ভ্রমণকথা

কড়ইতলী: দূর পাহাড়ের হাতছানি

দূর জনপদের ছোট্ট বাজারের প্রান্তে ক্লান্ত বৃদ্ধা একডালি শামুক বেচতে বসে, ছোট্ট পুঁটি মাছটি মৃতচোখে তাকিয়ে থাকে খ্যাপলা জালের খোপে

শাপলা বাজার মোড় পার হতেই দৃশ্যপট বদলে গেল। দুই পাশে পাহাড় আর পাহাড়। একটির পেছনে আরেকটি। যেন একটি আরেকটির ছায়া।সবগুলো পাহাড় যেন আকাশ ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দু-একটি পাহাড়ে তখন মেঘের বসতি। মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের মিতালী চলছে। কোন কোন পাহাড়ে নেমেছে ঝুম বৃষ্টি। এই সকালে সূর্যটাও তাজা। মেঘের ফাঁক বুঝে একরাশ রোদের আলো এসে পড়েছে পাহাড়ে। এক পাহাড়ে বৃষ্টি, অন্যগুলোতে তখন কেবলই রোদ।

এভাবে প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে চলে রোদবৃষ্টির খেলা। মনে হতে পারে এটি কোন পার্বত্য জেলার নয়নাভিরাম স্থানের বর্ণনা। কিন্তু না। এটি হালুয়াঘাটের কড়ইতলী থেকে দেখা প্রাকৃতিক দৃশ্য।

ঢাকার খুব কাছের জেলা ময়মনসিংহ। এ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে মেঘালয়ের মেঘ ছোঁয়া বড় বড় সব পাহাড়। তুরা পাহাড়টিকেও নাকি দেখা যায় এখান থেকেই। সহকর্মী সুমনা চিসিমের বাড়ি হালুয়াঘাট। তার বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে সঙ্গী হয় দুই বন্ধু- সোহরাব আর মৃদুল।

ভ্রমণ শুধু প্রকৃতি দেখাই নয়। প্রকৃতি মানে মানুষ, তার জীবন, তার কথা বলা, তার গান গাওয়া। ভ্রমণের দেখা শুধু পর্বতের চূড়া আর সমুদ্রের তরঙ্গ ফেনাই নয়। ভ্রমণ তো সেখানেও, যেখানে নিভৃতে একটি ছোট্ট মটরফুল তার আশ্চর্য নীল রং মেলে ফোটে, দূর জনপদের ছোট্ট বাজারের প্রান্তে ক্লান্ত বৃদ্ধা একডালি শামুক বেচতে বসে, ছোট্ট পুঁটি মাছটি মৃতচোখে তাকিয়ে থাকে খ্যাপলা জালের খোপে।

এমন উপলব্ধি নিয়েই পাহাড় ও প্রকৃতি দেখার আনন্দ পেতে কাকডাকা এক ভোরে শহর থেকে চলে আসি পাহাড়ের পাদদেশের শহর হালুয়াঘাটে।

হালুয়াঘাট কেন নাম? প্রশ্নটা উঁকি দিয়ে আছে সেই তখন থেকে। সুমনা সময়টাকে পিছিয়ে নিয়ে গেল ১৬৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি একটা সময়। তখন কংস নদীতে দর্শা নামের একটা ঘাট ছিল। এই নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সব ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালুয়া অর্থ চাষী। হাল চাষীরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অর্থ দাঁড়ায় হালুয়াদের ঘাট। সে থেকেই এ নাম।

কেউ কেউ অবশ্য বলে, ঘাটটি হালুয়া নামের এক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করত বলে নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। নাম নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে নেই কোন মতভেদ।

হালুয়াঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা করে যাই আচকিপাড়ায়। সুমনার বাবা হরিপদ রিছিলকে এলাকায় সবাই চেনে। নাশতার পর কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হয় সুমনা। বলা বাহুল্য, আমরাও পিছু নিই।

সুমনা বলে, সূর্যপুর, পানিহাটা আর কড়ইতলী থেকে মেঘালয়ের পাহাড় ভালো দেখা যায়। কড়ইতলী এগুলোর মধ্যে কাছে। বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি ইটের রাস্তা গেছে শেরপুরের দিকে, অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউড়া। পাহাড় থেকে সীমানাকে থোড়াই কেয়ার করে মাঝেমধ্যে নেমে আসে বন্যহাতি বা মায়াবী হরিণের দল। দুপুরের খাবার সেরে রওনা হই কড়ইতলী।

গ্রামটি গোবরাকুড়া ইউনিয়নে, হালুয়াঘাট শহর থেকে মোটে সাত কিলোমিটার। ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মাঝেমধ্যে কোথাও তাল, কোথাও খেজুর গাছ। ছবি না তুলে এগোতে পারি না। এক জায়গায় দৃশ্য সত্যি মনোহর- ধানক্ষেতে হাঁটু অবধি বৃষ্টির পানি। লম্বা লম্বা পা নিয়ে তাতে মাছ ধরে চলেছে অনেক সাদা বক। সবুজের বুকে সাদা বক। মনে হচ্ছিল সবুজ আঁচলে শিল্পী যেন ভালবাসার তুলি দিয়ে সাদা আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে। কোথাও বীজতলার টিয়া রঙ, কোথাওবা সবুজে সবুজ ধানক্ষেত। কী যে অদ্ভুত! এভাবে ছবির পর ছবি ফেলে আমরা সামনে এগোই।

কড়ইতলীর দিকে যতই যাই ততই মনে হয় স্বপ্নদেশে চলেছি। পাহাড়গুলো এখানে আরো কাছে। স্বর্গীয় পরশ নিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারপাশে। দৃষ্টির সামনে পাহাড়গুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মেঘের পর রোদের ছায়া ঢেউ তুলেছে।

মৃদুলের এসএলআর ক্যামেরা যেন থামতে ভুলে গেছে। মাঠে মাঠে ধান বুনে চলেছে গারো নারী। একজনের নাম বন্যা রংমা। সুমনা জানাল- গারো জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, নারীর হাতে রোপিত গাছ থেকে অধিক ফসল মিলে। তাই হাঁটু অবধি কাঁদায় নেমে আশীর্বাদের পরশ দিয়ে চারা রোপন করছে তারা।

চলতে চলতে একটি ছোট্ট খাল পেলাম। বাঁশ বিছিয়ে সাঁকো তৈরি হয়েছে তার ওপর। পথবন্ধু কিরিত তিছিম জানাল, খাল মনে হলেও এটি আসলে পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট্ট একটি নদী। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলসমেত আছড়ে পড়ে কংসের বুকে। সে সময় লোকালয়ও ভাসিয়ে দেয়। চোখের সামনেই পাহাড় থেকে উড়ে আসে বকের দল। তাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি দূর পাহাড়ে মেঘ ঝরছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় মেঘগুলো ধেয়ে আসে আমাদের দিকে। আমরা পিছু হটি।

কিন্তু নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগেই এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল। ভেজা শরীরে পাহাড়ের দিকে তাকাতে দেখি অন্য দৃশ্য। গোটা পাহাড়ে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উড়ছে। মনে হচ্ছে পাহাড়ের বুকে যেন আগুন লেগেছে। স্থানীয়রা জানলো প্রচণ্ড গরমের পর অল্পবৃষ্টি হলেই পাহাড়ে এরকম ধোঁয়ার মতো বাষ্প ওঠে। শরৎকালে কড়ইতলী থেকেই নাকি দেখা যাবে তুরা পাহাড়টি। এখানে ক্ষণে ক্ষণে বদলায় দূর পাহাড়ের রূপ। কড়ইতলী থেকে আমরা সেগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখি।

বিকেল হতেই কড়ইতলীতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। নানা ঢং আর রঙের পোশাক তাদের গায়ে। অনেক জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে গারো নারীরা। আমরাও মিশে যাই মানুষের দলে। এটা-ওটা দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নামে। সুমনা তাড়া দেয়, পাহাড়গুলো ছাড়তে চায় না। তবু তো ফিরতে হয় যেমনটা হয় বরাবর।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজ বিভাগে, প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button