আদিবাসী

‘খোল রুপিয়া দেখ তামশা’

যুবক বয়সী সুবল স্থানীয় এক পত্রিকার সাংবাদিক। দিনাজপুরে আদিবাসীদের বৈশাখের খবর সংগ্রহে সে আমার সঙ্গী হয়। আমাদের গন্তব্য ভাণ্ডারার রেংটা পাড়া। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পাড়া এটি। যার নামে পাড়ার নামকরণ সেই রেংটা এখনও বেঁচে আছেন। বয়স তার প্রায় ১০৫ বছর। তবু  কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে দিব্যি চলেন তিনি। শুনেই সুবল আগ্রহী হয়।
গ্রামের পথে চলতে মোটরসাইকেলের কোনো বিকল্প নেই। তাই সুবলের মোটরসাইকেলে আমরা রওনা হই। বহবলদীঘি থেকে হালজা গ্রাম দিয়ে শর্টকাট একটি রাস্তা চলে গেছে রেংটা পাড়ার দিকে। পাকা রাস্তা ছেড়ে তুঁতের ছায়ার মেঠো পথে আমরা চলে আসি হালজা গ্রামে।
এই গ্রামেই আছে আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের একটি পাড়া। একটি বললে খানিকটা ভুল বলা হবে। এটিই এখন বাংলাদেশের একমাত্র কড়াপাড়া। এদেশে টিকে থাকা কড়া সম্প্রদায়ের ১৯টি পরিবারের মধ্যে এখানে বাস করে ১৬টি পরিবার। এদেশ থেকে কড়ারা হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশে টিকে না থাকলেও ভারতের ঝাড়খণ্ডে রয়েছে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
কড়ারা দ্রাবিড় জাতির অন্তর্ভুক্ত। মুণ্ডা, পাহাড়িয়া, সাঁওতাল ও ওঁরাওদের মতো কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরাও এই উপমহাদেশে আসে এবং ছোট নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা ও ভাগলপুরে বসবাস শুরু করে। ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের মাটি কাটার কাজের সূত্র ধরেই এদের পূর্বপুরুষদের আগমন ঘটে এখানে।
আমাদের দেখেই কড়াপাড়া থেকে ছুটে আসে কয়েকজন আদিবাসী। পুরুষদের পাশাপাশি পথ আগলে দাঁড়ায় দু-একজন নারীও। বেশ খানিকটা ক্ষিপ্ত তারা। বরাবরের মতো এবারও সরকারি কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে কড়ারা। এ নিয়েই তাদের মধ্যে উত্তেজনা। সাংবাদিক সুবলকে দেখে দলবেঁধে সেগুলোই বলছিল তারা। একদল বঞ্চিত আদিবাসীর প্রতিবাদের মুখে আমরা আর সামনে এগোতে পারি না। অগত্যা রেংটা পাড়ায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হয় মাথা থেকে।

    দিনাজপুরের হালজায় এদেশে টিকে থাকা কড়াদের একমাত্র গ্রাম
দিনাজপুরের হালজায় এদেশে টিকে থাকা কড়াদের একমাত্র গ্রাম

কড়াপাড়ায় এর আগেও এসেছি বারকয়েক। অনেকেরই মুখ চেনা। পাড়ার ভেতর গোত্রপ্রধান  জগেন কড়ার বাড়ি। তার বাড়ির উঠানে বসে আমরা শুনি কড়াদের অবহেলা আর বঞ্চনার কাহিনীগুলো।
অন্য আদিবাসীদের মতোই কড়াদের পেশাও কৃষি। ফসল কাটা ও লাগানোর সময়টাতে এদের কাজ থাকে। বছরের বাকি সময়টাতে এরা দিনমজুরের কাজ করে। তাও দিনমজুরি সবার ভাগ্যে মিলে না। ফসল লাগানোর পর পরই এরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। তাই চৈত্র-বৈশাখে আদিবাসীদের অভাব থাকে পাড়ায় পাড়ায়। কড়ারা এ সময়ে আশপাশ থেকে শাক, লতাপাতা আর জংলি আলু খেয়ে জীবন চালিয়ে নেয়।
হঠাৎ করেই এই অভাবের মাসে সরকারের মাটি কাটার কাজের সুযোগ আসে। মাটি কেটে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে ভালোই চলবে দু-একটি পরিবারের। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি হয় কড়াদের। মাটি কাটার কাজের শ্রমিক ঠিক করার দায়িত্ব পড়ে স্থানীয় এক  নেতার ওপর। পরিশ্রমী আর সততার সঙ্গে কাজ করার সুনাম থাকলেও কাজ পায়নি কড়াপাড়ার কোনো আদিবাসী। প্রত্যেক শ্রমিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে কাজ পায়। অন্য কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা অভাবি। তাদের পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কাজও জোটেনি কড়াদের ভাগ্যে।
১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন করতে কড়া গোত্রের এক আদিবাসী গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। নাম তার খোপাল কড়া। খোপালের স্ত্রী তুলো কড়া। ঘর থেকে বেরিয়ে সে আমাদের আসরে আসে। খানিকটা চেঁচিয়ে বলে, ‘যাদের ঘরেত টাকা আছে, তাদের ঘরে মাটি কাটা আছে। যাদের ঘরেত টাকা নাই তাদের ঘরে মাটি কাটা নাই।’ কেন নিবে না আদিবাসীদের? সে আক্ষেপের সঙ্গে বলে, ‘শেখের মেয়ে শেখ হাসিনা কি নেতাদের শিখায়ে দিছে যে, টাকা নিবেন তারপর কাজ দেবেন। কেন কাজ পাইলো না দুইটা পাড়ার আদিবাসীরা’।
তুলোর কথায় আমরা নীরব থাকি। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা এমপিকে বিষয়টি জানাননি কেন? প্রশ্ন করতেই পাশে বসা সুনিয়া কড়া খানিকটা তেড়ে আসে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে ভোট নেয়ার সময় তো বাড়ি বাড়ি আসে সবাই। হাসিমুখে নেতারা বলে, ‘দিদিরা, ভায়েরা, বেটারা, বহিনরা- ভালো করে দেখিও। তোমাকেও দেখব। যখন হয়ে যায় তখন কাঁচকেলা’। কড়া ভাষায় সুনিয়া বলে ভোটের আগে নেতারা বলে :
‘কারোয়া দেব, ভেরোয়া দেব
নেদি পার হওয়া গিয়া দেব
লরোয়া চাটায়ে’
কড়াদের জন্য কোনো বিচার নেই। সুনিয়ার ধারণা ভারতে থাকা কড়ারা এদেশ থেকে ভালো আছে। তাই সে বলে ‘বর্ডার খুলে দেক সরকার, আমরা চলি যামু’।তুলো আর সুনিয়া কড়ার প্রতিবাদের মধ্যে আদিবাসীদের বঞ্চনার একটি চিত্র ফুটে ওঠে। জানা যায় এভাবেই বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়দের সঙ্গে জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ ও নানা অবহেলার কারণেই কড়াসহ অন্য আদিবাসীরা টিকে থাকছে না এদেশে। সুনিয়া আক্ষেপ করে বলে এ জগতে আছে দিমসা আর নিমসা। কড়া ভাষায় দিমসা মানে দেয়া আর নিমসা মানে নেয়া। তার কাছে এদেশের নেতারা হচ্ছে দিমসা আর তারা শুধুই নিমসা। আর নিমসারা শুধুই তাকিয়ে থাকে দিমসার দিকে।
সুবল কখন যে তার রেকর্ডার অন করে বসে আছে টেরই পাই নি। কড়াদের অভিযোগের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আনা এবং খবরটি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুবল তাদের শান্ত করে।
কথার ফাঁকে কড়াদের বৈশাখ নিয়ে জানতে চাই সুনিয়ার কাছে। সুনিয়া এবার মুচকি হাসে। সে জানালো অভাবের সময় এখন। হাতে পয়সা নেই, তাই তামাশাও নেই। কড়া ভাষায় সে বলে :
‘খোল রুপিয়া
দেখ তামশা
রুপিয়া নেহি
তো নেহি তামশা’
জগেনের সঙ্গে কড়াপাড়াটি আমরা ঘুরে দেখি। সে জানালো অন্য আদিবাসীদের মতো কড়ারা কোনো বৈশাখ পালন করে না। পাড়ার এককোণে বাঁশের তৈরি কাগজে মোড়ানো ছোট্ট ঘর আকৃতির কিছু একটা আমাদের নজরে আসে। পাশেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে উঁচু ঢিবি।
জগেন জানল এটি  শিবপূজার স্থান। কড়ারা মাঘের অমাবস্যায় ঐ স্থানেই শিবের পূজা করে। কড়াদের কাছে এটি শিবরাত্রি। গত শিবরাত্রির নানা আনুষ্ঠানিকতার কথা জানাল জগেন। এ বছরও প্রত্যেকের কাছ থেকে একশত করে টাকা চাঁদা তুলে আয়োজন করা হয়েছে এ পূজার। নিয়মানুসারে পূজার আগেরদিন এরা ভগবানের কৃপা লাভের আশায় উপোস থাকে। ঐদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। কড়া পাড়ায়  রাতভর চলে দেহতরি গান।
শিবরাত্রির পূজার সময়টা মধ্যরাতে। সে সময় কড়ারা একটি বাঁশের চালনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, কলা, সুপারি, ঘাস, ফুল, ধান, সিঁদুর দিয়ে ভক্তি দেয়। অতঃপর উলুধ্বনি দিয়ে এরা শিবের মাথায়  দুধ ঢালে। কোনো মন্ত্র ছাড়াই প্রথমে দশজনে সমাজের পক্ষে দুধ ঢালে। এরপর একে একে যারা উপোস থাকে তাদের দুধ ঢালতে হয় আলাদাভাবে। কড়ারা কোনো মূর্তিপূজা করে না। তৈরি করা মাটির ঐ উঁচু ঢিবিটিই এদের কাছে শিব দেবতা। ভোরে সবাই গোসল সেরে আরেকবার শিবের মাথায় দুধ ঢালে একই নিয়মে। দুধ ঢালার সময় কড়ারা প্রার্থনা করে নানা মনোবাসনা পূরণের।
কড়াপাড়ার এককোণে দেখা গেল বেশ কিছু গরু ও ছাগলের জটলা। আনুমানিক ২০ থেকে ৩০টি। এতগুলো গরু-ছাগল থাকলে কড়াদের আর্থিক অবস্থা তো ভালো থাকার কথা। এমন প্রশ্নে জগেনের মুখে খেলে যায় এক চিলতে হাসি। সে জানাল গরু-ছাগলগুলো তাদের নয়। সবই পাশের গ্রামের মন্টু মহাজনের। তার কথা আমরা বুঝতে পারি না। জগেন খুলে বলে সবকিছু।
কড়ারা মহাজনের গরু-ছাগল লালন পালন করে। তাদের ভাষায় ‘মহাজনের গরু-ছাগল আধিবাড়ি’ করি। আধিয়ার থেকেই আধিবাড়ি। জগেন জানাল মহাজনদের কাছ থেকে তারা বাচ্চা অবস্থায় গরু-ছাগল এনে এরা নিজ খরচে লালন-পালনের পর বড় করে।  সেই গরু বা ছাগল যখন বাচ্চা দেয় তখন বাচ্চা রেখে তা ফিরিয়ে দিতে হয় মহাজনকে। কিন্তু কোনো কারণে বাচ্চা হওয়ার আগেই যদি কোনো পশু মারা যায়, তখন তাদের সব খরচ ও শ্রমই বৃথা হয়ে যায়।
হাসতে হাসতে জগেন জানাল আশপাশের মুসলমান বাঙালিরা সাধারণত কড়াপাড়ায় আসে না। তাদের সঙ্গে মিশেও না। পাছে তাদের জাত চলে যায়। কিন্তু তাদের গরু-ছাগলগুলো কড়ারা দীর্ঘদিন রেখে বড় করে দিলেও সে কারণে জাতওয়ালাদের জাত যায় না।
সুনিয়া কড়ার অনুরোধে তার বাড়িতে ঢুকে আমরা স্থির হয়ে যাই। ফুটো চাল আর ছনে ঘেরা ছোট একটি ঘরে জীবন চলছে সুনিয়ার। সে জানাল কড়া পাড়ায় মাঝে মাঝেই পদচারণা হয় এনজিও কর্মকর্তাদের। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় আদিবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনের। তাদের কথায় স্বপ্ন দেখে কড়ারা। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে এখন অন্যদের প্রতি কড়াদের মনে এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।
সুনিয়ার বাড়ির উঠানে মরে যাওয়া একটি তুলসি গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুলসির পাতাগুলো শুকনো ও কালো। তবুও  সুনিয়া  প্রতি সন্ধ্যায় তুলসি দেবতাকে ভক্তি দিয়ে সন্ধ্যাবাতি জ্বালায়। তার বিশ্বাস ভগবানের কৃপা পেলে তাদের ভাগ্য বদলাবে। সময় এগিয়ে যায় কিন্তু কড়াদের ভাগ্য আর বদলায় না। তুলসি গাছের মতোই কড়াদের জীবনের পাতাগুলোও কালো থেকে আরও বিবর্ণ হয়ে যায়।

ছবি: সালেক খোকন

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৫ মে ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button