কোম্পানি ভাগ করে দেন। ভূঞাপুরের দায়িত্ব নেন এনায়েত করিম সাহেব, বেসরকারি প্রশাসক হিসেবে। মোয়াজ্জেম হোসেন খান, কবি বুলবুল খান মাহবুবও ছিলেন। ভূঞাপুরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আবদুল গফুর বীরপ্রতীক। ওই কোম্পানিতেই ছিলেন আবুল কামাল আজাদ।

আজাদরা গেরিলা অপারেশন করেন টাঙ্গাইল শহরের ঢাকাইয়া পট্টি মার্কেটের বারান্দায় অবস্থান নেয়া রাজাকার ক্যাম্পে, টেলিফোন ও টেলিগ্রাম অফিসে, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার হাউজ প্রভৃতি জায়গায়। একবার পরিকল্পনা হয় টাঙ্গাইল শহরের বৈদ্যুতিক পাওয়ার হাউজ ধ্বংস করার। শহরটাকে অন্ধকার করা গেলে আক্রমণ করাও সহজ হবে। এবারও দায়িত্ব এসে পড়ে আজাদ আর বাকুর ওপর। কিন্তু ১৬ অগাস্ট ১৯৭১, ভোরে তারুটিয়া ভাতকুড়া নামক জায়গায় ধরে পড়ে যান তারা।

কীভাবে?

তার ভাষায়, “পেছন থেকে দুজন দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন ছিল রাজাকার মোতালেব। খুব কাছেই একটা নদী ছিল। পার হতে পারলেই কাশবনে লুকানো যাবে। আমরা ওদের সঙ্গে তর্ক করি আর সরে যাওয়ার প্ল্যান করছি।

এমন সময় বাকু বলে, কালাম পাকিস্তান আর্মি। পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলছে এক থেকে দেড়শ জন। বাকু কোথায় গেল জানি না। ওরা গুলি করছে। ভাবলাম মরলে বীরের মতো মরাই ভালো। বৃষ্টি তখনও হচ্ছে। সামনে ধানক্ষেত। আইলের কাছে পজিশন নিই যাতে গুলি না লাগে। অতঃপর ওদের দিকে একটা করে গ্রেনেড থ্রো করি।

মাঝেমধ্যে পিস্তলের সিঙ্গেল শটও দিই। ওরা থেমে থেমে গুলি করে। হঠাৎ একটা শব্দ হয়। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসে। তখনই জ্ঞান হারাই। ওদের গুলির একটা স্প্লিন্টার আমার বাঁ চোখের হাড়ে আঘাত করে পিছলে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা চতুর্দিক ঘিরে আছে। যে যেভাবে পারছে আমাকে পেটাতে থাকে। সারা শরীরে রক্ত জমাট বেধে যায়। গামছা দিয়ে আমার হাত পেছনে বেঁধে দেয়। এর পরই বাকুর কাছে নিয়ে যায়।

নদীর কাছেই গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়েছিল বাকু। ইকবাল নামে এক পুলিশ সদস্য চোখের সামনেই তাকে আরও নয়টা গুলি করে। গুলি লাগলেই ওর শরীরটা একটা ঝাকি দিচ্ছিল। বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। আমাকে পেটাতে পেটাতে প্রথমে থানায় এবং পরে নিয়ে যায় সার্কিট হাউজে। এর পর শুরু হয় নিদারুণ টর্চার।”

পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার ছিল পৈশাচিক। সেটা সহ্য করে আবুল কালাম আজাদ বেঁচে ফিরবেন—এটা স্বপ্নেও ভাবেননি। টার্চারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হন এই বীর। দেশের স্বাধীনতার জন্য একজন বীরবিক্রমের নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতাও একাত্তরের বীরত্বকে স্পষ্ট করে। খানিকটা নীরব থেকে শুনে যাই তার পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনাগুলো। তিনি বলেন যান এভাবে:

“একটা রুমে রাতে রাখে। দেওয়ালের চর্তুদিকে ও মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। বোঝা যায় অনেককেই মারা হয়েছে। দু-জন সুবেদার খুব টর্চার করে। পরদিন সকালেই একটা গাড়ি এলে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় টাঙ্গাইল বধ্যভূমিতে। দাঁড় করিয়ে ৫ জন রাইফেল তাক করে। ক্যাপ্টেন হুকুম করলেই গুলি করবে। এমন সময় ওদের ওয়াকিটকিতে কেউ একজন বলে, ‘উসকো ওপাস লিয়ে আও।’

নিয়ে যাওয়া হয় সার্কিট হাউজে। এক কর্নেল বসা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। আমার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও এক্সপ্লোসিভগুলো সাংবাদিকদের দেখিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইল। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে সত্যটাই বললাম। আর্মি এতে নাখোশ হয়। তারা আমাকে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।

পাকিস্তানি সেনারা আজাদের দুই পায়ের তালুতে গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে নির্যাতন চালায়। সে চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন এই বীর বিক্রম, ছবি: সালেক খোকন

ওখানে সবসময় প্রস্তুত থাকতাম মৃত্যুর জন্য। নামাজে দাঁড়াতাম। যখন রুকুতে যাই তখনই গাছের ডাল এনে পিটাত। দুটো শেডে রেখেছিল অনেককে। দেড় মাস প্রায় প্রতিদিনই চলে টর্চার। একদিন আমাকে নিয়ে যায় ফাইনাল ইন্টারোগেশন সেন্টারে। সবাই বলল ওখানে গেলে কেউ জীবিত ফেরে না। শুনে আৎকে উঠি।

ইন্টারোগেশন সেন্টারে বিশাল রুম। মেঝেতে রক্ত। টর্চার করার জন্য ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিও আছে। আমাকে বসানো হলো। চা নাস্তাও খেতে দিলো।

এরপর একটা স্টেটমেন্ট এগিয়ে দিয়ে এক মেজর বলল, ‘এদারসে দস্তগত কর দেও।’

‘কেয়া লিখায়ে’

ওরা বলে, ‘জো কুচ লেখায়া দস্তগত কর দেও।’

বলি, নেহি। আগে পড়লে।

বলল, ঠিক হায়।

ইংরেজিতে লেখা ছিল এমন, ‘আমি ইন্ডিয়ান অনুচর, গুপ্তচর ও ফোর্স। ইন্ডিয়া থেকে আমার মতো অনেকেই পাঠানো হয়েছে পাকিস্তানকে শেষ করে দেওয়ার জন্য।’

দস্তগত করলে তারা সেটা বিশ্বকে দেখিয়ে বলবে পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধ নয়, ওটা ভারত ঘটাচ্ছে। রাজি হলাম না। ফলে চলে অমানুষিক টর্চার। ওই টর্চারের কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। চলে ইলেকট্রিক শক। পায়াখানার রাস্তায় গরম ডিমও প্রবেশ করায়। এরপরও দস্তখত দিতে রাজি হই না।

তখন এক হাবিলদার দুটো চিকন রড আগুনে লাল করে নিয়ে আসে। ওয়ালের সাথে আমার দুই হাত বাঁধা হয়। ওরা চোখ দুটো তুলে ফেলবে। মনে মনে আল্লাহর নাম জপি। হঠাৎ মেজর থামতে বললেন। তখন আমার হাত ওপরে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এর পর গরম রড দুটো দুই পায়ের তালুতে ঢুকিয়ে দেয় ওরা। জীবনটা তখন বের হয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারাই। ওখানে অচেতন অবস্থায় ছিলাম প্রায় ৭দিন। পায়ের ক্ষতে ওষুধ দেয়নি কোনো। পা পঁচে সাদা সাদা পোকা ধরে গিয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছি। কাঁদতেও দিতো না ওরা।

৪-৫ দিন পর আমাকে নিয়ে যায় রেডিও স্টেশনে। বেলুচ আর্মি আর দুজন ক্যাপ্টেন ছিল সঙ্গে। রেডিওর এক অফিসার বললেন, ‘আপনাকে জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে প্রশ্ন করে আজ সেটা রেডিওতে প্রচার করা হবে। আপনি যদি আপনার মতো করেই বলেন তাহলে এখান থেকে নিয়েই ওরা মেরে ফেলবে। অনেককেই তেমনটা করেছে।

এখন উপায় কী?

তিনি পরামর্শ দিলেন, আপনাকে বলব মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে গেলেন? আপনি বলবেন, ‘মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি সেখানে কাদের সিদ্দিকী জোর করে আমাকে নিয়ে গেছে। তা না হলে মেরে ফেলত। জীবনের ভয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি।’

শুনে প্রথম রাজি হই না। তিনি তখন বোঝালেন। এটা আপনার সহযোদ্ধারাসহ সবাই বুঝবে যে পাকিস্তানি সেনারা আপনাকে টর্চার করে বলাচ্ছে। অনেক চিন্তা করে তার কথায় রাজি হলাম। এরপরই রেডিওতে বলি কথাগুলো। ৫-৬ দিন ধরে আমার ওই স্টেটমেন্টই পাকিস্তানি সেনারা রেডিওতে প্রচার করেছিল।”

এরপরই কি আপনাকে ছেড়ে দেয়?

তিনি বলেন, “না। বিচারও করে। শেরেবাংলা নগরে ট্রায়াল হয়। রায়ে আমাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বয়স কম ও ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাইনি— ওই স্টেটমেন্টটা বিবেচনা করে আমাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১৫টা বেত্রাঘাতের দণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে নিয়ে ওই বেত্রাঘাতের দণ্ডটি কার্যকর হয়। ওটা ছিল আরেক কষ্টের অধ্যায়। দেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর বেরিয়ে আসি জেল থেকে।”

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ, ছবি: সালেক খোকন

স্বাধীন দেশ নিয়ে ভালো লাগার অনুভূতি তুলে ধরেন এই সূর্যসন্তান। অকপটে বলেন, ‘স্বাধীন দেশের একটা মানচিত্র পেয়েছি, ভৌগলিক সীমারেখা আর একটা পাতাকা পেয়েছি। বাঙালির অধিকার পেয়েছি। এখন এদেশে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সচিব, এসপি, ডিসি, বিগ্রেডিয়ার সবাই বাঙালি। দেশ স্বাধীন না হলে পাকিস্তানের গোলামি করেই থাকতে হতো।’’

খারাপ লাগে কখন?

তিনি বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়বাদের ভিত্তিতে আমরা যুদ্ধ করেছি। সেটা এখন নেই। স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে যা আমরা প্রত্যাশাও করিনি। রাজনৈতিক দল না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। এখন রাজনীতিবিদদের মধ্যে লোভ অনেক বেড়েছে, আর সুবিধাবাদী একটি গ্রুপ আছে যারা সবসময় লেবাস পরিবর্তন করে। ফলে রাজনীতিতে আদর্শবান মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এটা বাড়াতে হবে।”

প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রমের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “মুক্তিযুদ্ধে কী ঘটেছে, কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে—এটা তোমরা জেনে নিও। ইতিহাসের সত্য ঘটনাগুলো হৃদয়ে রেখো। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসই তোমাকে সাহসী করে তুলবে।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ ডিসেম্বর ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button