আদিবাসী

তুরি বিয়ে: গায়ে হলুদ হয় পাঁচ দিনে

মধ্য বিকেল। আমরা দিনাজপুরের লোহাডাঙ্গা গ্রামে। গাছের নিচে বসা লবানু শিং। আদিবাসী তুরি গোত্রের মহৎ সে। কথা বলছেন এলোমেলো। একই কথা বারবার। হঠাৎ যেন খেয়ালও হারিয়ে ফেলছেন। পাশের হালজা গ্রামে কড়া আদিবাসীদের পাড়া। সেখানকার রঞ্জন কড়া লবানুর বন্ধু। রঞ্জনের মেয়ের বিয়ে ছিল গতরাতে। তাই প্রিয় পানীয় হাড়িয়ার নেশা কাটেনি তার। লবানুর সহধর্মিণী খিরো বালা। রাতের জন্য আশপাশ থেকে শাকপাতা সংগ্রহ করে এনেছেন। তাই দিয়েই চলবে রাতের খাবার। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সঙ্গে কথা হয় তার। কথা চলে লবানুর সঙ্গেও।

তুরি আদিবাসীরা পুরুষদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে শিং আর মেয়েদের নামের শেষে বালা শব্দটি ব্যবহার করে। তাদের পূর্বপুরুষরা লোহাডাঙ্গায় বসত গেড়েছে ব্রিটিশ আমালেরও আগে। এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। ঝুমটা নাচের গানেও পাওয়া যায় দুমকার অস্তিত্ব। তুরি নারীদের পছন্দ রুপার ঝুমকা (রুপার দুল), হাসেলী (মালা), বাজু, বিছা প্রভৃতি। এ নিয়েই ঝুমটা নাচের গানটি খিরো বালা আমাদের শোনায় :

কিনে দেব ঝুমকা
ত লেয়ে যাব দুমকা।
ভাবার্থ : কিনে দেবো ঝুকমা তারপর নিয়ে যাব দুমকা।

ভারতের দুমকা থেকে এলেও বর্তমানে আদিবাসী তুরিদের সংখ্যা বাংলাদেশেই বেশি। লোহাডাঙ্গা ছাড়াও দিনাজপুরের রামসাগর, বোটের হাট, জামালপুর, পুলহাট, খানপুর, মহেশপুর, বড়গ্রাম, সাদিপুর, মুরাদপুর, হাসিলা, গোদাগাড়ী আর রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় অধিক সংখ্যক তুরি আদিবাসীর বসবাস।

লবানু জানায়, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন পাহাড়ের বনভূমির অধিবাসী। তখন তাদের খাদ্য ছিল রুটি, ফলমূল, জীবজন্তুর মাংস, ছাতু। ধানের আবাদ না হওয়ায় ‘ভাত’ খাদ্যতালিকায় ছিল না। হিংস্র বন্য পশুর হাত থেকে বাঁচাতে ঢাল-তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুকই ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। বন্য জন্তুর ভয়ে জঙ্গল কেটে এরা টঙ বানিয়ে বসবাস করত। এদের পূর্বপুরুষরা ঢাক-ঢোল বাজাতে পারদর্শী ছিল। সে সময় রাজার লোকেরা খুশি হয়ে তাদের জিজ্ঞেস করত, তোমরা কোন জাত? উত্তরে তারা বলত, আমরা তুরই জাত, মানে তোর-ই বা তোমাদেরই জাত। লোকমুখে সেখান থেকেই তাদের তুরি বলে ডাকা হয়।

এদের গোত্র পরিচালনায় থাকে চার সদস্যের পরিষদ। এর পদগুলো মণ্ডল, মহত, বাসি, ছড়িদার। তবে বর্তমানে তুরি সমাজে মণ্ডল ও মহত ছাড়া অন্য পদগুলোর তেমন কার্যকারিতা নেই। পদগুলো এরা নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে। তবে এদের বিয়েসহ সকল উৎসবে মণ্ডল ও মহতকে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তুরিরা সাঁওতাল ও সমতলের অন্য আদিবাসীদের মতো এখনো ধর্মান্তরিত হয়নি; বরং দারিদ্র্যের মধ্যেও আঁকড়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি আর আচারগুলোকে।

চারপাশে অন্ধকার নামে। কুপির আলোয় আলোকিত হয় লবানুর বাড়ির উঠান। মাদুর পাতা উঠানে বসে কথা হয় তুরিদের সঙ্গে। লবানুর ছেলে বীরেন শিং ও তার স্ত্রী জয়ন্তী বালাসহ কয়েকজন যোগ দেয় আসরে। ফলে আলাপও জমতে থাকে। খিরো বালা স্মৃতিচারণ করে মেয়ে ইচিলি বালার বিয়ে আচারের আদ্যোপান্ত।

নিজের বিয়েতে ৫১ টাকা পণ পেলেও মেয়ের বিয়েতে পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হয়েছে খিরো বালাকে। আদিবাসী তুরিদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু থাকলেও সময়ের গতিতে এখন অনেকেই যৌতুক নিয়ে বিয়ে করছে। আশপাশের বাঙালি সমাজের যৌতুকপ্রথা গ্রাস করছে আদিবাসীদের পণপ্রথাকে।

তুরি আদিবাসী সমাজে রক্তের সম্পর্কে বিয়ে নিষিদ্ধ। এ ছাড়া অন্য জাত বা সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিয়ে হয় না। সমাজে পরিবারের প্রধান থাকে পিতা। পুত্র বিয়ের আগে ও পরে পিতার বসতভিটাতেই থাকেন। বিয়ের পর মেয়ে পিতার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে চলে যায়। এ আদিবাসী সমাজে যৌথ পরিবার ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও তুরি নারীদের মতামতও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। উৎসব ও অনুষ্ঠানে নারীদের গুরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা থাকে। এ আদিবাসী সমাজে জমিজমা, ঘরবাড়ি, সম্পত্তি কোনো কিছুর অংশীদার নারী হতে পারে না। পিতার পুত্ররাই অংশীদার হন। তবে পিতা ইচ্ছে করলে কন্যাকে কিছু বিষয় সম্পত্তি দিতে পারেন।

তুরিরা ছেলেমেয়ের ১৪ বছর বয়সকে বিয়ের উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করে। বরপক্ষ বিয়ের উপযুক্ত মেয়ের সন্ধান পেলে এবং পছন্দ হলে কনেপক্ষের অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে থাকে। কনেপক্ষের অভিভাবকরা বিষয়টি বিবেচনা করেন এবং ছেলেটি কেমন, তা খোঁজখবর নেন। উভয়পক্ষ প্রাথমিকভাবে সম্মত হলে বরপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কনে দেখতে যায়।

সে সময় মেয়ে সাংসারিক কি না কিংবা তার কৃষিবিষয়ক জ্ঞান আছে কি না, তা যাচাই করা হয় নানা প্রশ্ন করে। প্রশ্নগুলো—শাক রাঁধতে কতটুকু হলুদ লাগে, ধান লাগানোর সময় কোন দিকে এগোতে হয় প্রভৃতি। প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারলে ধরে নেওয়া হয় কনেটি ভবিষ্যতে সাংসারিক হবে। এ ছাড়া শারীরিক কাঠামো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কনে দেখতে বরের অভিভাবকরা মুখ দেখানি হিসেবে টাকা দিয়ে থাকে।

কনে দেখার পর কনেপক্ষ একটি নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে দেখতে আসে ছেলের বাড়িতে। এ সময় তারা সঙ্গে নিয়ে আসে— ধুতি, মিষ্টি, তুলসী, কাঠের মালা, কোমরের জন্য লাল সুতার ডোর, গেঞ্জি, এক জোড়া স্যান্ডেল প্রভৃতি। ছেলে দেখার পর ওই দিনই উভয়পক্ষের মহতসহ গণ্যমান্যরা আলোচনা করে বিয়ের দিন ও সময় নির্ধারণ করেন। তুরি সমাজে বর-কনের জন্মদিনে, দিবসের দিবালগ্নে, শনিবারে শনিচক্রে এবং মঙ্গলবারে কুমঙ্গলের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ থাকে।

বিয়ে উপলক্ষে তুরিরা বাড়িঘর সাজায়। তারা বাড়ির উঠান ও ঘর মাটি লেপা দিয়ে তাতে আলপনা ও ফুলপাতা অঙ্কন করে। আঙিনায় কলাগাছ পুঁতে বিয়ের মাড়োয়া তৈরি করে এবং সুতা বা দড়ি টানিয়ে আমপাতা ঝোলানো হয়। এ ছাড়া বিয়ে উপলক্ষে এরা সারা বাড়ি আলোকসজ্জার আয়োজন করে। বিয়ে উপলক্ষে নারীরা হলুদ শাড়ি, লাল রঙের ব্লাউজ ও পেটিকোট পরিধান করে। ছেলেরা ধুতি, সাদা ফতুয়া বা পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি, মাথায় পাগড়ি, সোনার টোপর পরে।

এই আদিবাসীরা বিয়ের আগের পাঁচ দিন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করে থাকে। প্রথম দিনে বরকে স্নান করিয়ে তেল হলুদ মাখানো হয়। অতঃপর প্রথা অনুযায়ী একটি বিশেষ নিয়মে ভবিষ্যৎ গণনা করে। একটি বাটিতে জল নিয়ে তাতে সিঁদুর ও দূর্বাঘাস মিশিয়ে গুলিয়ে নিতে হয়। এরপর ওই জলের মধ্যে প্রথমে তিল ও পরে চাল ছাড়া হয়। পানিতে ঘুরতে ঘুরতে তিল যদি চালকে ধরে তাহলে বর-কনের বন্ধন অটুট থাকবে বলে ধরে নেওয়া হয়। বর উক্ত তিল ও চালসমূহ একটি হলুদ মেশানো ছোট কাপড়ে পাঁচটি গিঁট দিয়ে রাখে। এ সময় বরের হাতে যাঁতি রাখা হয় যেন অশুভ শক্তি তাকে ছুঁতে না পারে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলে প্রতিদিন বর একটি করে গিট বা বাঁধন খুলে দেয়।

গায়ে হলুদের সময় তুরিরা গান গায় :
নেদিয়াকে কিনারে বাবা আমা তুরি খানে জড়ি পানি পিয়েলা
এতো যদি জানতে গে বেটি সহিগে ঘরে
জুহুরা খিলাতে
জুহুরা খিনাতাম গে বেটি হাত মোরা
কুঁইয়া ডনাতে হিয়া মাজেহে কাঁপতে।

ভাবার্থ :
নদীর কিনারে আগে যদি জানতাম রে বেটি আম পেড়ে খেতাম,
সবকিছু খাওয়াচ্ছে
এত যদি জানতে গো বেটি আঁতুর ঘরে বিষ খাওয়বে
বিষ যদি খাওয়াতাম তাহলে আমার হাত কাঁপত।
কুয়ার নিকটে যেতে শরীর কাঁপছে।

(চলবে)

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছেন এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৪ নভেম্বর ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button