মুক্তিযুদ্ধ

মানুষের মাংস পিঁপড়ার পছন্দ

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন। বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন বিনোদবাড়ি গ্রামে।

তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরের কাকরাইল, তিলকি ব্রিজ, জামালপুর থেকে মুধুপুর রাস্তার ব্রিজ, মেঘনা বাজার, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায়।

তাজউদ্দিনদের পরিবারে ছিল সীমাহীন দারিদ্র্য। ফলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিশুবয়সেই তাকে কাজে নামতে হয়। তখন দুই মাস মুজাহিদ ট্রেনিং নিয়ে গ্রামে কাজ করলেই মিলত ভাল বেতন। অভাবের কারণে তাজউদ্দিন তাই করলেন। পরে ওই ট্রেনিংই কাজে লেগে যায় মুক্তিযুদ্ধে!

মুক্তিযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। রাঙামাটি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন তাজউদ্দিন। একটি গুলি তার ডান হাতের তালু ভেদ করে কনুইয়ের দিকে চলে গিয়ে আটকে যায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার কষ্টের চেয়েও ভয়ার্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল তার চিকিৎসার সময়টা। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে কথাই তুলে ধরেন এই বীর।

তার ভাষায়, ‘মহিষের গাড়িতে কইরা আমারে নেওয়া হয় চাচরি বাজারে। জ্ঞান তহনও ছিল। সারা রাস্তায় হাত দিয়া রক্ত পড়ছে। ওই বাজারেই এক ডাক্তার অপারেশন করে হাতের গুলিডা বের করে। পোড়া মাংস বাইর করতে হাতের ভেতর সাড়ে তিন গজ কাপড় ঢুকায়া দেয়। কী যে কষ্ট পাইছি তহন! বাজারের পাশের চেয়ারম্যান বাড়িতে ওই রাতে থাকি। এ খবর পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে পৌঁছাইয়া দেয় রাজাকাররা। পরের দিন সকালেই আর্মিরা পুরা বাজার ঘিরা ফেলে। ওই ডাক্তাররে তারা গুলি কইরা মারে। চেয়ারম্যানের বউ একটা নৌকায় কইরা গোপনে আমগো মাউচ্চা বিলে রাইখা আসে। গার্ড হিসেবে ছিল এক সহযোদ্ধা।’

তাজউদ্দিন বলতে থাকেন, ‘বৃষ্টি পড়ছিল ওইদিন। ভয়ে বিলের মাঝখানের পালার ভেতর আমগো রাইখা গার্ড চইল্লা যায়। তিন দিন খাওয়া নাই। রক্ত গিয়া শরীর সাদা হইয়া গেছে। শরীরের পচা মাংসের গন্ধে কচুরিপানা থেইকা লাল পিঁপড়া আসে। ভাবছিলাম ওইখানেই মরমু। কোনো রকমে পাড়ের একটা ছোট ঘরে আশ্রয় নিই। ক্ষত তহন পাইকা গেছে। শরীরের গন্ধে নিজেরাই ঠিক থাকতে পারি না। রাতভর পিঁপড়া তাড়াইছি। মানুষের মাংস পিঁপড়ার যে কত পছন্দ এইডা একাত্তরে বুঝছি! পরে সাথীরা আইসা আমারে উদ্ধার করে। হাতের ঘা শুকাইতে প্রায় দেড়শো ইনজেকশন দিতে হইছে শরীরে। একাত্তরে মরতেই তো গেছিলাম। এহন চলছে বোনাস লাইফ!’

পরবর্তী প্রজন্মই এ দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করবে; মনেপ্রাণে এমনটাই বিশ্বাস করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন। প্রজন্মের উদ্দেশে অন্তর থেকে দোয়া করে এ যোদ্ধা বলেন, “তোমরা নিজেদের যোগ্যতা দিয়া দেশটারে আগায়ে নিবা। শুধু নিজের স্বার্থের জন্য লোভ কইরো না। মনে রাখবা, এই দেশটাই তোমার সত্যিকারের পরিচয়।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল; ২৯ জুন ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button