আদিবাসী

রাজবংশীর দুটি বিশ্বাস

রাজবংশীদের প্রাচীন বসতি ছিল তিব্বত প্রাচীন ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ মিয়ানমারের পাহাড়ি মালভূমি এলাকায়। এছাড়া ভারতের কুচবিহার, বিহার, মুর্শিদাবাদ আসাম অঞ্চলেও বিপুল পরিমাণ রাজবংশী রয়েছে।

বাংলাদেশে এরা উত্তরবঙ্গ ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছে। রাজবংশীদের অধিকাংশই মাছ ধরা পেশায় যুক্ত। এ আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে অগণিত লোকগাথা, যুগে যুগে যা আদিবাসীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।

আদিবাসী বিশ্বাসের সেই কাহিনিগুলো বেশ চমকপ্রদ। ধান গাছে ধান হয়। কিন্তু ধান গাছে কেন চাল হয় না? এমন ভাবনার উত্তরে মিলে রংপুরের একটি রাজবংশী গ্রামের আদিবাসীদের মুখে শোনা একাটি কাহিনিতে। কাহিনিটি হল-

এক সময় সব মানুষই ছিল সত্যবাদী। তাই সে সময়কে বলা হতো সত্যযুগ। সত্যযুগে মানুষের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল ভগবান বা সৃষ্টিকর্তা। সে সময় ধানগাছে চাল-ই হতো। মানুষ খুব সহজেই সরাসরি চাল তুলে রান্না করে খেত। একবার এক লোক চালের জমিতে বসে মলত্যাগ করছিল। ওই সময়েই সে গাছ থেকে চাল ছিড়ে ছিড়ে চাল খাচ্ছিল।

তার কাণ্ডকারখানা দেখছিল সৃষ্টিকর্তা। এমন আচরণে ক্ষিপ্ত হন তিনি। ওই লোক চলে যাওয়ার পরপরই সৃষ্টিকর্তা মানবকুলকে ডেকে পাঠান। তারপর রাগান্বিত হয়ে অভিশাপ দিয়ে বলেন, আমার সৃষ্টিকে তোরা মলত্যাগের সময় স্পর্শ করে অপবিত্র করেছিস! এখন থেকে তোদের সাতগুণ পরিশ্রম করে চাল বানিয়ে খেতে হবে, তার আগে নয়।

সে থেকেই ধান গাছে আর চাল হয় না। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে ধান হওয়া শুরু হয়। আর সেই ধান মাড়াই ও সেদ্ধ করে, বাতাসে শুকিয়ে, ঢেঁকিতে ছাটানো ও কুলোতে পরিষ্কার করে রান্নার উপযোগী করে খেতে হয় মানবকুলকে।

সাপের কেন কান নেই? এমন প্রশ্নেও রাজবংশী আদিবাসীরা কাহিনির ঝুড়ি নিয়ে বসেন। মা মনসা যখন সর্পকুলকে ডেকে বিষ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাল তখন সর্পকুল পৃথিবীর মানুষকে দংশন করে বহু মানুষকে মেরে ফেলল।

এ অবস্থা দেখে মানবকুল গেল মহাদেবের কাছে। তারা মহাদেবকে সর্পকুলের অত্যাচারের কাহিনি খুলে বলল। সব শুনে মহাদেব ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি অভিশাপ দিয়ে সাপদের এক চোখ কানা করে দিলেন। এতেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। সাপরা যেন মানুষের কোন শব্দ শুনতে না পারে সে কারণে তাদের কানও তুলে নিলেন। অতঃপর পৃথিবীতে সাপদের অত্যাচার যায় কমে।

সাপের প্রসঙ্গ উঠতেই  রাজবংশী আদিবাসীরা প্রশ্ন তোলে, ঢোঁড়া সাপের কেন বিষ নেই? উত্তর না মিলতেই আরেকটি রাজবংশী কাহিনির শুরু: মা মনসা একদিন সব সর্পকুলকে ডেকে বিষ প্রদান করলেন। সে সময় তিনি লক্ষ্মীন্দরকে কামড়ানোর নির্দেশ দিলেন ঢোঁড়া সাপকে। এ কারণে তাকে সবার চেয়ে বেশি বিষও দিলেন। বিষ পেয়ে লক্ষ্মীন্দরকে কামড়াতে ঢোঁড়া সাপ যাত্রা শুরু করল। পথেই পরল গঙ্গা। এই গঙ্গা পার হতে হবে। সেখানে ছিল অগণিত মাছ। সবগুলো লাফাচ্ছে।

মাছ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারল না ঢোঁড়া সাপ। সে কচুপাতায় বিষ রেখে মাছ খেতে খেতেই গঙ্গা পার হতে থাকল। এদিকে কঁচুপাতায় রাখা বিষ পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া ইত্যাদিতে খেয়ে ফেলল। ঢোঁড়া সাপ ফিরে এসে দেখে, কচুপাতায় বিষ নেই। বিষ হারিয়ে সে থেকেই ঢোঁড়া সাপ বিষহীন সাপ।

তার এমন লোভের কর্মে মনসাদেবী মনক্ষুন্ন হন। তিনি অভিশাপ দিয়ে বলেন, এখন থেকে সমস্ত লোক তোকে পায়ে মাড়াবে। সে থেকে পৃথিবীতে তাই ঘটে আসছে। ঢোঁড়া সাপের বিষ খেয়েছিল বলেই পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া ইত্যাদির কাটায় আজও বিষ রয়েছে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর কিডজে, প্রকাশকাল: ৮ জুন ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button