কলাম

পাকিস্তান হাইকমিশনের ‘পতাকা বিকৃতি’ প্রসঙ্গে

সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সঙ্গে পাকিস্তানের পতাকা জুড়ে দিয়ে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন তাদের ফেইসবুক পেজের ‘কাভার ফটো’ তৈরি করে পোস্ট দেয়। গত বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) দেওয়া ওই পোস্টের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ শুরু হয়। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে পতাকাবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। আর সচেতন নাগরিকরা বলেন, পাকিস্তান হাইকমিশনের এমন আচরণ তাদের প্রতি সরকারের নমনীয় আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ, যা মোটেই কাম্য ছিল না।

যদিও শনিবার পাকিস্তান হাইকমিশনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পতাকা বিকৃতির ছবিটির বিষয়ে বলা হলে তারা তা সরিয়ে নেয়। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরও তীব্রভাবে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই।

কিন্তু পাকিস্তান হাইকমিশনের এমন ঘটনাগুলো কি পরিকল্পিত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? নাকি নিছক ঘটনা এটি। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে খানিকটা পেছন ফিরে তাকাতে হবে। গত বছরের নভেম্বর মাসের ঘটনা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় ঢাকার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম মাঠে পতাকাবিধি লঙ্ঘন করে পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তারা তা বন্ধ রাখে। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাস ঘটায় আরেক কান্ড। তারা ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি ভিডিও প্রচার শুরু করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে এর প্রতিবাদ জানালে তারা সেটি সরিয়ে নেয়। এরও আগে ২০১৯ সালের দিকে পাকিস্তানের একটি অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পাকিস্তান সরকার কখনো মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় ঘটে। ফলে তারা যখনই পেরেছে তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে তারা বিধিবহির্ভূত ঘটনা ঘটাচ্ছে বারবার। এমনটাই মনে করেন সচেতন নাগরিকরা। তাই এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই বলে মত দেন তারা।

২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বরের ঘটনা। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয় পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানও বাংলাদেশের কূটনীতিককে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করে। ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার এক হোটেলে পাকিস্তানি দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা মাজহার খানকে জঙ্গিদের কাছে জালটাকা হস্তান্তর করার সময় হাতেনাতে ধরেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া ২০০০ সালে পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার ইরফান-উর রাজাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াত নেতারা দন্ডিত হলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফ, এর প্রতিবাদ করে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায়ে নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবও পাস করা হয়। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পাকিস্তান সরকারের এমন আচরণে অবাক হয় সারা বিশ্ব। অন্তরে কপটতা রেখে ফেইসবুকে দুদেশের পতাকা একীভূত করে পতাকা বিকৃতির মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার কোন বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করতে চায় আমাদের জানা নেই!

স্বাধীন বাংলাদেশকে মুখে মুখে মেনে নিলেও স্বাধীনতা লাভের একান্ন বছর পরও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যে সীমাহীন গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চায়নি দেশটির কোনো সরকার। বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুরান ঢাকার শাঁখারীপট্টি, পিলখানাসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘটে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সে রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু এত বছর পরেও একাত্তরে জঘন্যতম গণহত্যার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। বাংলাদেশ যা দাবি করে আসছে বারবার।

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানকে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী দেখা করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান। কিন্তু পাকিস্তান সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এর আগে ২০০৯ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আলী বাসারকে একই আহ্বান জানিয়েছিলেন।

গবেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা আমাদের সঙ্গে কোনো অন্যায় করেনি। করেছে একাত্তরে পাকিস্তানের সরকার ও সামরিক বাহিনী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে যে সরকার ছিল, তাদের উচিত ছিল বাংলাদেশে তারা যে গণহত্যা করেছে, অপরাধ করেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তার পরের সরকারগুলোও একই অবস্থানে থেকেছে। হয়তো রাজনৈতিক কারণে, অথবা তাদের মনোভাবই এটা। তারা যদি ক্ষমা চাইত, ওইসব আচরণ বন্ধ করত, তাহলে সম্পর্ক ভালো হতে পারত। কারণ, এখন তো ওই বিষয় ছাড়া তাদের সঙ্গে আমাদের স্বার্থের তেমন কোনো সংঘাত নেই। আর ওই মনোভাবের কারণেই তারা এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানাভাবে তৎপর।

বাংলাদেশে একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই পাকিস্তানের প্রতি সরকারের নমনীয় আচরণ করা উচিত নয় বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান যখনই পেরেছে তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে তো আমরা আমাদের পাওনা আদায় করতে পারব না। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বনিম্ন কূটনৈতিক সম্পর্কের বেশি কোনো সম্পর্ক রাখার দরকার নেই। তিনি আরও বলেন, ‘এবার পতাকা বিকৃতির পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সাধারণ নমনীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়।’

আমরা মনে করি এটি পাকিস্তান হাইকমিশনের ধৃষ্টতা। তারা এখনো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কটাক্ষ করার চেষ্টা করে। তাই এসব বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও সোচ্চার হবে- এমনটাই কাম্য।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৮ জুলাই ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button