আদিবাসী

ভাইয়ের ভালবাসায় প্রাণ ফিরে পায় বোনটি

আদিবাসী লোককথা

সন্ধ্যা নামছে। চারপাশের আলোও ম্লান হয়ে এসেছে। আমরা দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়, কড়া আদিবাসীদের পাড়ায়। আমাদের সঙ্গ দেন গোত্রের প্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া।

রাস্তার পাশেই মাটি আর ছনে ছাওয়া একটি বাড়ি। ভেতরে খুপরির মতো দুটি ঘর। হঠাৎ আদিবাসী ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে মাঝবয়সী এক যুবতী। নাম বাবলী কড়া। মাথায় তার ভরাট সিঁদুর। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বিনীত ভঙ্গিতে বলে ‘জোহার’। আমরাও মাথা নেড়ে হাসিমুখে জবাব দিই।

সমতলের অন্য আদিবাসীদের মতো কড়ারাও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিই তাদের আদি পেশা। কিন্তু সময়ের গতিতে পূর্বপুরুষদের সে পেশা তারা ধরে রাখতে পারছে না। অন্য নারীরা যখন মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকে, বাবলীর ব্যস্ততা তখন রেশম পোকা নিয়ে। রেশম চাষ করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। জীবনযুদ্ধের নানা কথা জানায় সে।

বাবলীর ঘর থেকে বেরোতেই চারপাশে আলোকছটা। পূর্ব আকাশে উঠেছে ঝলমলে চাঁদ। রাতকে ভুলিয়ে দেয় স্নিগ্ধ চাঁদের আলো। সে আলোয় অন্য রকম লাগে আদিবাসী পাড়াটিকে। মনে হয় যেন কোন কল্পগ্রাম!

হঠাৎ এক বাড়ি থেকে ভেসে আসে কোন এক নারী কণ্ঠ। মাহাতোকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অবাক হতে হয়। উঠানে গোটা পাড়ার শিশুদের যেন হাট লেগেছে। মাদুর বিছিয়ে তারা ঘিরে বসে আছে সত্তোর্ধ্বে এক বৃদ্ধাকে। তার নাম সুনিয়া কড়া। সবার দৃষ্টি তার দিকেই।

চোখের পলক যেন পড়ছেই না। শিশুদের শোনাবে বলে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছেন তিনি। পিনপতন নীরবতার মাঝে ভরাট কণ্ঠে গল্প বলা শুরু করেন সুনিয়া কড়া। চাঁদের আলোয় উঠোনে বসে আমরাও শুনি সে লোকগল্পটি। যার ভাবার্থ এমন-

সে অনেক আগের কথা। আদিবাসী গ্রামে ছিল এক পরিবার। বাবা-মা বেঁচে নেই। ছিল শুধু সাত ভাই আর এক বোন। ছোট ভাই ছাড়া বাকি ভাইরা সংসারী। কিন্তু বাড়ির রান্নাবান্নার সব কাজ করতে হতো একমাত্র বোনটিকে।

বোনও খুব পরিশ্রমী। ভাইদের জন্য সে কষ্ট করে হাসিমুখেই। বোনটি সবচেয়ে বেশি আদর করত ছোট ভাইটিকে। ছোট ভাইও তাই। আনন্দ-হাসির মধ্যেই কেটে যাচ্ছিল তাদের পরিবার।

একদিন ঘটল এক ঘটনা। শাকপাতা কাটছি বোনটি। হঠাৎ তার কানি আঙুল কেটে যায়। টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে। সে রক্ত গড়িয়ে গিয়ে পড়ে শাকপাতায়। রক্তমাখা শাকপাতা লাল হয়ে যায়। তা না ধুয়েই রান্না করে ফেলে বোনটি।

কাজ থেকে ভাইরা ফিরে আসে বাড়িতে। হাত-মুখ ধুয়েই খেতে বসে প্রতিদিনের মতো। কিন্তু ওইদিনের রান্না মুখে দিতেই তারা তো অবাক! অমৃতের মতো লাগে শাকপাতার রান্না। রান্না এতো মজা ও সুস্বাদু হলো কীভাবে? ভাইদের প্রশ্নে বোনের মনে পড়ে যায় আঙুল কেটে যাওয়ার ঘটনা।

বোনটি কড়া ভাষায় ভাইদের বলে, ‘হামার কেনি ইংরিয়ে কাটায় গেল লে। লোহু গিয়াল লে শাগোয়া মে।’ (আমার কানি আঙুল কেটে তার রক্ত গিয়ে পড়েছে শাকপাতার তরকারিতে)।

বোনের রক্ত এতো মজার! রান্নায় সে রক্ত খেয়ে লোভি হয়ে ওঠে ভাইরা। এ রক্ত আবারও খেতে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। কেউ কেউ ভাবে, ‘রক্তই যদি এতো সুস্বাদু হয়, তবে তো তার মাংস হবে আরও মজার!’ বোনের মাংস খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে তারা। গোপনে পরিকল্পনা করে, তাকে হত্যা করে মাংস খাওয়ার।

কিন্তু এসব পরিকল্পনার কিছুই জানতো না বোনটি। তার কাছে ভাইদের ভালবাসাই সব।

ভাইদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল ছোট ভাইটি। অন্য ভাইদের এমন পরিকল্পনায় সে রাজি হয় না। প্রিয় বোনকে রক্ষায় প্রতিবাদও করে সে। কিন্তু অন্য ভাইরা তাতেও পিছপা হয় না। বরং তারা তাকেও হত্যার ভয় দেখায়, হুমকিও দিতে থাকে। একসময় ভাইদের ভয়ে নিরুপায় হয়ে ছোট ভাইটিও বাধ্য হয় অন্যদের কথামতো কাজ করতে।

ভাইরা কীভাবে হত্যা করবে ছোটবোনকে? এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা আঁটে তারা। এরপর একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। সবাই মিলে মাঠের পাশের এক জায়গায় তৈরি করে নেয় বাঁশের উঁচু একটি মাচা। কড়া ভাষায়, মাচরি। উদ্দেশ্য, ওখানেই বোনকে নিয়ে বিজারের (তীর) আঘাতে হত্যা করবে।

এরপর ভাইরা বাড়ি থেকে বোনকে ডেকে এনে মাচায় উঠতে বলে।

কেন? বোনের প্রশ্নে ভাইরা বলে, ‘ওখান থেকে তুমি ফুপুর বাড়ি দেখতে পাবে।’ ফুপুর কথা শুনেই বোন আনন্দে মাচার ওপরে উঠে। ঠিক তখনই তীর-ধনুক নিয়ে তৈরি হয়ে নেয় ভাইরা। উপর থেকে ভাইদের হাতে তীর-ধুনক দেখে বোনটি অবাক হয়। ভাইদের হিংস্রতায় তার চোখে জল আসে। মুষড়ে পরে বোনটি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন জীবনরক্ষার চেষ্টার করবে না সে। বরং প্রিয় ভাইদের হাতেই হাসিমুখে জীবনটাকে উৎসর্গ করবে একমাত্র বোনটি।

নিচ থেকে একে একে ভাইরা ধনুক ছুড়ে তার আঘাতে বোনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু কিছুতেই তারা তার গায়ে লাগাতে পারে না। একেবারে শেষে ছোট ভাইটির পালা। যে ভাইটি বোনের অতি আদরের। সে চায় না  বোনকে মারতে। বরং কান্নায় ভেঙে পড়ে। অন্য ভাইদের হাতেপায়ে ধরে বোনের প্রাণভিক্ষা চায়। কিন্তু তাতেও পাষাণ ভাইদের হৃদয় কাঁপে না। তারা ছোট ভাইকেও মারার ভয় দেখায়। নিরুপায় হয়ে সে চোখ বন্ধ করে তীর থেকে ধুনক ছুড়ে দেয় বোনের দিকে। অমনি সে তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় প্রিয় বোনটির বুকে।

বোনের মৃত্যুতে ছোট ভাই মুষড়ে পড়ে। কিন্তু অন্য ভাইরা তখন ব্যস্ত থাকে মাঠের মধ্যে বোনের মাংস কেটে রান্না করায়। ছোট ভাইকে তারা পাঠায় বাড়িতে, ভাত আনতে। কিন্তু সে ভাতের সঙ্গে গোপনে নিজের জন্য রান্না করে আনে মাছ আর কাকড়া। মাঠে খেতে বসে অন্য ভাইরা যখন বোনের মাংস ছোট ভাইয়ের থালায় তুলে দেয়, সে তখন তা লুকিয়ে রাখে ছোট্ট একটি গর্তে।

অন্যরা যখন বোনের হাড্ডি খাচ্ছিল, ছোট ভাই তখন শব্দ করে কাকড়া খেতে থাকে। খাওয়া শেষে মাংস রাখা ওই গর্তটি ছোট ভাই মাটি চাপা দিয়েই বাড়ি চলে যায়।

কয়েক মাস কেটে গেলো। একদিন ওই পথে যাচ্ছিল ছোট ভাইটি। সে দেখল, ওই গর্ত থেকেই একটি সুন্দর বাঁশ গাছ হয়েছে। সেখান থেকে বাঁশ কেটে এনে সে একটি বাঁশি (মুরালি) বানায়। সে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই অন্য রকম সুর ওঠে।

বাঁশিটি বাড়িতে নেওয়ার পরই ঘটল অন্য ঘটনা। প্রতিদিন সকালে ছোট ভাই যায় কাজে। ফিরে এসে সে দেখে, কে যেন তার বাড়িঘর পরিষ্কার করে রান্নাও করে দিয়ে গেছে। ঠিক তার প্রিয় বোনটি যেমনটা করতো। সে ভাবল, হয়তো তার বৌদিরা এসব করেছে। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা না বলে। এতে সে চিন্তায় পড়ে যায়।

একদিন সে কাজে না গিয়ে লুকিয়ে থাকল। সে দেখল, ওই বাঁশি তার প্রিয় বোনের রূপ নিয়ে ঘরের সব কাজ করে দিচ্ছে। ছোট ভাই আঁতকে ওঠে। বোনকে দেখে তার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু মৃত বোন কীভাবে জীবিত হলো? এও কি সম্ভব! ভয়ে সে দৌড়ে অন্য ভাইদের বাড়ি গিয়ে সব খুলে বলে। ছোট ভাইয়ের কথা অন্য ভাইরা বিশ্বাস করেন না।

একদিন সকালে ছোট ভাই কাজে বের হয়। অন্য ভাইরা তখন গোপনে তার ঘরে গিয়ে ওই বাঁশিটিকে নিয়ে বড় একটি দিঘিতে ফেলে দেয়। একদিন পর তারা দেখল, দিঘির মধ্যে বাঁশিটি একটি সুন্দর পদ্ম ফুলের রূপ নিয়েছে। এবারও তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। বড় ভাই দিঘিতে নেমে পদ্মটি তুলে আনতে যায়। যতই সে এগোয়, ততই পদ্মটি চলে যায় মাঝ দিঘিতে। ফলে সেটি আনতে গিয়ে বড় ভাই দিঘির জলে ডুবে মরে। এভাবে পদ্মফুলটিকে আনতে গিয়ে একে একে ডুবে মরে অন্য ছয় ভাই-ই। বোনকে হত্যার পাপেই ডুবে মরে তারা।

খবর পেয়ে ছুটে আসে ছোট ভাইটি। সব শুনে সে দিঘিতে নামে। সে জলে পা দিতেই পদ্মটি চলে আসে তার খুব কাছে। সেটি সে স্পর্শ করতেই বোন হয়ে যায়। প্রিয় বোন তার হাত ধরেই উঠে আসে ডাঙায়। বোনকে ফিরে পেয়ে ছোট ভাই তখন মহাখুশি। ছোট ভাইয়ের ভালোবাসাতেই প্রাণ ফিরে পায় বোনটি।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৩ এপ্রিল ২০২০

#salekkhokon #adibashilokokotha

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button