ভ্রমণকথা

নিউ মেঘনা রাণীর যাত্রা

নারায়ণগঞ্জ থেকে শীতলক্ষ্যা এসে ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে মুন্সীগঞ্জে। হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে লঞ্চের মাস্টার মো. কলিমুল্লাহ তা-ই বললেন।

সাদা গাঙচিলের দল পিছু নিল আমাদের। শুশুকের ডুবসাঁতারে চোখ ভেসে গেল, প্রাণ জুড়ানো বাতাসে হারিয়ে গেল মন। ঢাকার সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধলেশ্বরী ছাড়িয়ে শীতলক্ষ্যার প্রান্ত ছুঁয়ে লঞ্চটি চলছে মেঘনায়।

উথাল পাতাল ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকে ছোট্ট একটি নৌকা। তবুও মাঝির পলক ভাঙ্গে না। দুলে দুলে মাছ ধরছে সে। ঢেউ যেন তার চেনা। প্রতিদিন এভাবে নৌকা দুলিয়ে ছুটে চলে লঞ্চগুলো। সাইরেন বাজিয়ে, দুপারে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে ছুটে চলে আমাদের লঞ্চটিও।

যতই এগোতে থাকে ততই দৃষ্টিসীমার জলরাশি বিস্তৃত হতে থাকে। পাল্টে যায় নদীর চেহারাও। কুয়াশার আবরণে ঠাহর হয় না গন্তব্য। তবু এগিয়ে চলে লঞ্চটি।

বন্ধু সুহান ফোন করেছিল আগের দিন। বলে, চল চাঁদপুর ঘাটে ইলিশ খেয়ে দিনে দিনে ফিরে আসব! রাজি না হয়ে উপায় থাকল না। সকাল সকালই পৌঁছে গিয়েছিলাম সদরঘাট। চার নম্বর গ্যাংওয়ে দিয়ে এগোতেই দেখি চাঁদপুরগামী লঞ্চগুলো। ফার্স্ট ট্রিপ সকাল আটটায়। যাবে ‘নিউ মেঘনা রাণী’। লঞ্চের নাম শুনেই মজে যাই। আমাদের জন্যই যেন মেঘনা রাণী অপেক্ষা করছিল।

৮টা মানে ৮টাই। সাইরেন বাজিয়ে পথে নামে লঞ্চটি। অনেক নৌকা চারধারে-কোনোটায় সবজি, কোনোটায় রুটি-কলা। বুড়িগঙ্গার ওপর নির্মিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচ দিয়ে এগিয়ে চলে লঞ্চটি। বসুন্ধরা শিপইয়ার্ড পার হয়ে ডানের বাঁক ঘুরে চলে আসে ধর্মগঞ্জে। এখানে এসে বুড়িগঙ্গার নাম হয় ধলেশ্বরী। গতিপথও পাল্টে যায়। লঞ্চে বসেই দেখি চারপাশের দৃশ্যগুলো।

কাঠপট্টি যাওয়ার অনেকটা আগে থেকেই সারি সারি ইটভাটা দৃষ্টিপথ আটকে দেয়। শত শত ইটখোলার চুল্লি থেকে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ঢেকে ফেলেছে। কয়লা আর ইট বোঝাই বাল্কহেড চলছে নদীপথে। তবে মুক্তারপুর ব্রিজ পেরোতেই সবুজে মাখামাখি হয়ে যাই।

নারায়ণগঞ্জ থেকে শীতলক্ষ্যা এসে ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে মুন্সীগঞ্জে। হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে লঞ্চের মাস্টার মো. কলিমুল্লাহ তা-ই বললেন। মেঘনার পানিতে রোদ লেগেছে, ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে দূর পর্যন্ত।

হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি সুহান নেই। খুঁজতে গিয়ে থমকে গেলাম। দেখি নদীর প্রেমে উদাস হয়ে সুহান আপন মনেই গান গাইছে। নদীর পানিতে বড় বড় বয়া ভাসছে। মাস্টার বলল, ‘এই বয়া দেইখা বুঝতে পারি, কোনখানে পানি কতখানি।’ বড় একটি লঞ্চ প্রবল গতিতে ছুটে গেল আমাদের উল্টোদিকে। মেঘনা রাণী এবার দুলে উঠল। আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো ওই লঞ্চের অচেনা মানুষগুলোর সঙ্গে। চেনা কাউকে দেখলে বেশ হতো।

সুহান দেখাল, দূরে চরঘেঁষা নদীর পানিতে একদল লোক বাঁশ গাড়ায় ব্যস্ত। মাস্টার বললেন, ‘জাগ দিচ্ছে’। ফাঁদ পেতে বড় বড় মাছ ধরতেই নাকি এ রকম আয়োজন। এরই মধ্যে মেঘনা রাণী চলে আসে গজারিয়ার কাছে। এখানে শীতলক্ষ্যা মিলেছে মেঘনায়। মেঘনা পেয়ে রাণী তার গতি দিল বাড়িয়ে।

আমরা কেবিনে বসে দিগন্তছোঁয়া মেঘনা দেখি। কেবিন বয়কে ডেকে পাউরুটি আর ডিমভাজা খাই। তারপর চা খেয়ে বের হই লঞ্চে চক্কর দিতে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতেই দেখি, টিভি চলছে। সহস্র চোখ একবিন্দুতে সমবেত। ডিপজলের হুক্কার- ‘ওই আমারে চিনছ! সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিমু’।

নিচের তলায় চেয়ারে বসা যাত্রীরাও একই কাজে ব্যস্ত। পেছন দিকে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। কয়েকজন পেপারে চোখ রেখে চা খাচ্ছেন। কথা হয় দুজনের সঙ্গে। বেলায়েত হোসেন ও মমিন মোল্লা দুজনেই সরকারি চাকরি করেন চাঁদপুরে। সুবিধাজনক হওয়ায় প্রতি সপ্তাহেই তারা ঢাকা থেকে লঞ্চে যাতায়াত করেন। জার্নি নিয়ে আমাদের মতো উচ্ছ্বাস নেই তাদের মধ্যে।

মুন্সীগঞ্জের কৃষ্ণ তার কালিঝুলির ব্যাগ নিয়ে এসেছে। বলে, ‘পালিশ কইরা দেই স্যার!’ আমি ভাবি, এই সুযোগ তো এখন আর বেশি পাওয়া যায় না। জুতা জোড়া খুলে এগিয়ে দিই। সে জুত হয়ে বসে জুতার দাগ মুছে দেয়। কৃষ্ণকে ২০ টাকা দিয়ে চকচকে জুতায় ভর করে ঘুরে বেড়াই লঞ্চে।

এক কোণে বসে হাসি-মশকরা করছে এক দম্পতি। ভাব জমিয়ে জানতে পারি, তাদের বিয়ের বয়স ছয়মাস মাত্র। বিয়ের পর এই প্রথম নুর ইসলাম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। বেশ একটা ভাব তার মনে। আমরা বেশিক্ষণ কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকি না। কেবিন-লাগোয়া বারান্দায় বসে মেঘনার পানে চেয়ে থাকি। নদীটা বড্ড বড়, পানিও প্রচুর। রোদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেহারাও বদলে নেয় এখানে-ওখানে।

লগিখোঁড়া চরকে পেছনে ফেলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চাঁদপুর ঘাট। সাড়ে ১১টায় পৌঁছে যাই চাঁদপুর। মাস্টার বললেন, ‘ঠিক ২টায় কিন্তু ছেড়ে যাব। দেরি করবেন না।’ ঘাট থেকে নেমে রেললাইন ধরে আমরা যাই বড় স্টেশনে। পদ্মা আর ডাকাতিয়া এখানে মেঘনায় পড়েছে। মোহনা দেখার দারুণ আনন্দ এখানটায়।

তারপর যাই ইলিশঘাটে। ছোট-বড়, মোটা-চিকন অজস্র ইলিশ এখানে। ঘাটপাড়ে অনেক ফিশিং বোট ভিড়ে আছে। কোনো কোনোটি সেই ভোলার মনপুরা থেকে আসা। বেশ প্রমাণ সাইজের কিছু রিটা, আইড় ও পাঙ্গাশ মাছ দেখলাম। এগুলোর অবশ্য দাম আছে। ঘাটের ছোট হোটেলে ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি মাছ ভাজিয়ে নিই। তারপর খাই আর খাই।

২টা বাজতেই সাইরেন বাজিয়ে ঢাকামুখী যাত্রার জানান দেয় নিউ মেঘনা রাণী। মজমজে ইলিশের স্বাদ মুখে নিয়েই আমরা ফিরতি পথ ধরি। বিকেলে সূর্য হেলে পড়তেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। শীতল বাতাসের পরশ তখন অন্যরকম লাগে। উদাস হয় মন। ইস্, যদি চিরদিন ভেসে থাকতে পারতাম এই মেঘনার বুকে!

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১১ অক্টোবর ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button