আদিবাসী

পৃথিবীতে কেন পান-সুপারি জন্মালো

পৃথিবীতে কেন পানসুপারি জন্মালো? কেনইবা মানুষের মাঝে চুন খয়ের খাওয়ার প্রচলন ঘটলো? এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় খাসিয়া আদিবাসীদের কাছ থেকে। নিয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে মজার একটি কাহিনি। কাহিনির ভাবার্থ:

এক গাঁয়ে ছিল দুই বন্ধু। একজন বেশ ধনী, আরেকজন খুব গরিব। গরিব বন্ধু যে কোন প্রয়োজনেই শরণাপন্ন হতো ধনী বন্ধুর ওপর। নানা বিপদে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। সেও সাধ্যমত সাহায্য করত বন্ধুটিকে। এভাবে ধনী বন্ধুর কাছে গরিব বন্ধুর ঋণের অন্ত ছিল না। অথচ বিনিময়ে সে ধনী বন্ধুকে কিছুই দিতে পারতো না। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে মন খারাপ হতো তার।

একবার গরিব বন্ধু ভাবলো, অন্তত একদিন ধনী বন্ধুটিকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো দরকার। আগ্রহ নিয়ে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে সে। যথাসময়ে ধনী বন্ধুও এসে উপস্থিত হয় বাড়িতে। সে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! একে তো দরিদ্র্য, তার ওপর শত চেষ্টা করেও বন্ধুর জন্য কোনো খাবার যোগাড় করতে পারলো না গরিব বন্ধুটি। লজ্জায় সে বন্ধুর সামনে আসতেও পারছে না। পাশের ঘরে বসে থেকে ভাবছে নানাকিছু।

ধনী বন্ধুটি না খেয়ে ফিরে যাবে! এই লজ্জায় নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার এলো। ঘরের ভেতর সে তখন স্ত্রীসহ বুকে ছুরি চালিয়ে আত্মহুতি দিলো। ছুটে গিয়ে ধনী বন্ধু দেখলো তার প্রাণের বন্ধুটি ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সে তাকে বাঁচাতে পারল না। বন্ধুটি ভাবলো তার জন্যই তার বন্ধু ও বন্ধুপত্মী মারা গেছে। সুতরাং তার এত ধন-সম্পদ দিয়ে কী হবে! বেঁচে থেকেই কী লাভ। তাই সে নিজেও পেটে ওই ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করলো। ফলে ওই বাড়িতে জীবিত বলতে আর কেউ রইল না। পড়ে থাকে তিনটি লাশ।

দিন গড়িয়ে রাত আসে। কোন মানুষের সাড়া-শব্দ না পেয়ে মধ্যরাতে এক চোর ঢুকে ওই বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে তো কোন ধন-সম্পদ নেই। বরং তিনটি মরদেহ দেখে চোর মহা ভাবনায় পড়ে। নানা বিষয় চিন্তা করে সে। চুরি করবে তো দূরের কথা, কীভাবে সে মুক্ত হবে সে চিন্তা করতে করতেই ভোর হয়ে গেলো। সে ভাবলো এখন ঘর থেকে বের হলে লোকে তাকে ধরে ফেলবে। কারণ চোর হিসেবে সবার চেনা সে।

কিন্তু ধরা পড়লে তো বিপদ। তাকে তিনটি খুনের দায়েও শাস্তি পেতে হবে। কী করবে এখন! ভাবলো সারাজীবন চুরির মতো খারাপ কাজ করাতেই আজ সে এমন বিপদে পড়েছে। কাজেই ফিরে গিয়ে লাভ নেই। নানা চিন্তায় সেও বুকে ওই ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করল।

ওই বাড়ির এসব ঘটনা দেখছিলেন ভগবান। সব দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। তারপর ওই চারজন মৃত মানুষ থেকে সুপারি, পান, চুন ও খয়ের জন্মালেন। ধনী বন্ধু ওই বাড়িতে প্রথমে এসেছিলেন। তাই সে হলেন সুপারি। গরিব বন্ধু হলেন পান, বন্ধুপত্মী চুন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল থাকায় পান, সুপারি ও চুন থেকে মানুষের মুখ লাল হয়। ভগবান ওই চোর থেকে জন্মালেন খয়ের।

খাসিয়া আদিবাসীদের বিশ্বাস এ কারণেই প্রথমে সুপারি, তারপর পান চুন ও খয়ের খেতে হয়। তারা মনে করে চোরের প্রতীক খয়ের। এ বিবেচনা করে কেউ কেউ খয়ের গ্রহণ করে না। তবে চোরের আত্মহুতির কথাও কেউ কেউ স্মরণে রেখেছেন। ফলে অনেকে আবার খয়ের খান।

এ কারণে পান-সুপারি খাসিয়াদের কাছে পবিত্র। বাড়িতে কেউ বেড়াতে গেলে এরা প্রথমে পান-সুপারি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। এছাড়া মৃত ব্যক্তির সম্মুখে যে সব উৎসর্গ করা হয় তার ভেতর পান-সুপারি প্রধান। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার প্রভৃতি জেলায় খাসিয়া আদিবাসীদের বসবাস। এদের আদি আবাসস্থল আসাম প্রদেশের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চলে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৬ জুলাই ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button