মুক্তিযুদ্ধ

বীরগাথা ১৯৭১: শান্তি কমিটির নেতারা সন্তানদের রাজাকার বানায়নি!

“১৯৬৬ সালের ঘটনা। খবর পাই শেখ মুজিব চৌমুহনী হয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই রায়পুরে যাবেন। সে কারণে আমরা ভাইরা মিলে কাগজ আর বাঁশ দিয়ে নৌকা বানাই। ওই সময় সেটা টাঙাচ্ছি বাড়ির সামনের রাস্তায়। হঠাৎ গাড়ির শব্দ। দেখলাম কচ্ছপের মতো একটা গাড়ি আসছে। ওই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় ফুটের ওপর লম্বা, ফর্সা একটা মানুষ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা, কালো একটা কোটও জড়ানো। ভাবছি এত লম্বা একটা লোক এই কচ্ছপের মতো ছোট্ট গাড়িতে কীভাবে ছিলেন! উনি এসে আমাদের বানানো নৌকাটি দেখলেন। এরপর মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বললেন একান্তভাবে। গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনা হলো। কিন্তু সেটা দেওয়ার জন্য গ্লাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেখ মুজিব ডাবটি মুখে নিয়েই পানি খেতে থাকলেন। মুখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তাঁর শরীরে। এখনো সে স্মৃতি দারুণভাবে মনে পড়ে।”

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেই আন্দোলিত হয়েছিলেন, সেই ঘটনাটিই এভাবে তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন। জয়নুল আবেদীন ও জহুরা খাতুনের সন্তান তিনি। বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। প্রোভিসি ছিলেন চার বছর। ভিসির দায়িত্বও পালন করেছেন কিছুদিন। অবসরের পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন এখন। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

ম্যাট্রিক পাসের পর আবুল হোসেন ভর্তি হন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), প্রি-প্রফেশনাল কোর্সে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই কোর্সের প্রথম বর্ষের ফাইনালের ছাত্র ছিলেন তিনি।

কেমন ছিল ছাত্রজীবনের সময়টা?

তাঁর ভাষায়: “ফার্স্ট ইয়ারে প্রতিভা অনুসন্ধান উৎসব নামে একটা উৎসব হতো তখন। ওটা পরিচালনা করতেন প্রয়াত শামসুজ্জামান খান (বাংলা একাডেমির সাবেক ডিজি)। তখন পাঁচটা ইভেন্টেই অংশ নিয়ে চারটাতে ফার্স্ট আর একটাতে সেকেন্ড হয়ে ফার্স্ট ইয়ারে চ্যাম্পিয়ন হই। ফলে পরিচিতি যায় বেড়ে। নানা কাজে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাও ডাকতে থাকে তখন। কোন দলে যাব? বড় ভাইরা সবাই ছাত্রলীগ করতেন। তাই আমিও ছাত্রলীগে যুক্ত হই। “ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। ওই সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আবুল ফয়েজ কুতুবী, নজিবর রহমান ভাই ও আব্দুর রাজ্জাক ভাই (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী) প্রমুখ। ছাত্রদের তখন আদর্শ ও উদ্দেশ্য বুঝিয়ে ছাত্রলীগে আনা হতো। এখন তো ক্লাসের ভালো ছাত্রছাত্রীরা সচেতনভাবেই রাজনীতিকে এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ছাত্রদের বেশি করে শেখাতে হবে। মেধাবীদের রাজনীতিতে আনার পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে।”

মার্চের শুরুতেই আবুল হোসেন চলে যান কুমিল্লার বুড়িচংয়ে, তার মেজ ভাইয়ের বাসায়। ইমিডিয়েট বড় ভাইও চলে আসেন সেখানে। বুড়িচং থানা পরিষদে একটা বাংলাদেশের পতাকা লাগানো হয়েছিল তখন। ২৮ মার্চে সেটা নামালে তারা প্রতিবাদ জানায় সিইওর কাছে গিয়ে। এভাবে ওখানে আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপের সঙ্গে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে তার। ওদের নিয়েই পরে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন আবুল হোসেন।

কীভাবে?

তিনি বলেন, “২০ এপ্রিল ১৯৭১। বন্ধুদের বলি তোরা রাতে এসে দরজায় টোকা দিবি। বড় ভাইকে কী বলে সরাই? বিকেলের দিকে ইচ্ছে করে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধালাম। রাগ করে কথাও বন্ধ। ওই রাতেই ভাইয়ের পকেট থেকে ২১৭ টাকা নিই। এরপর দরজায় খিল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তিনি এসে কয়েকবার দরজায় আওয়াজ দেন। পরে রাগ করেছি ভেবে অন্য রুমে চলে যান। বাড়ি ছাড়ার আগেই ভাইকে একটা চিঠি লিখে যাই– ‘তোমার টাকাগুলো নিলাম। বর্ডার ক্রস করে ভারতে যাব। আমাকে খুঁজো না।’

তাহের, বাশার, নান্নুসহ ছিলাম ১১ জন। কুমিল্লার রেলওয়ে পার হয়ে হাতিমারা বিওপিতে আসি আমরা। এরপর সোনামুরার পাশে গোমতী নদী পার হয়ে চলে যাই ভারতের কাঁঠালিয়ায়। সেখানে ট্রেনিং হয় সাত দিন। এরপর আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয় প্রথম সোনামুরায় এবং পরে আসামের ওমপি নগরে। ওমপিতেই ট্রেনিং হয় ২১ দিন। আমরা ছিলাম ফার্স্ট ব্যাচ। সহযোদ্ধা হিসেবে সেখানেই পরিচয় হয় বাসদ নেতা খালেকুজ্জামানের সঙ্গে।”

ট্রেনিংকালীন স্মৃতি তুলে ধরে আবুল হোসেন বলেন, “ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডোগরা পলিটিক্যাল ক্লাস নিতেন। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেলাঘরে। ওখানে দেখা হয় ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের সঙ্গে। এরপর নিয়ে আসা হয় নির্ভয়পুরে। ওটা ছিল ২ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব সেক্টর। দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান। ফলিং করিয়ে উনি জানতে চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কে কে পড়েছে?

ইন্টারমিডিয়েট লেভেল হলেও পড়তাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমি, খালেকুজ্জামান ও ফকরুজ্জামান–এই তিনজন এগিয়ে আসি। এফএফদের (ফ্রিডম ফাইটার) পরিচালনা জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাদের। লেখালেখি, সেলারি, অস্ত্র ইস্যু, অস্ত্র ও গুলির হিসাব, অপারেশনের খবরাখবর রাখা প্রভৃতির দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। জুনের প্রথম সপ্তাহে নির্দেশক্রমে আমি ১১টি থানার প্রত্যেক কমান্ডারকে একটা করে এসএমজি, বাকিদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর একটা করে গ্রেনেড দিয়ে ভেতরে পাঠাই। প্রতি গ্রুপ থেকে এক বা দুইজন মাঝেমধ্যে এসে রিপোর্ট করতেন। ওয়্যারলেসে ওই তথ্য পাঠিয়ে দিতাম মেলাঘরে। এভাবে অস্ত্র দিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সতেরো শ মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়েছি।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের কার্যক্রম নিয়ে এই বীর বলেন, “একাত্তরের জুনের শেষ দিকে আমাদের গ্রুপগুলোর চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তখন অস্ত্র হাতে পথে পথে থাকত শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। ওরা পাকিস্তানি সেনাদের রসদ সরবরাহ করত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা কাজ করতেন, তাদের ইনফরমেশনগুলো তারাই পাকিস্তানি সেনাদের দিয়ে আসত। শান্তি কমিটির নেতারা নিজের ছেলেমেয়েদের রাজাকার বানায় নাই! তারা এলাকার গরিব ছেলেদের বেশি রিক্রুট করত। ট্রেনিং দিয়ে লোভ দেখিয়ে বলত, ‘লুটের মাল জায়েজ। সেটা তোমরা পাবা।’ ওরা ব্রিজ পাহারা দিত। ফলে গেরিলাদের সাথে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়েছে বেশি। যদি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর আর আলশামস না থাকত, তবে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা এত মানুষকে হত্যা করতে পারত না!”

ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই সোনামুরার গোমতী নদীর ওপর কাঠের নৌকা রেখে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। চার ডিসেম্বরে ওই পথে ভারতীয় আর্মির কনভয় আসতে থাকে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। আবুল হোসেনরা তখন তাদের সঙ্গেই মার্চ করেন। এফএফ থাকত সবার সামনে। ভেতরে থাকা গেরিলা গ্রুপগুলোও তখন একত্র হয়ে সামনে এগোতে থাকে। যেখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল, সেখানেই চলত তুমুল গোলাগুলি। ১৪ ডিসেম্বর তারা চাঁদপুরে এসে পৌঁছে। এক দিন পরেই শুনতে পায় দেশ স্বাধীনের খবর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মনে করেন স্বাধীনতা লাভের পর কয়েক প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তার ভাষায়, “জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই একটা বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনেছে ভুলভাবে। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়াতে সামরিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এটা তো অবশ্যই ঠিক ইতিহাস না। তখন মিডিয়াও শক্তিশালী ছিল না। দশবার একটা মিথ্যা বললে সেটা আস্তে আস্তে সত্যে রূপ নেয়। আর সত্য ও মিথ্যার মিশেল–সেটা আরও ভয়ংকর। এই কাজটা চলেছে বহুদিন। তাই তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ইতিহাস ছড়িয়েও দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বই একশজনের মধ্যে দশজন পড়বে। দশজনের মধ্যে তিনজনও যদি সেটা ধারণ করে, তবে দেখবেন সেটা ট্রান্সমিট হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।”

পরবর্তী প্রজন্মই একদিন দেশকে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করবে–এমনটাই বিশ্বাস বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “আমরা শুরু করেছিলাম শূন্য হাতে। বঙ্গবন্ধু বললেন–‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে…।’ পিটি-প্যারেড আর বাঁশের লাঠি দিয়েই যুদ্ধ শুরু করেছে এ জাতি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে তো এলএমজির সামনে দাঁড়ানো যায় না! কিন্তু তবু বুকভরা সাহস আর মনোবলটা ঠিক রেখে বাঙালি একাত্তরে দাঁড়িয়েছিল। তাই তো স্বাধীনতা পেয়েছি। সাহস ও মনোবল নিয়ে তোমরাও দেশটাকে এগিয়ে নিও।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button