ক্যাটাগরিহীন

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে একাত্তরের পঁচিশ মার্চ

একাত্তরের পঁচিশ মার্চ। মধ্যরাত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইট নামে তারা শুরু করে গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুরান ঢাকার শাঁখারীপট্টি, পিলখানাসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠান তিনি।
কী ঘটেছিল সেই কালরাতে?
তাঁর ভাষায়- ‘পঁচিশ মার্চ রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করবে। শুনেই সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা। ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে চাবি এনে আমরা মেইন অস্ত্রাগার খুলে দিই। থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগজিনভর্তি গুলি নিয়ে দু-তিনশ সদস্য পুলিশ লাইন্সের ব্যারাক, প্রশাসন ভবনের ছাদ, পুকুর পাড়, রোডের পাশে ও মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যায়। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তারা ব্যারিকেড দেয় মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর ও চামেলীবাগের ডন স্কুলের সামনে (বর্তমান ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট)। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেন ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য।
দুটো রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়্যারলেস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়্যারলেসে কোনো মেসেজ আসে কিনা।
রাত তখন ১০টা ৩০। একটা মেসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রোলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন।
বলেন :’চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি, ওভার।’
আমি প্রত্যুত্তরে বলি: ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ, ওভার।’
তখন তিনি বলেন :’চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’
রাত ১১টা ৩০। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালান। প্রথম টার্গেটেই পাকিস্তানি সেনাদের দু’জন মারা যায়। সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিলেন পুলিশ সদস্যরাই।
হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। নানা চিন্তা ভর করে মনে। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারাদেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে- এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।
রাত ১২টা বাজার তখনও তিন-চার মিনিট বাকি। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় বলি:
‘Base for all station of east Pakistan police, very very important massage for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and out.’
এর পর প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থান নিই ৪০-৫০ জন। আমরা পাঁচজনের একটা করে ট্রুপস করি। আমার ট্রুপসে ছিল মনির, গিয়াসউদ্দিন, আবু সামাদ, সালাম প্রমুখ। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। আর্মিরা ভেতরে ঢুকলেই ঠেকাব।
রাত তখন তিনটা হবে। গোলাগুলি চারদিকে। ট্যাঙ্কের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বেরোতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মরে। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। তখন আর টেকার জো নেই। দেখলাম পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। ভোর চারটার পর ৮-১০টি ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়।
আমাদের গুলি তখন শেষ। নিরুপায় হয়ে রাইফেল ফেলে পানির ট্যাঙ্কের নিচে আশ্রয় নিই। ফজরের আজানের পরে পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাইফেলের বাঁট আর হকিস্টিক দিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। ওদের বুটের লাথিতে রক্তে লাল হয়ে জমাট বেঁধে থাকে আমাদের পোশাক।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী কামরুল আমান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতে বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। বাবার চাকরির সুবাধে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা তিনিও দেখেছেন খুব কাছ থেকে।
তার ভাষায়-‘কারফিউ শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই রওনা হলাম ঢাকার দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে সাত-আটজনের গলাকাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না। দেহ তখনও কই মাছের মতো নড়ছিল। যেন জিন্দালাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কবজি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। গণহত্যার খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারীপট্টিতেও। আহারে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পুড়িয়েছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারীপট্টির প্রবেশমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে তার চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!’
পঁচিশ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। হলগুলোতে আক্রমণের ঘটনার কথা তিনি তুলে ধরেন ঠিক এভাবে- ‘ফজলুল হক হলে আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। নাম ‘সূর্য সেন স্কোয়াড’। বন্ধু আনোয়ার হোসেন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি) ছিলেন এর লিডার। আমি, জুলফিকার, তারিক, ফাত্তা, আশরাফ, হাবিবুল্লাহ, আমিনুল হক, ইয়াহিয়াসহ আরও দশ-বারোজন ছিলাম তার সঙ্গে। ও সবসময় বলত- ‘এভাবে ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। একটা সময় যুদ্ধে যেতেই হবে। ওই যুদ্ধ হবে গেরিলা যুদ্ধ। তাই গেরিলার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’
আনোয়ারের কথায় আমরা উজ্জীবিত হতাম। এরপরই শুরু করি মলোটভ ককটেল বানানো। বাহির থেকে কিছু কেমিক্যাল এনে শ’ দুয়েক ককটেল বানিয়েছিলাম অসহযোগের সময়। তিনটা রাইফেলও জোগাড় হয়ে যায় তখন।
পঁচিশ মার্চ সকাল থেকেই হল ছাড়তে থাকে ছাত্ররা। শেষে ছিলাম মাত্র একচল্লিশ জনের মতো। এক দিন আগেই রাইফেল আর ককটেলগুলো লুকিয়ে রাখি। দিন গড়িয়ে রাত আসে। ডাইনিং বন্ধ। তাই রাতের খাবারের জন্য চলে যাই সচিবালয়ের পেছনে, চিটাগাং রেস্টুরেন্টে।
হঠাৎ সাঁজোয়া যানের শব্দ। দেখলাম আর্মির কনভয় যাচ্ছে। অস্ত্র তাক করে চারপাশ দেখছে সেনারা। ওদের চোখেমুখে হিংস্ট্রতার ছাপ। গোটা এলাকা থমথমে। দ্রুত হলে ফিরি। কিন্তু উত্তর গেটের সামনে আসতেই শুরু হয় কামানের গর্জন। গোলাগুলিরও শব্দ হয় অবিরত।
হাউস টিউটর এসে বললেন- ‘তোমরা নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। তবে অবশ্যই হলের বাইরে যেও না।’
তখন হলের ছাদে অবস্থান নিই আমরা। সঙ্গে ছিল তিনটা রাইফেল আর কিছু ককটেল। চার বন্ধু হলের চারটা গম্বুজের নিচে পজিশন নিয়ে থাকি। কে কী দেখছি তা ক্রলিং করে এসে একজন আরেকজনকে বলি। এভাবেই কাটে গোটা রাত।
চারপাশটা দেখতে পাকিস্তানি সেনারা আলোর মতো একটা গুলি ছোড়ে। এর পরই ফায়ার করতে থাকে। রাত দুইটার পর দেখি পুরান ঢাকার দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চারপাশে শুধু গুলি, চিৎকার আর মানুষের কান্নার শব্দ। ফজরের আজান পড়েছে তখন। ভাবলাম, এবার হয়তো গোলাগুলি থেমে যাবে। কিন্তু আজানের সময়ও পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। কেন জানি ওরা ফজলুল হক হলে আসেনি। ফলে দৈবক্রমে বেঁচে যাই আমরা।
ভোরবেলা ছাদ থেকে নেমে গেটের সামনে যেতেই দৌড়ে আসে দারোয়ান। জানায়- শহিদুল হক হলে অ্যাটাক হয়েছে। ছয়জনের লাশও পড়ে আছে। আর্মিরা এদিকেই আসছে। শুনেই যে যার মতো লুকাই। আমি চলে যাই তিনতলায়, ৩৫২ নম্বর রুমের সামনের বারান্দায়। সেখানে বসে রেলিংয়ের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি সবকিছু।
পাকিস্তানি সেনারা এসেই দারোয়ানকে ডাকে। সে বিহারি হলেও বাঙালিদের পক্ষে ছিল। আর্মিদের সে বলে, ‘এই হলে ভালো ছাত্ররা থাকে। তারা কেউ আন্দোলন করে না। ছুটির কারণে সবাই বাড়ি চলে গেছে।’
তার কথায় আর্মিরা প্রথম আশ্বস্ত হয়। কিন্তু হঠাৎ তাদের চোখ পড়ে পতাকার দিকে। ফলে ‘মাদারচোদ’ বলে গালি দিয়ে চড়াও হয় দারোয়ানের ওপর। এরপর পতাকাটি নামিয়ে বুটের তলায় কিছুক্ষণ মাড়িয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। চারদিকে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আর্মিরা অন্যত্র চলে যায়। ফলে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকেই ফিরে আসি আমরা।
পরে হেঁটেই চলে যাই সদরঘাটের দিকে। পথে পথে দেখি লাশ আর রক্ত। নাজিমুদ্দিন রোডে রিকশায় পড়ে থাকতে দেখেছি কয়েকটি লাশ। ঢাকার রাজপথে তখন ছিল পচা লাশের গন্ধ। মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলিমদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পঁচিশ মার্চে।’
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবুর বাড়ি ধানমন্ডির সাত নম্বর রোডের এগার নম্বর প্লটে। ২৫ মার্চ রাতে শহীদ হন তার সিনিয়র বন্ধু পানাউল্লাহ সাহেবের ছেলে খোকন। কীভাবে? তাঁর ভাষায়- ‘ওইদিন সন্ধ্যায় সিরাজ নামে একজন এসে বলে, ‘বাবু, আজ রাতে আর্মি নামব। যেভাবে পারছ ব্যারিকেড দে।’ কলাবাগান লেকের পাশে বড় একটা গাছ ছিল। এলাকার লোকজন নিয়ে ওই গাছ কেটে রাস্তায় ফেলি। মনে তখন অন্যরকম স্পিরিট।
রাত তখন আনুমানিক ১১টা। হঠাৎ গুলির শব্দ। তখন আমরা ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে চিটাগাং হোটেলে। খোকন ভাই উত্তেজিত হয়ে বললেন- ‘ধানমন্ডিতে কে গোলাগুলি করে? বাবু চল তো, শেখ সাহেবরে পাহারা দিমু। কোন শালায় আসে দেহি।’ আমরা বুঝিনি যে পাকিস্তানিরা নাইমা গেছে।’
আমাদের জিপের সামনে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ লাগানো। পথে পাকিস্তানিদের সাঁজোয়া গাড়িগুলো সাইড দেয়। ওরা ভাবছে কোনো আর্মি অফিসারের গাড়ি হবে। দ্রুত কলাবাগানের বসিরউদ্দিন রোডে যাই। ছায়ানটের অফিস ছিল ওখানে। সেখানেই গাড়িটা রাখি।
পান্থপথে ধানমন্ডি লেকেরই একটা ডোবা ছিল তখন। সেটা পার হয়ে ওপারে গিয়ে শেখ সাহেবের বাড়িতে যাব। এমনটাই পরিকল্পনা। রাস্তার পাশে ডোবার আড়ালে লুকিয়ে আমরা। প্রথম খোকন ভাই দৌড়ে রাস্তা পার হন। ওপারে গিয়ে হাতের টর্চটা জ্বালাতেই অজস্র গুলির শব্দ। দেখলাম মাটিতে পড়েই তিনি ছটফট করছেন। এক সময় তার দেহ নিথর হয়ে যায়। আমাদের বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। দ্রুত আর্মিদের দুটো জিপ আসে। তার মুখে ওরা লাইট মেরেই বলে- ‘শালা মর গিয়া’।
কারফিউ উঠলে খোকন ভাইয়ে লাশের খোঁজে বের হই আমরা। ওরা লাশটা সোবহানবাগ মসজিদের বারান্দায় ফেলে রেখেছিল। হাতটায় তখনও টর্চলাইট ধরা। গুলিতে তার আরেক হাত উড়ে গিয়েছিল। চেহারাটা এখনও মনে ভাসে।
পঁচিশ মার্চে নাখালপাড়াতেও ঘটেছিল হত্যাকাণ্ড। সেই ইতিহাস জানান প্রত্যক্ষদর্শী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদউল্লাহ্‌। তাঁর ভাষায়- ‘আগেই খবর ছিল পাকিস্তানি সেনারা কিছু একটা করবে। রুহুল আমিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে কিছু বন্দুক আমরা সংগ্রহ করে রাখি। সন্ধ্যার দিকে গাছ কেটে ব্যারিকেড দিই নাখালপাড়ায়, লুকাসের মোড়ে। রাতে পাকিস্তানি আর্মিদের সাঁজোয়া যান বের হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে। রাতভর শুনি গুলির শব্দ। বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখাও।
ওরা এভাবে মানুষ মারবে, ভাবতেও পারিনি। পাকিস্তানি সেনারা আগেই অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান বসিয়েছিল এখানকার কয়েকটি টিলাতে। শাহিনবাগে ছিল দুটি, প্রধানমস্ত্রীর বর্তমান কার্যালয়ের কাছে একটি ও পুরাতন বিমানবন্দরের ওখানে ছিল একটি। ওরা পুরাতন বিমানবন্দরের কাছে একজনকে গুলি করে মারে। পশ্চিম নাখালপাড়ার আট নম্বর রোডে থাকতেন এক সিইও, নাম মজিবুর রহমান। সেনারা তাকেও হত্যা করে ফেলে রাখে রাস্তায়। রেললাইনের পাশেও মিলিশিয়ারা গুলি করে মারে একজনকে। কারফিউ চলছিল তখন। লাশগুলো নেওয়ারও কেউ নেই। খবর পেয়ে আমি, জামাল, লতিফসহ কয়েকজন তিনটি লাশ ছাত্রলীগের অফিসে এনে রাখি। নাখালপাড়া কবরস্থানের পাশেই ছিল অফিসটি। এর পর বিকেলের দিকে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে মাটি দিই।
গণহত্যায় সহযোগিতা করে পিস কমিটির লোকেরা। নাখালপাড়ায় এর চেয়ারম্যান ছিল মাহবুবুর রহমান গোরহা। সে জামায়াতে ইসলামীরও বড় নেতা ছিল। আর পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর হেডকোয়ার্টারও ছিল নাখালপাড়ায়।
একাত্তরের পঁচিশ মার্চে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল কলঙ্কজনক ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনার সূচনামাত্র। পরবর্তী নয় মাসে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে ত্রিশ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল গণহত্যার সেই বর্বর ইতিহাসকে। এখন পর্যন্ত জঘন্যতম ওই গণহত্যার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের এই সময়ে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ পাকিস্তানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

অলংকরণ ::আনিসুজ্জামান সোহেল

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালে, প্রকাশকাল: ১৯ মার্চ ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button