মুক্তিযুদ্ধ

কুষ্টিয়ায় রিন্টুদের মুক্তিযুদ্ধ

বিজয়ের গৌরবগাথা

ছোটবেলা থেকেই নাটক করতাম। প্রথম নাটক করি ডাকাত চরিত্রে। দুষ্ট ছিলাম বলে সবাই জোর করে চরিত্রটি দেয়। পূর্ব মজমপুর পূর্বাচল ক্লাবের পক্ষ থেকে নাটকটির আয়োজন করা হয়। তখন গ্রামে গ্রামে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড হতো। বিভিন্ন জায়গায় নাটকের গ্রুপ ছিল। ফলে শীতজুড়ে নাটক আয়োজনের প্রতিযোগিতা চলত। আগেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে চৌকি চেয়ে নিয়ে আসতাম। সেগুলো দিয়ে বানানো হতো নাটকের স্টেইজ। মা-বোনদের কাছ থেকে কাপড় এনে তা দিয়ে সাজাতাম। একটা উদ্যম ছিল তখন। পাশা ভাই নাটক লিখতেন, আমরা সেটা করতাম।

ওই সময় নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ভেতরও মিছিল করতে হতো। ছাপানো পোস্টার ছিল না তখন। আক্কাস ভাই আসতেন, এক বান্ডিল কাগজ হাতে নিয়ে। একটা চিরকুট দিয়ে বলতেন, এই স্লোগানগুলো লিখতে হবে। নিজেরা এক আনা দুই আনা দিয়ে কালি কিনে এনে পোস্টার লিখতাম। খেজুর গাছের ডাল কেটে, আগা চেঁছে ব্রাশ বানিয়ে সেটা দিয়ে পোস্টার লিখতাম। কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের বারান্দাতে রাত জেগে পোস্টার লিখতে হতো। সেগুলো শুকালে আঠা দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিতাম।

এখন তো সেই দিন নাই ভাই। কয়েকদিন আগে পরিমল থিয়েটারের নিচে চেয়ার নিয়ে বসে আছি। কয়েকজন যুবক একটা মিছিলে যাচ্ছে। তারা বলাবলি করছে, মিছিলে তো যাব কিন্তু কত করে পিছ (?)। মানে নেতাদের পেছনে যারা থাকবেন তাদের মাথাপ্রতি কত টাকা দেওয়া হবে? এটা আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না!

শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু। কুষ্টিয়া পরিমল থিয়েটারের সভাপতি তিনি। এক সকালে ওই থিয়েটারের কার্যালয়ে বসেই কথা হয় একাত্তরের নানা প্রসঙ্গে।

তার বাবা আরিফ উল্লাহ্ ও মা হালিমা বেগম। বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের থানা পাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।

কুষ্টিয়াতে আর্মি এলে আপনারা কী করলেন?

‘বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে বন্দুক, গুলি আর কার্তুজ কালেকশন করতে থাকি। বর্ডার থেকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে অস্ত্র নিয়ে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা চলে আসেন কুষ্টিয়াতে। তাদের রাখা হয় মিরপুরের নওপাড়া নামক গ্রামে। তাদের নিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন নেতারা। ৩০ মার্চ ভোর রাত থেকে এ হামলা শুরু হয়। আর্মিদের ক্যাম্প ছিল ছোট ওয়্যারলেস, কুষ্টিয়া সদর থানা, পুলিশ লাইনস ও জেলা স্কুলে। ১ এপ্রিল আমরা কুষ্টিয়াকে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিই। কিন্তু ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মিরা গানবোট নিয়ে পদ্মা পার হয়ে ঢুকে পড়ে কুষ্টিয়াতে। তখন নেতারা বললেন, তোমরা যে যার মতো ইন্ডিয়াতে চলে যাও।’

ভারতের শিকারপুর যান রিন্টুরা। সেখানে গিয়ে নেতাদের খোঁজ করেন। তার ভাষায় ‘অনেকে বলেন একাত্তরে আওয়ামী লীগ নেতারা ইন্ডিয়ায় গিয়ে বসে ছিলেন। নেতারা ওখানে না গেলে আমরা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, হাতিয়ার কীভাবে আসত, প্রশিক্ষণ কোথা থেকে নিতাম। এই যোগাযোগটা তাহলে কে রাখত। এটা তো এমন না যে কেউ একজন বাঁশি ফুঁ দিল আর সব হয়ে গেল। নেতাদের উদ্যোগে করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্প চালু করা হয়। সেখান থেকেই ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে। ওখানেই পঁয়তাল্লিশ দিন ট্রেনিং করি। এফএফ নম্বর ছিল ৪৫৪৪।

একাত্তরে বাঙালিদের প্রতি ভারতীয় জনগণের আন্তরিকতার কথা একটি বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

‘আমরা তখন করিমপুরে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। ভিজে যাওয়ায় ঠান্ডায় কাঁপছি। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা শেড। তার নিচে দাঁড়াই। পাশেই বড় একটি মন্দির। পূজা শেষে এক ঠাকুর বের হয়ে আসছেন। মন্দিরে তালা দিয়ে বের হচ্ছেন তিনি। আমাদের ওভাবে ভিজতে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। এরপর তিনি বললেন ‘আহা! অতিথি নারায়ণ এখানে জলে ভিজবে আর দেবতা মন্দিরে আরামে থাকবেন, তাতো হতে পারে না।’ তিনি দৌড়ে চলে গেলেন অরবিন্দ বাবুর কাছে। মন্দির কমিটিরও সভাপতি তিনি। তার অনুমতি নিয়ে মন্দির খুলে দিয়ে বললেন, ‘বাবা তোমরা এখানে থাকো।’ আমরা দুই রাত ওখানে থাকলাম। দেখেন মানুষের মানবতার উদাহরণ এমনই।’

আট নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধীনে শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু যুদ্ধ করেন মিরপুর, ভেড়ামারা, বটতলী, ধর্মদহসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায়। একবার ধর্মদহে পাকিস্তানি সেনাদের শেলের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় তার দুই পায়ের হাঁটুর নিচে ও ডান হাতের আঙুলগুলোতে। করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে দিন দশেক চিকিৎসার পর তিনি আবার ফেরেন রণাঙ্গনে। ৮ ডিসেম্বর মিরপুর থানা দখল করে কুষ্টিয়া সুগারমিলের পেছন দিয়ে শহরে ঢোকার চেষ্টা করেন তারা। ১০ ডিসেম্বর প্রচ- যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধেও সরাসরি অংশ নেন তিনি। ওই রাতেই পাকিস্তানি আর্মিরা কুষ্টিয়া থেকে পালাতে থাকে। ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায়।’

সাতই মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস বলে মনে করেন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষায়, “বঙ্গবন্ধু তো ওইদিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি….. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ…।’ এটাই ছিল স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা। তিনি তো জানতেন তাকে মেরে ফেলা হবে। যে কারণে তিনি নির্দেশটা আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই ভাষণের পরই সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাই সাতই মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা উচিত ছিল।”

বঙ্গবন্ধুকে জানলে বাংলাদেশকে জানা হবে বলে মনে করেন এই বীর। আরও বলেন ‘আমি বাঙালি এটা তো আমাদের কাছে থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের বারবার মুসলিম বানানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমি তো বলি আমরা মুসলিম। ধর্ম ইসলাম। কিন্তু প্রথমে আমি বাঙালি।’

প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো ‘তোমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখো। ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস জেনে নিয়ো। সবাই মিলে দেশের জন্য কাজ করো। তোমাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা রইল।’

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু এখন প্রয়াত। তার সঙ্গে এই আলাপচারিতার কিছুদিন পর, গত ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কিন্তু একাত্তরের বীরদের মৃত্যু নেই। এই বীরের বলা সব কথাই ইতিহাস হয়ে থাকবে। যা ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button