মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কাজেও কেন লেনদেন চলবে?

- যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল

“নদীর নাম গোরই। গ্রামের মধ্য দিয়েই চলে গেছে নদীটি। ছোটবেলায় ওই নদীতেই সাঁতার কাটতাম। বর্ষায় নদীর রূপ যেত বদলে। স্কুল থেকে এসে বাঁশের কঞ্চিতে ছিপ বানিয়ে মাছ ধরতাম তখন। টেংরা ও ফলই মাছই বেশি উঠত। শেষে বন্ধুদের নিয়ে নদীতে ঝাপাঝাপি করতাম। চোখমুখ লাল হয়ে যেত। বাড়ি ফিরলেই মায়ের সেকি বকুনি। তবুও ওই আনন্দটাই মনে গেঁথে আছে।”

“আমি ছিলাম খুব চঞ্চল। হাডুডু আর ডাংগুলি খেলা ছিল প্রিয়। খেলা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই হাতাহাতি হতো। বন্ধু তোফাজ্জেল, কাফী, আমিরুল্লাহ প্রমুখ একসঙ্গে চলতাম। ওইসময়টা সত্যি অন্যরকম ছিল। এখনকার মতো তখন তো ঘরে ঘরে ইলেক্টিসিটি, টিভি, ডিস আর ইন্টারনেট ছিল না। আমাদের বাড়িতে ছিল একটা থ্রি ব্যান্ড ফিলিপস রেডিও। ওটাতেই গানবাজনা ও খবর শোনা হতো। ফৌজিদের গানের অনুষ্ঠানটি ছিল খুব জনপ্রিয়। সবাই মিলে শুনতাম সেটা। গ্রামের সে পরিবেশ এখন নাই। নদীটাও নাই, জিকে ক্যানেল হয়ে গেছে। গ্রামগুলোও আধুনিক হয়ে উঠেছে।”

“তখন আন্দোলন–সংগ্রামগুলো গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কলেজে গিয়ে কিছুদিন ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করি। আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বটা তখন খুব বেশি ছিল।”

“মানুষকে আমরা মোটিভেট করতাম। ছয় দফা ও এগার দফা নিয়েও কাজ করেছি।আর দেশ নিয়ে নানা খবরাখবর সিনিয়রদের মুখে, পত্রিকা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনে যেতাম। বৈষম্যগুলো ছাত্র–যুবকদের মনে প্রবলভাবে ঝড় তোলে। ঠিক মেনে নিতে পারিনি। এরপর তো নির্বাচন এলো।”

“সত্তরের নির্বাচনে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এমপিএ পদে আওয়ামী লীগের রউফ চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছি। উনি খুব সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিলে সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওইসময় আমরাও মিরপুরে মিছিল করতাম। রাতে বের হতো মশাল মিছিলও। সেখানে ছাত্রদের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। রউফ চৌধুরী ছাড়াও আব্দুল জলিল নেতৃত্ব দিতেন। তখনকার দিনগুলো ছিল মিছিলের দিন।”

“আমরা অপেক্ষায় ছিলাম বঙ্গবন্ধু কী নির্দেশ দেন। এরপর খবর এলো বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন সাতই মার্চে। বুঝে ফেললাম কিছু ঘটবে।রেডিওতে শুনি সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করতে…।’ ওই ভাষণেই নেতা স্পষ্ট বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার ঘোষণা এরপর আর লাগেনি।”

একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সোহরাব গনি দুলাল। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

আজাহার আলী শেখ ও ছুরাতন বেগমের বড় সন্তান দুলাল। বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুরের সুলতানপুর গ্রামে।তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মিরপুর প্রাইমারি স্কুল। ম্যাট্রিক পাশ করেন মিরপুর হাই স্কুল থেকে, ১৯৬৬ সালে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন কুষ্টিয়া কলেজে। পরে চলে যান মেহেরপুর, বিএসসিতে ভর্তি হন ঝিনাইদহ কেসি কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বিএসসি ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র।

২৫ মার্চের পর সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা।মিরপুরে আর্মিদের ঢোকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে দুলালরা বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখে। কাঁচা রাস্তাগুলোতে গর্তও করে দেয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা ক্ষিপ্ত হয়। মিরপুর থানা কাউন্সিলে ক্যাম্প করে পাকিস্তানি সেনারা।এরপরই গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে থাকে। দুলালদের বাড়িও পুড়িয়ে দেয় ওরা। তার ভাষায়-

“আমরা দুই ভাই আর বাবা লুকিয়ে ছিলাম বাড়ির পেছনে, কুষ্টা (পাট) খেতের আড়ালে। দেখলাম দাউ দাউ করে বাড়িটা পুড়ছে। বুকের ভেতরটা তখন খামছে ধরে।”

“মিরপুরে পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগী ছিল নুর মোহাম্মদ বাটলার, ইউসুফ আলী মুন্সি, মাহবুব বিহারী ও মুসলিম লীগের বড় নেতা মোজাম্মেল হক খান চৌধুরী, চুনু চৌধুরী প্রমুখ। ওরা আর্মিদের পথ দেখাত। কে আন্দোলন করছে, কারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাদের বাড়িঘর দেখিয়ে দিত। মোল্লা–মৌলভীদের একটা বড় অংশ ওই সময় জামায়াতের রাজনীতি করত। ওরা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে সবচেয়ে বেশি। গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত তারা।মিরপুর ও খন্দকবাড়িয়া, চিতলিয়ায়, দৌলতপুর থানার পাহাড়পুরে, আমলা সদরপুর এলাকায় একাত্তরে ঘটেছে এসব গণহত্যাগুলো।”

এরপর কী করলেন?

“পরিবারসহ চলে যাই ভারতে। দৌলতপুর ধর্মদাহ বর্ডার পার হয়ে প্রথমে ভারতের শিকারপুর এবং পরে করিমপুর আসি। সেখানে পরিবার রেখেই রিক্রুটিং ক্যাম্পে নাম লেখাই।ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন গোলাম কিবরিয়া সাহেব, আনোয়ার আলী, বারী ভাই, জিকু ভাই, দুদু ভাই প্রমুখ। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহার চাকুলিয়ায়। একুশ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখানো হয় থ্রি নট থ্রি রাইফেল, টু–ইঞ্চ মর্টার, এসএলআর, এসএমজি, গ্রেনেড থ্রো প্রভৃতি।”

ট্রেনিংটা কি খুব সহজ ছিল?

“না। কিন্তু আমাদের কাছে কঠিন মনে হয়নি। বুকে ছিল দেশপ্রেম।চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে তাবুর চারপাশ দিয়ে আড়াই ফিট বা তিন ফিট চওড়া ট্রেন্স কাটা থাকতো। ওখানে রাতে দুইফিট বা আড়াইফিট লম্বা অসংখ্য সাপ আসত। সকালবেলা উঠেই দেখতাম ট্রেঞ্চে অনেক সাপ। ওগুলো চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হতো। এক সহযোদ্ধাকে একবার সাপে কেটে মেরে ফেলে। ওইদিন ক্যাম্পে ছিল শোকের ছায়া। হাবিবুর রহমান হাবিব, রঞ্জিত প্রমুখ আমার সঙ্গে ট্রেনিং নেন। ১৯টা উইং ছিল, একেকটা উইংয়ে থাকতো একশ ছেলে। আমার উইংয়ের কমান্ডার ছিলেন একজন শিক, নাম মেজর সদরুল শিং কলোন। লেফটেনেন্ট পানি কাউরের কথাও খুব মনে পড়ে। উনি খুব উৎসাহ দিতেন। তখন চাকুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকলেই বোঝা যেত দেশ স্বাধীন হবে। চারদিকে ফায়ার হচ্ছে, ট্রেনিং নিচ্ছেন শত শত যুবক- দেখলেই সাহস বেড়ে যেত। ট্রেনিংয়ে আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ছিল ৮১৭৬।”

আপনি চাইলে পরিবারের সঙ্গে ভারতেই থেকে যেতে পারতেন। তবুও যুদ্ধে গেলেন কেন?

মুচকি হেসে দুলাল বলেন- “প্রথমত দেশপ্রেম। দ্বিতীয়ত সাহস। তারাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে গেছে যাদের ভেতর এ দুটি গুণ ছিল।এছাড়া আমরা পলিটিক্যালিও কনসাস ছিলাম। বাবা–মাও বাঁধা দেননি। সাহস দিয়ে বাবা বলেছিলেন- যুদ্ধে যাও, দেশ স্বাধীন না হলে তো নিজের দেশে আমরা ফিরতে পারব না।”

ভারতের শক্তিনগর হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন সোহরাব গনির ছবিটি তোলেন আনন্দবাজার পত্রিকার এক সাংবাদিক

ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল অস্ত্র পান চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে। অতঃপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিজ এলাকায়। তাদের দলে ছিল ১২ বা ১৩জন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ড করতেন তিনি নিজেই। গেরিলা ছিলেন। রাতের বেলা অপারেশন করতেন।দিনের বেলায় সমমনা মানুষের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতেন। সাধারণ মানুষ নানা খবর দিত, পথ দেখাত, খাবার দিয়ে সহযোগিতা করত। এমন সহযোগিতা না থাকলে অপারেশনগুলোয় গেরিলারা জয় লাভ করতে পারত না বলে মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

তার ভাষায়- “অপারেশনের পদ্ধতি ছিল হিট অ্যান্ড রান। প্রথম অপারেশন করি মিরপুর থানায়। রাজাকার ও মিলিশিয়াদের ছোট ছোট ক্যাম্পেও অ্যাটাক করতাম। আট নম্বর সেক্টরের অধীনে অপারেশন করেছি দৌলতপুর, মিরপুর, আমলা সদরপুর, চিতলিয়া, মশাল বলদিপাড়া প্রভৃতি এলাকায়। আমার অস্ত্র ছিল এসএমজি। খবর পেতাম মানুষের মুখে মুখে। গ্রামের মানুষ সহযোগিতা করত। এতে তাদেরও জীবনের ঝুঁকি ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছি সাধারণ মানুষও তেমনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাশে ছিলেন। ১৯৭১–এ তাদের অবদানও ছোট করে দেখা উচিত নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার ইতিহাসটাও তুলে না প্রয়োজন।”

এক অপারেশনে মারত্মকভাবে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা মো. সোহরাব গনি দুলাল।কী ঘটেছিল ওইদিন? এই যোদ্ধার মুখে শুনি সেদিনের আদ্যোপান্ত- “দৌলতপুর থানার তালবাড়িয়া গ্রামে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা খুব অত্যাচার করত। বিকেলের দিকে প্রায়ই ওরা আসে। কারও গরু, কারও ছাগল ধরে নিয়ে যায়। এই খবরটা পাই লোকমুখে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকের ঘটনা।কাছাকাছি একটা গ্রামে ছিলাম আমরা। তখনই প্ল্যান করি অ্যাটাকের। নিচু জায়গায় ও ক্ষেতের মধ্যে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ওরা আসতেই শুরু হয় গোলাগুলি। মিনিট–ত্রিশেক চলে সেটা। কথা ছিল একটা রুমাল বা কাপড় উঁচু করে ইশারা দিলেই সহযোদ্ধারা পজিশন চেঞ্জ করবে।”

গুলিতে বাঁ হাতের চারটি আঙুল রক্তাক্ত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলালের, ছবি: সালেক খোকন

“সন্ধ্যার ঠিক আগের ঘটনা। গোলাগুলি চলছে। আমি বাঁ হাত উঁচু করে রুমাল তুলতেই ওরা দেখে ফেলে। চু করে কয়েকটা গুলি এসে আমার বাঁ হাতের চারটি আঙুল স্পর্শ করে চলে যায়। রক্তাক্ত হয় হাতটা। চিৎকার করতেই ছুটে আসে সহযোদ্ধারা। বর্ডার পার করে প্রথমে নেওয়া হয় করিমপুর হাসপাতালে। আঙুলের হাড় কুচিকুচি হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার ডাক্তাররা বললেন- ‘আঙুলগুলো কেটে ফেলতে হবে।’ রাজি হলাম না। তখন চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের কৃষ্ণনগরে, শক্তিনগর হাসপাতালে। আঙুলগুলো টিকে গেলেও বাঁ হাতের আঙুল পুরোপুরি আর মুঠো করতে পারি না। শীতের সময় যন্ত্রণাও হয় খুব। ওই হাতে শক্তিও পাই কম। এই কষ্টটা চলবে মৃত্যুর আগ পর্যন্তই।”

ভিডিওচাকুলিয়া ক্যাম্পের ট্রেনিং, কুষ্টিয়ার মিরপুরের যুদ্ধাপরাধী তালবাড়িয়ার রক্তাক্ত স্মৃতি

“আহত হওয়ার পর একদিন হাসপাতালে আসেন আনন্দবাজার পত্রিকার এক সাংবাদিক। তিনি আমার একটি ছবি তোলেন।আনন্দবাজার পত্রিকায় ছবিটি সংবাদসহ ছাপাও হয়। ওই সাংবাদিকই পরে হাতে ব্যান্ডেজ অবস্থায় থাকা আমার ওই ছবি দিয়ে যান। ছবিটির দিকে তাকালে আজও একাত্তরটা জীবন্ত হয়ে ওঠে!”

স্বাধীনের পর কুষ্টিয়ায় ফিরে এই যোদ্ধা দেখা করেন রউফ চৌধুরীর সঙ্গে। হাতে তখনও ব্যান্ডেজ ছিল। রউফ চৌধুরী বললেন- “এ অবস্থায় একটা ছবি তোল।” সেখানে উপস্থিত ছিলেন কুষ্টিয়ার আলোকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হান। তিনিই ওইসময় তার একটা ছবি তোলেন। আহতকালীন এসব ছবি, হাসপাতালে চিকিৎসার প্রামাণ্য থাকা সত্ত্বেও সোহরাব গনি দুলালের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি সরকারের যুদ্ধাহতের তালিকায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেলেও তিনি পান না কোনো যুদ্ধাহত ভাতা।

কেন?

তিনি বলেন- “প্রথম দিকে আবেদন করিনি। ২০১৫ সালে সকল প্রমাণসহ যুদ্ধাহতের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য লিখিত আবেদন করি। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী তাতে সুপারিশও করে জামুকাতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে যায়। জামুকার এক কর্মচারী দশ হাজার টাকা চাইল। শুনেই ঘেন্না ধরে যায়।ওকে বলেছিলাম- ‘স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলাম, রক্ত দিলাম, এখন স্বাধীন দেশে যুদ্ধাহত ভাতার জন্য টাকা দিব! তোদের মুখে থুতু দিই।’ এর পর আমিও আর খোঁজ নেইনি। ওরাও যাচাই–বাছাইয়ের জন্য ডাকেনি। ফলে দেশের জন্য রক্ত দিয়েও যুদ্ধাহতের স্বীকৃতিটুকু পাইনি। কষ্ট নেই, তবে আফসোস আছে। স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাই কাজেও কেন টাকার লেনদেন চলবে?”

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল (বঙ্গবন্ধুর সামনে বসা)

১৯৭৩ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল। তাঁর জীবনে ওই দিনটি ছিল স্মরণীয়।

তার ভাষায়- “যার ডাকে যুদ্ধ কললাম, রক্ত দিলাম, দেশ স্বাধীন করলাম, তাকেই তো সরাসরি দেখলাম না।কথাটা শামসুল আলম দুদু ও আনোয়ার আলী ভাইকে বলতেই তারা নিয়ে যান ঢাকায়, তৎকালীন খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ও কুষ্টিয়া সদরের এমপি ব্যারিস্টার আমীর–উল–ইসলামের কাছে। তিনিসহ সবাই যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি তখন বসতেন রমনা পার্কের উল্টোপাশে, সুগন্ধ্যায়। তার স্পর্শ পাওয়ার ইচ্ছায় ছবি তোলার সময় আমি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে গিয়ে বসি। ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারলেন। দুই হাতে ঘাড় স্পর্শ করে বঙ্গবন্ধু বললেন- এই তোর নাম কিরে? বলি- ‘বঙ্গবন্ধু, আমার নাম সোহরাব গনি দুলাল।’শুনেই তিনি আমার ঘাড়ে আবার থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও তুই আলালের ঘরের দুলাল’। মৃত্যুর পূর্ব পর্য এই স্মৃতিটা থাকবে।”

“বঙ্গবন্ধু মহাচুম্বক। উনার সংস্পর্শে একবার যদি কেউ আসছে সে বঙ্গবন্ধুকে কখনো ভুলবে না।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মা ভয়ে ছবিগুলো বালিশের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। তখন তো তার কথা মুখেই আনা যেত না। প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ও জয় বাংলা বলতেও পারিনি আমরা।”

তিনি আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এ দুটো অবিচ্ছেদ্য নাম। এটা ভাগ করা যাবে না।এতো বড় মেহনতি মানুষের নেতা আর আসবে না। আন কম্পারেবল, আন প্যারালাল লিডার। বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই।”

ভিডিও-০২: বঙ্গবন্ধু বললেন- ও, তুই আলালের ঘরের দুলাল 

স্বাধীনতা লাভের পরের বাংলাদেশ কেমন ছিল?

মুক্তিযোদ্ধা দুলালের অকপট উত্তর- “বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত দেশ ঠিক ছিল।কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দেশটা আবার রাজাকার, আলবদর, জামায়াতে ইসলামের বাংলাদেশ হয়েছে। আমার মতে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু উনি ছিলেন সুগার কোটেড মুক্তিযোদ্ধা।”

কেমন?

“কিছু ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট থাকে তেতো, খাওয়া যায় না। তখন তার ওপরে হালকা চিনির প্রলেপ দেওয়া হয়।জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াটা ওই চিনির প্রলেপের মতোই। ভেতরে পাকিস্তানি ভাবধারা।”

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুক্তিযোদ্ধা দুলালের উত্তর- “একটা মানচিত্র, একটা পতাকা পেয়েছি। এটাই তখন স্বপ্ন ছিল। দেশে আজ অনেক উন্নতি হয়েছে।সরকার ভূমিহীন ও দুস্থদেরও বাড়ি করে দিচ্ছে, অনেক দেশের আগেই কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন আমরা পেয়েছি। এমন সফলতার সংবাদে আনন্দে মন ভরে যায়।”

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

“যদি চোরগুলোর একটা ব্যবস্থা করা যেত তাহলে দেশটা আরও বদলে যেত। তখন একটা পদ্মা ব্রিজ কেন এরকম দশটা ব্রিজ করা যেত। বিদেশে পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকাও ফেরত এনে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে লাগানো দরকার।মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য এটা বিরাট ব্যাপার। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারাই গরীব কৃষক পরিবারের সন্তান, মেহনতি মানুষের ছেলে। কয়জন ধনীর দুলাল মুক্তিযুদ্ধে গেছেন? মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা খেয়াল রাখছেন- এটা অনেক সম্মানের। বঙ্গবন্ধুর হত্যাতে আমরা হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছি। কিন্তু শেখ হাসিনা না থাকলেও আমরা আরও শত বছর পিছিয়ে যেতাম।”

“এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করেন। এটা এ সরকারের রেখে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।”

বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং মৌলবাদী ও জামায়াত–শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মত দেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষায়-“ওরা তো বসে নেই। জ্বালাও পোড়াও করছেই। ছদ্মবেশে জামায়াতের লোকও সরকারের ভেতর আছে।সারা পৃথিবীতেই কোনো দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের কোন সিটিজেনশিপও থাকে না। অথচ আমাদের দেশে আছে এবং তারা রাজনীতিও করছে। এটা তো আমরা চাইনি।”

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল।

টেলিভিশনে নিয়মিত খবর দেখতেন মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল।যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী যেদিন মন্ত্রী হন সেদিন তার শপথ নেওয়ার খবর দেখে তিনি অঝোরে কাঁদেন। এরপর মনোকষ্টে তিনি দীর্ঘদিন খবর দেখেন নি। এটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার বড় সন্তান সাবেরা গনি রুপা।

রুপ আরও একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন এভাবে- “ছোট ভাই অমিতের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ১৬ বছর। বিএনপির শাসনামলে ওকে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে ভর্তি করাতে যাই। কাগজপত্রের সঙ্গে বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদটাও জমা দিই।তা দেখে জেলা স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিক বিদ্রুপ করে বলেছিলেন- ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার এই বয়সী ছেলে থাকবে কেন? সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।’ কথাটা শুনে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন  অসম্মানের চোখে দেখা হতো। কিন্তু আমি ও আমার পরিবার মুক্তিযোদ্ধা পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই দেশপ্রেম পেয়েছি। তাই চেষ্টা করি দেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে থাকার। কাজ করি বাংলাদেশকে সম্মানিত করতে।”

পরিবারের সাথে মুক্তিযোদ্ধা মো. সোহরাব গনি দুলাল

প্রজন্মই একদিন সত্যিকারের বাংলাদেশ গড়বে। এমনটাই আশা সাতাত্তর বছর বয়সী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলালের। তাই চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো- “সোনার বাংলার সোনার মানুষ হবে তোমরা।যে যেখানে যে কর্মেই থাকো না কেন তোমরা সৎ থেকো। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবেসো। তবেই স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করবে।”

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম : যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব গনি দুলাল।

ট্রেনিং : ভারতের বিহার চাকুলিয়া থেকে একুশ দিনের ট্রেনিং নেন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর: ৮১৭৬।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন : আট নম্বর সেক্টরের অধীনে দৌলতপুর, মিরপুর, আমলা সদরপুর, চিতলিয়া, মশাল বলদিপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।

যুদ্ধাহত:  ১৯৭১–এর নভেম্বরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকের ঘটনা। দৌলতপুর থানার তালবাড়িয়া গ্রামে মিলিশিয়া ও রাজাকারদের গুলিতে তার বাম হাতের চারটি আঙুল রক্তাক্ত হয়। আঙুলের হাড় কুচিকুচি হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসায় আঙুলগুলো টিকে গেলেও বাম হাত পুরোপুরি মুঠো করতে পারেন না। এখনও যন্ত্রণা হয়। হাতে শক্তিও পান কম।

ছবি  ভিডিও : সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ এপ্রিল ২০২১

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button