আদিবাসী

‘হামনি ঘার আইজ লবান’

হালজায় যাওয়ার রাস্তাটি যেন বদলে গেছে। বহবলদিঘীর পাকা রাস্তা থেকে পশ্চিমমুখো মেঠোপথে যেতে হয় হালজায় গ্রামে। তুতগাছের ছায়াঘেরা রাস্তাটি খানিকটা আঁকাবাঁকা। দুদিকে ধানক্ষেত। ক্ষেতের আইল ধরে ঝাঁকড়া চুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি লিচুগাছ। ধানক্ষেতে লিচুগাছ, নাকি লিচু বাগানে ধান চাষ- এ নিয়ে নানান চিন্তা ঘুরপাক খায়। মেঠোপথে মাটির দেখা নেই। দু’পাশের ধান ক্ষেতেও নেই কোনো সবুজ। চলতি পথে ধানের খড়ে বারে বারেই জড়িয়ে যাচ্ছিল পা দুটো। চারপাশে সিদ্ধ ধানের গন্ধ। প্রতি অগ্রহায়ণে দিনাজপুরের হালজায় গ্রামের রূপটি এভাবেই পাল্টে যায়।
খড়ে ঢাকা রাস্তায় খানিক এগোতেই ছোট্ট একটি পাড়ার দেখা মিলে। ছন আর মাটির আলিঙ্গনের ছোট ছোট খুপরি ঘর পাড়াটিতে। গায়ে গায়ে লাগানো ঘরগুলোর ঢং দেখেই মনে হবে এটি কোনো বাঙালি পাড়া নয়। সঙ্গে আসা স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক এমএ কুদ্দুস জানালেন এটি সেই কড়াপাড়া। বাংলাদেশে টিকে থাকা কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের ১৬টি পরিবারের বাস এখানেই।
ফসল কাটার সময়টাতে কড়া পাড়ায় কোনো আদিবাসীর দেখা মেলাই দায়। কিন্তু তেমনটি ঘটল না আজ। গোটা পাড়ার কেউই কাজে যায়নি। কী কারণ? গোত্রের মাহাতো বা প্রধান জগেন বলেন, ‘হামনি ঘার আইজ লবান’।
লবান মানে নবান্ন উৎসব। নতুন ধান ঘরে তোলার দিন। সবাই অপেক্ষা করছিল কৃষ্ণ কড়া আর থোপাল কড়ার জন্য। উপোস অবস্থায় ভোরে তারা গেছে নিজের জমির ধান কেটে আনতে। কৃষ্ণ আর থোপাল ছাড়া এই পাড়ার অন্যদের নিজের জমি নেই। মাহাতো জানালো এক সময় কড়াদের সবার নিজের জমি ছিল। প্রতি অগ্রহায়ণে তাদের নিজের গোলায় উঠত ধান। কিন্ত দিনে দিনে পাল্টে যায় সবকিছু। পূর্ব পুরুষের জমিগুলোও আজ চলে গেছে স্থানীয় বাঙালিদের দখলে। ফলে কড়াদের অধিকাংশই আজ দিনমজুর।
সাংবাদিক কুদ্দুস জানালেন পাইট বা মজুর হিসেবে কড়াসহ এ অঞ্চলের আদিবাসীদের বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে ধানকাটা কিংবা ধান লাগানোর সময়টাতে আদিবাসীদের কদর খানিকটা বেড়ে যায়। সততা আর পরিশ্রমই আদিবাসীদের পুঁজি। কাজে ফাঁকি দেয়া আদিবাসীদের কাছে পাপের সমতুল্য। তাই সঠিক সময়ের মধ্যে ক্ষেতের ধান গোলায় তুলতে বাঙালিদের নির্ভর করতে হয় আদিবাসী পাইটের ওপর।
কড়াদের লবান দেখতে আমরাও আগ্রহী হই। সবার সঙ্গে কৃষ্ণ ও থোপালের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণি। মাহাতো জগেন জানালেন প্রতি অগ্রহায়ণে নিয়ম মেনে কড়াদের প্রত্যেক পরিবারকে পৃথকভাবে পালন করতে হয় ‘লবান’ অনুষ্ঠানটি। এক সময় এরা লবান পালন করত ধুমধামের সঙ্গে। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে আজ তাদের উৎসবগুলোতেও পড়েছে ভাটার টান। কথায় কথায় আমাদের আসরে আসে গোত্রের এক বৃদ্ধা। নাম সেড়তি কড়া। সাংবাদিক কুদ্দুস তার পরিচিত। মুচকি হেসে তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘তোহনি কুরাং কে হে’ (তুমি কেমন আছ)। কুদ্দুসও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। সেড়তি জানালো কড়াদের লবানের আচারগুলো। লবানে যে আরোয়া ধান (নতুন ধান) কাটতে যাবে তাকে থাকতে হয় উপোস। উপোস অবস্থায় সে মাঠ থেকে কেটে আনে এক গোছা পাকা ধান। ধান নিয়ে সে বাড়িতে ঢোকার পূর্বেই বাড়ির নারীরা তাকে প্রণাম করে উলুধ্বনি দিয়ে তার পা ধুয়ে  দেয়। অতঃপর দুর্বাঘাস, প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে তাকে বরণ করে নেয় বাড়ির ভেতরে। এদের বিশ্বাস এভাবে ফসলরূপী দেবী লক্ষ্মীকে তারা বরণ করে। অতঃপর ধান থেকে চাল বের করে, ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির তুলসী দেবীকে ভক্তি দিয়ে সেখানে একটি মুরগি বলি দেয় কড়ারা। কড়া ভাষায় এটি ‘পিড়া ঘার’। পরে বলি দেয়া মুরগির মাংসের সঙ্গে নতুন চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে উপোসকারী উপোস ভাঙে। তাছাড়া কড়ারা কিছু চাল বেটে গোটা বাড়িতে ছিটিয়ে দেয়। এদের বিশ্বাস এতে সারা বছরই খাদ্যের অভাব হবে না।
কিন্তু কেন পালন করতে হয় লবান? এ নিয়ে কড়াদের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। সেড়তির জবানিতে শুনি কাহিনীটি। কাহিনীটি :

    কড়া সম্প্রদায়ের সুনিয়া কড়া
কড়া সম্প্রদায়ের সুনিয়া কড়া

‘এক গ্রামে ছিল উচ্চবংশীয় দুই ভাই। তাদের মধ্যে ছিল বেজায় ভাব। বড় ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত ছোট ভাই। ভাইয়ের নির্দেশে ছোট ভাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ে ঠিক হয় পাশের গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের নাম লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আছে একটি শর্ত। মেয়ের বাবা জানালেন শর্তটি। মেয়ে লক্ষ্মী প্রতি অগ্রহায়ণে পালন করে বিশেষ এক ব্রত। বিয়ের পরও কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না ব্রতটির। শর্ত মেনে ধুমধামের সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়ে হয় ছোট ভাইটির সঙ্গে।
বিয়ের পর আসে প্রথম অগ্রহায়ণ। শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মীর ব্রত পালনের সময়। ঐদিন খুব ভোরে সে ঘুম থেকে উঠে গ্রামের রাস্তায় হেঁটে যেতে থাকে। লক্ষ্মী দেখে গ্রামের অধিকাংশ লোক তখনও নিদ্রিত। তাদের ঘরবাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। বাড়িঘরের অবস্থা নোংরা, অপরিষ্কার ও আবর্জনাময়। গ্রামের মানুষের এহেন অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় লক্ষ্মী। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে লক্ষ্মী চলে আসে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানে ছোট্ট একটি বাড়িতে বাস করত নিচু বংশীয় একটি পরিবার। সমাজের অন্যরা ঐ পরিবারের সঙ্গে মিশতো না। লক্ষ্মী দেখল ঐ বাড়িটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোবরের ছিঁটা দিয়ে উঠোন লেপা। আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে বাড়ির দেয়ালে আলপনা আঁকা। পুজোর ঘরটিও পরিচ্ছন্ন। পুজোর ঘরে ধানের শীষ, ফুল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে দেবতার আরাধনা করছে বাড়ির কর্ত্রী। এ দৃশ্য দেখে লক্ষ্মী মুগ্ধ হয়। বাড়িতে ঢুকে  সে গৃহকর্ত্রীকে আশীর্বাদ করে। নিচু বংশীয় সে বাড়ি থেকে লক্ষ্মী বের হতেই চারদিকে রটে গেল সে খবরটি। লক্ষ্মী পৌঁছানোর পূর্বে এ খবর পৌঁছে যায় তার শ্বশুরবাড়িতে। বড় ভাইয়ের নির্দেশে লক্ষ্মীর স্বামী গ্রহণ করে না লক্ষ্মীকে। তার অপরাধ, ‘ঘরের বউ নিচু জাতের সঙ্গে উঠাবসা করেছে। ফলে জাত চলে গেছে তার। স্বামীর আচরণে লক্ষ্মী দুঃখ পায়। মর্মাহত হয়। ফলে স্বামীর বাড়ি থেকে সে চলে আসে এক কাপড়ে। মনের কষ্টে লক্ষ্মী চলে যায় দূরের কোনো গ্রামে।
এদিকে লক্ষ্মী চলে যাওয়ার পর দুভাইয়ের সংসারে নামে চরম অশান্তি। ধীরে ধীরে তারা গরিব হয়ে এক সময় পথে নামে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘোরে মানুষের দ্বারে দ্বারে। তারা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন চলে যায় দূর গ্রামে, লক্ষ্মীর বাড়িতে।
বাড়ির দাসদাসীরা দুভাইকে খেতে দেয় প্রসাদ। কিন্তু তারা তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। দুভাই  বলে ‘আমরা উচ্চ বংশীয়। তাই তোমাদের খাবার খেতে পারি না।’ তারা অনুরোধ করে তাদের রান্নার সামগ্রী দিলে তারা তা রান্না করে খাবে। দাসীরা তাই করল। দুভাই রান্নার সামগ্রী পেল। কিন্তু তাতেও তারা রান্না করতে পারল না। চাল তো সিদ্ধ হয় না আর তরকারিও পুড়ে ছাই। লবণও হয় না কোনো কিছুতেই। নিরুপায় হয়ে ক্ষুধার্র্ত দুভাই তখন দাসীদের ডেকে বলে, ‘যাও খাবার নিয়ে আসো। তোমাদের হাতের খাবার আমরা খাব।’
বাড়ির ভেতর থেকে সব কিছু দেখছিল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর কথামতো দাসীরা দুভাইকে খাবার পরিবেশন করে। নানা পদের খাবার সাজিয়ে দেয় তারা। ক্ষুধার্ত দুভাই যেই খাবার মুখে নেবে অমনি সেখানে হাজির হয় লক্ষ্মী নিজে। দুভাই তাকে চিনতে পারে। লক্ষ্মী তাদের উদ্দেশে বলে, ‘আপনারা তো উচ্চবংশীয়। এ সব নিচু জাতের স্ত্রীদের হাতের ছোঁয়ায় কি আপনাদের জাত থাকবে? আপনারা কি সমাজচ্যুত হতে চান? লক্ষ্মীর কথায় দুভাই  লজ্জিত হয়। তাদের ভুল ভাঙে। অবশেষে দুভাই উপলব্ধি করে সংসারে জাত বলতে কিছু নেই। একই সঙ্গে তারা বুঝতে পারে সংসারে নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা রয়েছে। তারা একে অপরকে ছাড়া অচল।
বড় ভাই তখন নিজের ভুলের জন্য লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ছোট ভাইকে নির্দেশ দেন লক্ষ্মীকে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরতে। লক্ষ্মী স্বামীর সংসারে ফিরতে রাজি হন কিন্তু জুড়ে দেন একটি শর্ত। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার ঘরে ঘরে মেয়েরা লক্ষ্মীর ব্রত করবে। ব্রতের সময় তিনি বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যাবেন। জাতপাতের ভেদ ভুলে সবাই একত্রে বসে খাবে। এটি তার শর্ত। দুভাই লক্ষ্মীর শর্তটি মেনে নেয়। লক্ষ্মীও ফিরে আসে স্বামীর সংসারে। দুভাইয়ের অবস্থাও ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে।
কড়ারা বিশ্বাস করে এরপর থেকেই লক্ষ্মীর শর্ত মতে ঘরে ঘরে মানুষ লক্ষ্মীপূজার মাধ্যমে লবান পালন করে আসছে। এরই মধ্যে মাঠ থেকে চলে আসে কৃষ্ণ ও থোপাল কড়া। তাদের মাথায় পাকা ধানের গোছা। নানা আচারের মাধ্যমে কড়ারা গ্রহণ করে তাদের। ঢাক-ঢোলের শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ। দিনভর চলে লক্ষ্মীর আরাধনা।
দরিদ্রতার কষাঘাতে তিনবেলা খেতে পারে না কড়ারা। কিন্তু তবুও প্রতি অগ্রহায়ণে এরা পালন করে লবান অনুষ্ঠানটি। প্রতি লবানেই এরা আশায় বুক বাঁধে। হয়ত এবার তাদের ঘরে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়বে। দরিদ্রতা থেকে মিলবে মুক্তি। লক্ষ্মীর আশায় এভাবেই কেটে যায় আদিবাসীদের এক একটি দিন।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button