মুক্তিযুদ্ধ

তিন বীরপ্রতীকের আখ্যান

গৌরব ও বেদনার একাত্তরে বাংলার জমিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন আমাদের পূর্বসূরি। সর্বসংহারী যুদ্ধে তারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। তাদের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার ৪২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে। রাষ্ট্রীয় এ খেতাব নিঃসন্দেহে অকুতোভয় শ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ। বিজয়ের এই দিনে তুলে ধরছি ৩ জন বীরপ্রতীকের অসীম সাহসের আখ্যান, যা নিঃসন্দেহে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ও আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে।

বীরপ্রতীক মো. রুস্তম আলী
[গ্রাম-উত্তর ঘোড়ামারা, উপজেলা-সীতাকুণ্ড, জেলা-চট্টগ্রাম। ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে; পদ এলএসিএম। সার্ভিস নম্বর ৮৩১৮৯। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম এয়ার ফাইটে চট্টগ্রামের ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারি উড়িয়ে দেওয়াসহ এয়ার অ্যাটাক করেন সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকায়।] ‘আমাদের বাড়ি ছিল সমুদ্রের পাড়ে। জ্যোৎস্না রাতে ওখানেই চলত হা-ডু-ডু খেলা। সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতাম। বন্যা, সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস হতো প্রায়ই। চোখের সামনে দুইশ লোককেও মরতে দেখেছি। একবার জলোচ্ছ্বাসে গাছের ওপর থেকে অনেকের লাশ নামিয়েছিলাম। শোকে চোখের পানিও তখন শুকিয়ে গিয়েছিল। জমিজমার অধিকাংশই সমুদ্রের পেটে। একটুও ডেভেলপ করেনি পাকিস্তান সরকার। ওরা তো চাইত আমরা সমুদ্রের জলে ভেসে যাই। এখানে উন্নয়ন যা হয়েছে তার সবই স্বাধীন বাংলাদেশে।’ পূবর্ পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরেন বীরপ্রতীক মো. রুস্তম আলী।
তিনি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। গ্রামে একটা মারামারির ঘটনা ঘটে। সেখানে না থাকলেও সুযোগ বুঝে মুসলিম লীগের নেতারা তার নাম দিয়ে দেয়। ফলে ছাত্রাবস্থাতেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় রুস্তমকে। ওই মামলাটি চলেছিল তিন বছর। এ কারণে নির্ধারিত বছরে এসএসসি পরীক্ষাও দিতে পারেননি। এসএসসির পরই রুস্তম আলী যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। বেসিক ট্রেনিং হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, কোয়েটা ট্রেনিং সেন্টারে। এর পর পোস্টিং ছিল সারগোদা বিমানঘাঁটির এলএসসিতে। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা হয় ১৯৭০ সালে। এ কারণে দুই মাসের ছুটি নিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাড়ি ফেরেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়ার দলের সঙ্গে কুমিরায় প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন রুস্তম আলী। পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তারা। অতঃপর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে মিরসরাইয়ের গোরলগঞ্জ হয়ে চলে যান ভারতের হরিণা ক্যাম্পে। ডিফেন্সের লোক শুনতেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। প্রথমে ওখানে একটি গ্রুপকে ট্রেনিং এবং বর্ডারে অপারেশন করেন তিনি।
এর পর কী করলেন? জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করা হবে। আমি তখনও আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্পে। সঙ্গে খন্দকার আর সার্জেন্ট মনির। ক্যাম্প থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ডিমাপুর; আসামের নাগাল্যান্ডে। চারদিকে পাহাড়। মাঝখানে একটা ব্রিটিশ আমলের রানওয়ে। সেখানেই কয়েক মাস চলে ট্রেনিং। একটা এলইউট আর ছিল একটা অর্টার। এলইউট হলো হেলিকপ্টার। অর্টার হচ্ছে বিমান। একটি বিমানে রকেট, বোম্বিং, গানারিং- এই তিনটা সেট করা থাকত। আমি ছিলাম এয়ার গানার। এলইউট ও অর্টার দুটিতেই কাজ করেছি। সবাই সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। গ্রুপটির নাম ছিল কিলোফ্লাইট। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন সুলতান মাহমুদ।’
প্রথম এয়ার ফাইটের কথা শুনি এই বীরপ্রতীকের জবানিতে। তার ভাষায়- “ইন্ডিয়ান বর্ডারে ছিল কৈলাশহর এয়ারপোর্ট। আমাদের নিয়ে আসা হয় সেখানে। এক রাতের পরই বলা হলো অপারেশনের কথা। গোপনীয়তা রক্ষায় কোথায় অপারেশন করতে হবে, সেটি জানানো হলো না। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। সবাই প্রস্তুত। বিমান যুদ্ধ ওটাই ছিল প্রথম। বিমান বা অর্টারে ফ্লাই করার আগে জানানো হয়, চট্টগ্রাম অ্যাটাক করতে হবে। আমরা চারজন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম, এয়ার গানার আমি আর সার্জেন্ট হক বোম ড্রপিংয়ে।
রাত তখন ১০টা। কৈলাশহর থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার দিয়ে আমাদের বিমানটি উড়ে যায়, যাতে পাকিস্তানি রাডারে তা ক্যাচ না করে। চট্টগ্রাম দিয়ে ঢুকতেই সীতাকুণ্ড, পরে পাহাড়। অতঃপর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করি, একেবারে নিচ দিয়ে। চাঁদের আলো ছিল। নিচে সব দেখা যাচ্ছে। আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়েই আসি চট্টগ্রাম, ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারিতে। ওটা ধ্বংস করাই ছিল টার্গেট।
প্রথম বারেই রকেট, মেশিনগান, বোম একসঙ্গে শুরু করলাম। আমি মেশিনগানের গুলি ও বোম ড্রপিং করেন সার্জেন্ট হক। প্রথম অ্যাটাকেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে যায়। বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। পাইলট শামসুল আলম বলেন- ‘শুড আই টেক অ্যানাদার অ্যাটেমপ্ট?’ আমি বলি- ‘নো স্যার, উই আর সাকসেসফুল।’
পাকিস্তানিরা মনে করেছিল এগুলো, তাদের বিমান। ধ্বংস আর আগুন দেখে ওরা পাগল হয়ে যায়। নেভালের দুর্গ তখন চট্টগ্রামে। নেভি আর আর্মিরা অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্‌ট গান দিয়ে গুলি করতে থাকে। লাগলেই শেষ হয়ে যেতাম। একাত্তরে মরতে গিয়েও আমরা ফিরে এসেছিলাম। পরে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের কুম্বিরগ্রামে ল্যান্ড করি। আমাদের ওই বিমানটি সত্যিকারের যুদ্ধবিমান ছিল না। ফিরে গেলে ভারতীয়রা বলত- ‘এগুলো দিয়া তোরা কেমনে যুদ্ধ করলি!’ তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়।”
শত বাধা পেরিয়ে দেশটা একদিন উন্নত বাংলাদেশ হবে- এমনটাই বিশ্বাস বীরপ্রতীক রুস্তম আলীর। মনেপ্রাণে তার বিশ্বাস, লাখো শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশ কখনও পথ হারাবে না। এই যোদ্ধা তাই স্বপ্নের বীজ বোনেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, ‘দেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু- ইতিহাসে এই তিন বিষয়ে তোমরা আপস করো না। দেশের বীরত্বের ইতিহাসটি জেনে নিও। দেশটাকে ভালোবেসো। মনে রেখো, নিজের কাজটা সততার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম।’
বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী
[গ্রাম-দিয়ার ধানগড়া, উপজেলা-সিরাজগঞ্জ সদর, জেলা-সিরাজগঞ্জ। স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং ছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা ক্যাম্পে নেন বিশেষ ট্রেনিং। হাজরাবাড়ীর চেরাভাঙ্গা ব্রিজ, ভেংগুলা, ভূঞাপুর থানা, সিংগুরিয়া, সোহাগপাড়া ব্রিজ, মির্জাপুর থানা, নাগরপুরসহ ২১টি অপরেশনে অংশ নেন।] ১৯৭১-এ এই মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করেই এগিয়ে যেতেন। ভীষণ সাহসী আর একরোখা ছিলেন। এমন আচরণের ব্যক্তিকে টাঙ্গাইলের ভাষায় বলে ‘পাহাইড়া’। সহযোদ্ধাদের এমন ডাকই এক সময় রূপ নেয় ‘পাহাড়ী’তে। এভাবে এসএম আনোয়ার হোসেন একাত্তরে হয়ে যান আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী।
১৯৬৬ সালে একবার শেখ মুজিব যান সিরাজগঞ্জ। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে প্রথম দেখেন নেতাকে। অতঃপর ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে যুক্ত থাকেন পাহাড়ী। কণ্ঠ আকাশে তুলে মিছিলে স্লোগান দেন- ‘জেলের তালা ভাঙব/ শেখ মুজিবকে আনব’। ‘আমি কে, তুমি কে?/ বাঙালি বাঙালি’।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন-‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…।’ বঙ্গবন্ধুর এমন নির্দেশনায় উদ্দীপ্ত হন পাহাড়ীরা। এরপরই তারা ডামি রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে। ল্যান্স নায়েক লুৎফর রহমান অরুণ ও রবিউল গেরিলা ট্রেনিং করান।
পাকিস্তানি সেনারা তখন জেলাগুলো দখলে নিচ্ছে। খবর আসে- তারা আরিচা-নগরবাড়ী হয়ে সিরাজগঞ্জে ঢুকবে। তাদের ঠেকানোর প্রস্তুতি নেন পাহাড়ীরা। কীভাবে? সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে-
‘শাহ্‌জাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী ঘাটে পজিশন নিই আমরা। নেতৃত্বে ছিলেন লতিফ মির্জা। অস্ত্র ছিল থানা থেকে সংগ্রহ করা ৮টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এক দিন পরই অস্ত্রসহ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় বগুড়া থেকে আসা পাঁচজন বাঙালি ইপিআর সদস্য। এলএমজি ও এসএমজি চালানোটা তখন তারাই শিখিয়ে দেন।
২৩ এপ্রিল ১৯৭১, সকাল বেলা। পাকিস্তানি সেনারা দুটি জিপে এসে নদীর ওপারে পজিশন নেয়। শুরু হয় গোলাগুলি। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাদের আমরা বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারি না। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তারা সিরাজগঞ্জ দখলে নিয়েই গণহত্যাসহ ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে।’
বন্ধু আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে পাহাড়ী চলে যান টাঙ্গাইলের গোপালপুরে। সেখানেই যোগ দেন কাদেরিয়া বাহিনীর হুমায়ুন কোম্পানিতে। পরে তাকে ওই কোম্পানির টুআইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশের গুলি এই বীরের বাম গালের মাংস ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। এখনও আয়নার সামনে দাঁড়ালে মুখের ক্ষতস্থানে চোখ পড়ে। তখন তার একাত্তরটা মনে পড়ে যায়।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে? এই সূর্যসন্তান বলেন- “পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল নাগরপুর থানায়। তালগাছ কেটে তারা থানার চারপাশে দুর্ভেদ্য বাংকার তৈরি করে রাখে। সেটিই দখলে নিতে হবে। আমরা ছিলাম নাগরপুরের লাউহাটি গ্রামের এক স্কুুলে। দশটা কোম্পানির সহযোদ্ধারা সঙ্গে ছিল। কথা ছিল তিনদিক থেকে আক্রমণের। পশ্চিম দিকটা থাকবে খোলা। সে পথে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে চাইলে আমাদের কোম্পানি তাদের জীবিত ধরবে।

৩০ নভেম্বর ১৯৭১। সকালের দিকে পজিশন নিলাম। আমাদের অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। দুটি থ্রি ইঞ্চি মর্টার ছুড়ে তিনি অপারেশন শুরু করেন। গোলাগুলি চলছে। আমরা ওঁৎ পেতে আছি। হঠাৎ অসাবধানতাবশত সহযোদ্ধা নান্নুর এলএমজি থেকে মিস ফায়ার হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। ওরা আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। আমরাও পাল্টা জবাব দিই।
বিকেল তখন ৩টা। আরেকটি দল নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিলেন কমান্ডার সবুর খান। তিনি আমার কাছে চিরকুট পাঠালেন, যাতে গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল নিয়ে শত্রুর বাঙ্কার ভাঙতে তাকে সহযোগিতা করি। আমি দ্রুত হুমায়ুন বাঙালকে সঙ্গে নিয়ে সবুর খানের দিকে সরে আসি। পজিশন নিই নাগরপুর থানার সম্মুখে, লৌহজং নদীর এপাড়ে। দেখলাম পাকিস্তানি সেনারা একটি বাঙ্কার থেকে চায়নিজ এলএমজির গুলি ছুড়ছে। বাঙ্কারটা টার্গেট করে জিরো অ্যাঙ্গেলে ফায়ার করতেই গ্রেনেড গিয়ে পড়ে তার ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে সেখানকার সেনারা। আমরা তখন জয় বাংলা স্লোগান তুলি। এর পর টার্গেট করি আরেকটি বাঙ্কার।
ওদের দৃষ্টি যেন আমাদের দিকে না পড়ে সে কারণে সবুর খান অন্যদিকে ফায়ার দিচ্ছিলেন। হুমায়ুন বাঙাল গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেলটির বাঁট ধরে রেখেছেন। আমি হাঁটু গেড়ে পজিশনে। ট্রিগারে চাপ দেব, অমনি আমার দিকে চোখ পড়ে বাঙ্কারের এলএমজি ম্যানের। সে দ্রুত ব্রাশের ব্যারেলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। অমনি শত শত গুলি আসে। একটি গুলি আমার বাম গাল ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। আমি ছিটকে পড়েই জ্ঞান হারাই। খানিক পরে চোখ মেলে দেখি, মাথাটা সবুর খানের কোলে। অনুভব করলাম, চোয়ালের হাড় রক্তাক্ত। দাঁত বেরিয়ে গেছে। গরম রক্ত গলার ভেতর গিয়ে গলগল শব্দ হচ্ছে। কে যেন বলছে- ‘পাহাড়ী মরে গেছে।’ বহু কষ্টে শুধু বললাম- ‘মরি নাই’।
ব্যারিস্টার শওকত আলীর কাচারিবাড়িতে চিকিৎসা চলে আমার। ডাক্তার শাহজাদা মুখে ও গলায় সেলাই করে দেন। এক পর্যায়ে মুখে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। কী যে কষ্ট ছিল তখন! শরীরের গন্ধ নিজের কাছেই অসহ্য লাগত! পরে কুমুদিনী হাসাপাতালে নরওয়ের ডাক্তাররা মুখে ও গলায় চারবার অপারেশন করে আমাকে সুস্থ করে তোলেন।”
বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী মনে করেন, পরবর্তী প্রজন্ম অনেক মেধাবী। সারা পৃথিবীতে তারাই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাই চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন- ‘তোমরা এ দেশটাকে ভালবেসো। দেশের স্বার্থে এক থেকো। সবাই মিলে জঙ্গিবাদকে রুখে দিও। মনে রেখো- জয় বাংলার এ দেশে জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসী যাবে ভেসে।’
বীরপ্রতীক মোহাম্মদ আজাদ আলী
[গ্রাম-কুশাবাড়িয়া, উপজেলা-বাঘা, জেলা-রাজশাহী। এক মাসের ট্রেনিং নেন ভারতের বিহারের চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। ৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টরের অধীনে অপারেশন করেন বাউসার হাট, বাঘা মসজিদ, ডাকরার হাট, আড়ানী রেলওয়ে ব্রিজ, নাবিরপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।]

“রাজশাহীতে মুসলিম লীগের শক্ত অবস্থান ছিল তখন। পাকিস্তান থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য সব ওদের হাতে থাকবে। তাই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল ওরা। আওয়ামী লীগ জিতলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এর পর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ওই ভাষণ আমরা শুনি রেডিওতে। তিনি বললেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখনই বুঝে যাই- স্ব্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ অনিবার্য।” যুদ্ধদিনের কথা এভাবেই শুরু করেন বীরপ্রতীক মোহাম্মদ আজাদ আলী।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের পর গ্রামে আবদুস সাত্তার মাস্টার, সোলেমানসহ অনেককে নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে মিছিল ও মশালের দায়িত্বটা ছিল আজাদের ওপর। অতঃপর বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্রেনিং করেন তারা। ট্রেনিং করান স্থানীয় আনসার সদস্য শমসের আলী ও মহসীন। ওই ট্রেনিংই তাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়।
২৫ মাচর্, ১৯৭১। সারাদেশে পাকিস্তানি সেনারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। গোপালপুর সুগার মিলে ক্যাম্প বসায় ওরা। মে মাসের ৬ বা ৭ তারিখের ঘটনা। সুগার মিল থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে রাজশাহীর দিকে যাচ্ছিল সেনাদের একটি ব্যাটালিয়ন। কয়েক সেনা দলছুট হয়ে পানি খেতে গ্রামে ঢুকতেই আজাদরা আক্রমণ করে। এভাবে আড়ানী ও গোচর গ্রামেও সাত-আট সেনাকে হত্যা করে গ্রামবাসী। কিন্তু লাঠি আর কোচ দিয়ে তো আর্মিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন ট্রেনিংয়ে যাওয়ার।
আজাদ আলীর ভাষায়- ‘কুষ্টিয়া হয়ে চলে যাই ভারতের জলঙ্গিতে। সেখানে কয়েকদিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহারের চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। ট্রেনিং শেষে আসি মুর্শিদাবাদ। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে সেখানে ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের চার নম্বর লালগোলা সাব-সেক্টর। সেখানে ১১ জনকে সঙ্গে দিয়ে তিনি ক্যাপ্টেন রশিদের কাছে যেতে বললেন। তিনি ছিলেন রাজশাহীর পূর্বাঞ্চল আর পাবনার দায়িত্বে। তার নির্দেশেই খাজুরার থাক নামক একটি পরিত্যক্ত বিওপিতে অবস্থান নিই আমরা। নৌকাযোগে দেশের ভেতরে ঢুকে অপারেশন করেই ফিরে আসতাম। পরে বন্যা হওয়ায় চলে যাই চৌদ্দবাইসা নামক মুক্তাঞ্চলে।’
এক অপারেশনে মাইনের আঘাতে উড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর বাম হাতের কবজির নিচের অংশ। কীভাবে? শুনি তার জবানিতে-
“২১ নভেম্বর ১৯৭১। বিঘা থেকে আসি নাবিরপাড়ায়। ওই পথেই রাজশাহী টু আবদুলপুর আর্মির একটি ট্রেন টহল দিত। ওই ট্রেন ডেমুনেশন করতে হবে। সঙ্গে ছিল ৬টি অ্যান্টিট্যাঙ্ক মাইন। রেললাইনে মাইন সেটের কিছু নিয়ম ও পরিমাপ আছে। একটা ইঞ্জিনের নিচে যেন একটা মাইন বিস্ম্ফোরিত হয়, এভাবে ক্যালকুলেশন করে কডেক্স দিয়ে মাইন সেট করে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন ট্রেনটি আসেনি। পরদিন নাবিরপাড়ায় আখ ক্ষেতের পাশে রেললাইনের মাটি খুঁড়ে স্লিপারের নিচে মাইন সেট করি আমরা। কডেক্স বসানো, ডেটোনেটর সেট, ৩০০ গজ তারও লেআউট করা হয়েছে। শেষে দেখলাম, হলুদ রঙের ওই কডেক্সগুলো ক্যামুফ্লাজ করা হয়নি। লাইট পড়লেই সেগুলো জ্বলজ্বল করে।
রাত তখন ১০টা ৩০। হঠাৎ নাটোর থেকে চলে আসে একটি ট্রেন। ট্রেনের সার্চলাইটের মধ্যে পড়ে যাই আমরা। দ্রুত হাইড আউট হয়ে সিদ্ধান্ত নিই বিস্ম্ফোরণ ঘটানোর। সুইচটা ডেটোনেটরের সঙ্গে লাগিয়ে সব ঠিক করে নিই। কিন্তু তখনই খবর আসে- টার্গেট ট্রেন এটি নয়। এই সুযোগে আমরা তারগুলো ক্যামুফ্লাজের কাজ শুরু করি।
রাজশাহী থেকে আবদুলপুরগামী আর্মি ট্রেনটি আসার আগেই আমি কানেকশন দিতে অগ্রসর হই। সঙ্গে ছিল মাহবুবুল গনি বাবলু। সে বলল, ‘রিলিজ সুইচের ওয়েট থেকে একটা ইট কমিয়ে দিই।’ কিন্তু আমি যখন কানেকশনটা দিই, ঠিক তখনই সে একটা ইট কমিয়ে দিল। ফলে কিছু বোঝার আগেই ৬টা মাইন একত্রে বিস্ম্ফোরিত হয়ে যায়।
দেখলাম, রেললাইনটা পুকুর হয়ে গেছে। মাথার ওপর দিয়ে স্লিপার ও রেললাইনের পাতগুলো শোঁ-শোঁ করে উড়ে যাচ্ছে। সুইচটা ছিল রেললাইন থেকে ৪ ফুট নিচে। সেখানে বসে ছিলাম বলেই আজও বেঁচে আছি। বিস্ম্ফোরণের শব্দ পেয়ে নাবিরপাড়া স্কুল থেকে সহযোদ্ধারা দৌড়ে চলে আসে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বাম হাত কবজির নিচ থেকে নেই!
সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সহযোদ্ধারা একটা কাঠের তক্তায় শুইয়ে বাঁশে দড়ি বেঁধে আমাকে নিয়ে যায় বাঘাতে। সেখানে লাল মোহাম্মদ নামে এক চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। পরে চিকিৎসা হয় বহরমপুর হাসপাতালে। ওইদিন ট্রেন ওড়াতে না পারলেও রেললাইন উড়ে গিয়েছিল। ফলে টার্গেট ট্রেনটি প্রচণ্ড গতিতে এসে গর্তে পড়ে যায়। এতে পাকিস্তানি ১৬ জন সেনা মারা গিয়েছিল।”
এই বীর আরও বলেন- ‘চেয়েছিলাম স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মানচিত্র হবে এবং দেশের মানুষ দু’মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। এখন সেটা পেয়েছি। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। বিশ্বে আজ মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা জাতি আমরা- এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’
বীরপ্রতীক মোহাম্মদ আজাদ আলী মনে করেন, পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশ একদিন উন্নত হবে। তাই তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে তিনি শুধু বললেন- ‘তোমরা
কখনও দেশটাকে খাটো করে দেখো না। মায়ের মতোই ভালোবাসবে মাতৃভূমিকে। তাহলে এ দেশপ্রেমই তোমার জীবন পূর্ণ করে দেবে।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকাল-এর কালের খেয়ায়, প্রকাশকাল: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button