কলাম

হৃদয়ে জেগে থাকা নাম শেখ কামাল

 “১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেপ্তার হন। আমি তখন খুব ছোট আর আমার ছোট ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সেই সময়ে আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাই-বোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি আব্বা বলি?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই। আব্বাকে ওর কথা বলি। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।” ছোট ভাই শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে এমন স্মৃতির কথা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার রচিত ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে।

গতকাল ৫ আগস্ট শহীদ শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, বিতর্ক ও সমাজসেবার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। কিন্তু এই অমিত সম্ভাবনাময় তরুণের জীবনপ্রবাহ, চিন্তাচেতনা ও তার আদর্শ এবং স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেওয়া যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটি কি আমরা পেরেছি? ছাত্রলীগের একজন নিয়মিত, সংগ্রামী, আদর্শবান কর্মী হিসেবে তিনি সব আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকেছেন। ১৯৭১-এ শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে লেখাপড়া, ক্রীড়া, সংস্কৃতিচর্চা ও জনসেবায় ফিরে যান।

কেন তিনি এটি করলেন? তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, সদ্য স্বাধীন নিঃস্ব দেশে যুদ্ধফেরত সব তরুণের রাতারাতি কর্মসংস্থান করা যাবে না। আবার পুরনো শিক্ষাঙ্গনের বা কর্মস্থলের প্রতিও তারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। এতে অপকর্মে জড়িয়ে পড়বে, চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে যাবে। তাই হতাশাযুক্ত কর্মহীন তরুণ ও কিশোরদের নিয়ে শেখ কামাল ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংগীতকে নতুন ধারায় এনে নতুন একটা প্রেরণায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে যারা আগ্রহী ছিলেন না তাদের তিনি আকৃষ্ট করলেন খেলার জগতে। প্রতিষ্ঠা করলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র। যেখানে নিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনেক কৃতী খেলোয়াড়কে। আমাদের দেশে নান্দনিক ফুটবল ও ক্রিকেটসহ অন্যান্য দেশীয় খেলার মান উন্নয়নে শেখ কামাল অক্লান্ত শ্রম দিয়ে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলনও করতেন। আবাহনীর মাধ্যমে বিদেশি কোচ এনে এ দেশে প্রথম আধুনিক ফুটবলের সূচনা করেন তিনি।

শেখ কামালের জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বগুণ নিয়ে সাংবাদিক ও কলাম লেখক প্রয়াত এ বি এম মূসা একটি স্মৃতিকথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন ঠিক এভাবে “বঙ্গবন্ধু তিয়াত্তরের নির্বাচনে আমাকে অংশ নিতে নানা কারণে বাধ্য করলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি তো ৩০০ আসনে যাবেন না, তবে আমার এলাকায় যেতে হবে। তিনি কী বুঝলেন জানি না, দুষ্টুমির মুচকি হাসি হেসে বললেন, আমি যাব না, তবে একজনকে পাঠাব। সেই একজন যে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তহীন শেখ কামাল তা জানলাম এক দিন সকালে টেলিফোন পেয়ে। ফোনে শেখ কামাল বলেন, ‘চাচা, আব্বার হুকুম আপনার দেশের বাড়িতে যেতে হবে।’ নির্ধারিত দিন কামাল ফেনী এলেন, সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতাদের নিয়ে। খোলা জিপে ফেনী থেকে বিলোনিয়া প্রায় ২০ মাইল যাত্রাপথ। আমি জিপের চালকের আসনে, পাশে শেখ শহীদ আর ফেনীর ছাত্রলীগ নেতা রকিবউদ্দিন। আগেই কেমন করে যেন খবরটি রটে গিয়েছিল। যাত্রাপথে দেখি রাস্তার দুই পাশে ছেলে-বুড়ো, শিশু কোলে নারী, ধানক্ষেত থেকে উঠে আসা চাষি সবাইকে। পথে কাকে যেন কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাই বেগগুন এইচ্ছা দৌড়ার-কা? কোনাই যার। সবার মুখে এক কথা ‘শ্যাখের পোলারে দেখতে যাই।’ দীর্ঘ ২০ মাইল পথ কামাল শুধু মুগ্ধ জনতার সালাম নিলেন আর দিলেন, শুধু হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন। যাওয়া-আসার পথে কোথাও থামেননি, পথসভায় রাজনৈতিক ভাষণ দেননি, জনসভা করেননি, নৌকা মার্কায় ভোট চাননি। আমার নির্বাচন সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। পরশুরামে আহারপর্ব শেষে একই পথে ফেনী, অতঃপর ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। আমি গর্বিত, ৩০০টি সংসদীয় আসনের মাত্র এই একটিমাত্র নির্বাচনী এলাকা সফর করেছিলেন শেখ কামাল। তরুণ ও যুবকদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।”

শেখ কামাল জাতির পিতা এবং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সন্তান হয়েও সব সময় ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকতে পছন্দ করতেন। ক্ষমতার প্রতি তার কোনো মোহই ছিল না। সেনাবাহিনীর লোভনীয় পদ ছেড়ে রাজনীতি ও জনসেবায় থাকতে চেয়েছিলেন। আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেও কোনো পদ গ্রহণ না করে একজন কর্মী ও সংগঠক হিসেবেই কাজ করেন। সত্তরের দশকের শুরুতে যখন সারা বিশ্বেই তরুণ প্রজন্ম ড্রাগ আর মাদকের দিকে ঝুঁকছিল, তখন শেখ কামাল তারুণ্য ও যুবসমাজকে সাংস্কৃতিক কর্মকা-, খেলাধুলা ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের দেশ গড়ার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ও সমাজের এমন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ নেই, যেখানে শহীদ শেখ কামালের হাতের ছোঁয়া ছিল না।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সবাইকে হত্যার পর খুনিচক্র শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে ভীত ছিল। সে কারণেই ওই চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীরা এই প্রতিভাবান তরুণ নেতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনার চেষ্টা করে আসছে এবং তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে।

বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকা নাম ‘শেখ কামাল’। আমরা মনে করি তার চিন্তা-চেতনা, প্রতিভা ও আদর্শ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। পাশাপাশি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই ক্ষণজন্মার জীবন নিয়ে বিশদ গবেষণা হওয়াও দরকার।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৬ আগস্ট ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button