আদিবাসী

গল্পের মতো মিথগুলো

মাঘের শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। এরই মধ্যে একটি খবর চমকে দেয় সবাইকে। এবার বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে এ দেশ থেকে। দেশের আনাচে-কানাচে এই নিয়ে তাই চলছে তুমুল আলোড়ন, চলছে গ্রহণ দেখার নানা আয়োজন। আবার ১০৫ বছর পরে এ দেশ থেকে দেখা যাবে এ রকম সূর্যগ্রহণ। তাই গ্রহণ দেখাটা রূপ নিয়েছে রীতিমতো উৎসবের।

সূর্যগ্রহণের দিনে দিনাজপুরের হালজায় গ্রামে ঢুকতেই আমরা হতবাক হয়ে যাই। চারদিকে মাদল, ঢোল আর আদিবাসী ভাষায় চিৎকারের শব্দ। আমরা ভাবছি কোনো পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে হয়ত। কিন্তু গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই দেখি অন্য দৃশ্য। গোটা পাড়ার সকলেই ধুপ জ্বালিয়ে, মাদল-ঢোল বাজিয়ে, বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘মামা, গাহানা ছাড়!’
এ গ্রামটিতে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বাস। সূর্যগ্রহণ চলায় গোটা পাড়ার সকলেই উপোস। উপোস অবস্থাতেই এই লোকাচার উৎসবে অংশ নেয়াই নিয়ম। কেন এই সূর্যগ্রহণ হয় সে বিষয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো কড়াদের রয়েছে আদি বিশ্বাস ও কাহিনী। গোত্রপ্রধান বা মহত জগেন কড়া বলতে শুরু করল সে কাহিনীটি।
‘মানবজাতি একবার খুবই অভাবের মধ্যে পড়ে। মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য চাই ধান। চন্দ্র এবং সূর্য মানুষের জন্য ধান দিতে অনুরোধ করে দোসাদ দেবতাকে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দোসাদ দেবতা ধান দেয় মানুষকে, তবে আবার ফেরত দিতে হবে এই শর্তে। কিন্তু সে বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মানবজাতি সে ধার আর পরিশোধ করতে পারে না। চন্দ্র ও সূর্য মানবজাতির পক্ষে সেই ধান ধার নিয়েছিল বলে দোসাদ দেবতা এখনো সুযোগ পেলেই চন্দ্র ও সূর্যকে আক্রমণ করে। এতে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ ঘটে।’
এ কারণেই কড়ারা মনে করে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় মানবজাতির দায়িত্ব তাদের বাঁচাতে ভগবানের সাহায্য প্রার্থনা করা।
চন্দ্র ও সূর্য কড়াদের মতো ওঁরাওদেরও দেবতা। ওঁরাও ভাষায়  বিড়িনাদ ও  চান্দুনাদ। চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি নিয়ে ওঁরাও বিশ্বাসে আছে প্রাচীন এক কাহিনী। বহবলদিঘির ওঁরাও গ্রামের মহত নিপেন টিগ্গা আধো কুরুক ও আধো বাংলায় জানাল কাহিনীটি:
“ধরমেশ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করল তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি। মানুষ চলাফেরা করার  সময়ই আকাশ মাথায় ঠেকত। একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে আকাশ উপরে উঠে গেল। এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলেও সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ। সে গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত। আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত তখন আবার অন্ধকার নেমে আসত।
সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, গাছটিকে কেটে ফেলে আলো উদ্ধারের।
গাছটিকে কাটা হলো। কিন্তু তার পরও সেটি মাটিতে পড়ছে না। দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল গাছটিতে রয়েছে চিলের বাসা। চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পড়বে না। তাই হলো। চিলটিকে মারার পর পরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গোটা পৃথিবী ।
সে দেশের রাজা ভাবল, শত্রুরা তার রাজ্য আক্রমণ করেছে। তিনি সৈন্য নিয়ে এসে দেখলেন মহুয়া গাছটি কাটা। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তির হুকুম দিলেন। উভয় পক্ষের সঙ্গে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। রাজার সৈন্য পরাজিত হলো।
অতঃপর গাছটিকে দুই ভাগ করে কাটা হলো। দেখা গেল নিচের দিকের বড় অংশটিতে সূর্য আর উপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র।
কিন্তু তাদের জীবনদান হবে কীভাবে?
আবারো দৈববাণী এলো। এক চাষির আদরের পুত্রকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেয়া হলো গাছের কাটা অংশে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল।”
সে সময় থেকেই ওঁরাওরা মনে করে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজী ও লাল। একইভাবে চন্দ্র মহিলা এবং সে কম রক্ত পান করেছিল বলে স্নিগ্ধ ও সাদা।মহেশপুরের সাঁওতাল গ্রামের মহত দালু সরেন। এরা একে অপরকে ডাকে ‘হর’ বলে। ‘হর’ অর্থ ‘মানুষ’। এদেরও আদি দেবতা সূর্য। সাঁওতালী ভাষায় ‘সিং বোঙ্গা’। সূর্য পূর্বদিকে উঠে বলেই পূর্বদিক সাঁওতালদের কাছে পবিত্র। তাই পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা পূর্বদিকে মুখ করে বসে।
কড়া, ভুনজার, ওঁরাও, তুরি, আর মু-া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘করমা বা কারমা পূজা।’ মূলত এটি গাছের পূজা। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের পূজা করে এরা। ভাদ্র-আশ্বিনের অভাবের সময়েই আদিবাসীরা আয়োজন করে এ পূজার। অভাবের সময় পূজা কেন? এ নিয়ে প্রচলিত আছে  অভিন্ন এক কাহিনী। হালজায়ের কৃষ্ণ কড়া জানাল সে কাহিনীটি।
‘কারাম আর ধারাম ছিল দুই ভাই। কারাম বড় আর ধারাম ছোট। তাদের একমাত্র আদরের বোনের নাম পারাবেতী। একবার ভাদ্র মাসে গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে ধান গাড়ার ‘হাউলি’র (কাজের বিনিময়ে খাওয়ার দাওয়াত) ডাক দেয়। গ্রামের অন্যান্যের সঙ্গে কারাম আর ধারামও যায় সেখানে। ভোরবেলা কিছু চারা লাগিয়ে সকালের নাস্তা বা পনতা (পানতা) খেতে দুই ভাই কলাপাতা নিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু কারাম আর ধারামের কাছে এসেই পানতা শেষ হয়ে যায়। পানতা খেতে না পেরে দুই ভাই বড়ই দুঃখ পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বড় ভাই কারাম ছোটকে সান্ত্বনা  দেয় দুপুরের খাবার পাওয়ার আশায়। দুই ভাই আবার কাজে ফিরে যায়। ধান গাড়া শেষ হলে দুপুরের দিকে  আবারো কলাপাতা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে বসে পড়ে লাইনে। কিন্তু এবারো ঘটল একই ঘটনা। তাদের পর্যন্ত এসেই খাবার শেষ হয়ে গেল। এবার তারা খুবই কষ্ট পেল। প্রচ- রাগে ও কষ্টে ছোট ভাই চাইল তার গাড়া ধানের চারাগুলো তুলে ফেলতে। বড় ভাই কারাম তাকে শান্ত করে বাড়ির দিকে রওনা হয়। পথেই তাদের দেখা হয় এক বট গাছের সঙ্গে। তাদের দুঃখের কথা শুনে বটগাছ বলে, ‘তোদের কারমা কপাল জেড় গেল’ (তোমাদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে)। সে উপদেশ দেয় সাত সমুদ্র লংকা পার হয়ে কর্মভাগ্য নিয়ে আসার। বটগাছের কথা বিশ্বাস করে কারাম আর ধারাম বাড়ি থেকে ক্ষুদভাজা নিয়ে রওনা হয় কর্মভাগ্য আনতে। কিছু দূর যেতেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় একটি কুলগাছের। কারাম-ধারামের কথা শুনে সেও জানায় তার  দুঃখের কথা। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসার জন্য দুই ভাইকে সে অনুরোধ করে। যেতে যেতেই কারাম-ধারামের দেখা হয় একটি ডুমুরগাছের সঙ্গে। ডুমুরগাছ তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে দুঃখ করে বলে তার সুদৃশ্য ফল পেকে যায় কিন্তু মানুষ ও পাখি সে দিকে ফিরেও তাকায় না। এ নিয়ে তার অনেক দুঃখ। সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী । নদীর তীরে দুটি হাতি মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে তারা জানে না আর কতদিন তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কাদায় ঢাকা থাকবে। দুই ভাইকে তারা অনুরোধ করে তাদের ভাগ্যটিও জেনে আসার। নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই কারাম-ধারাম লংকার সমুদ্রের কাছে এসে পৌঁছায়। বিশাল সমুদ্র পারি দেয়ার চিন্তায় তারা সমুদ্র পাড়ে বসে থাকে। সমুদ্রে একটি বড় কুমিরের গলায় সাতদিন ধরে কাটা বিঁধে থাকায় সে কারাম-ধারামের সাহায্য চায়। সমুদ্র পাড় করানো ও নিয়ে আসার শর্তে কারাম-ধারাম কুমিরের গলার কাটা বের করে দেয়। কুমিরের পিঠে চড়ে দুই ভাই লংকার সমুদ্র পার হয়েই দেখা পায় কর্মভাগ্যের। কর্মভাগ্যের সারা শরীর তখন পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম যখনই তা স্পর্শ করল তখনই সেটা গাছ হয়ে গেল। কারাম-ধারামের মধ্যে অন্য রকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে ফিরতে থাকল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে কারাম-ধারাম বলল তোমাদের এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে। হাতি দুটি তাদেরকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মিনতি করল। কারাম-ধারাম তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসল। এরপর ডুমুরগাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলল, তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলসি ধন আছে সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুরগাছ কারাম-ধারামকে সাত কলস ধন তুলে নেয়ার অনুরোধ করল। তারা সাত কলস ধন হাতির পিঠে তুলে নিল। কুলগাছের সঙ্গে দেখা হতেই কারাম-ধারাম তাকেও একই কথা বলল। সেও তার গোড়ার মাটির নিচের সাত কলস ধন তুলে নেয়ার মিনতি করল। কারাম-ধারাম তাই করল। এভাবে তারা কর্মভাগ্য নিয়ে সেই বটগাছের কাছে চলে আসল। বটগাছ লংকা পার হয়ে আনা কর্মভাগ্যরূপী গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে এনে পূজা করার নির্দেশ দিল। সে সময় থেকেই কারমা পূজার প্রচলন হয় এবং গাছটির নামকরণ হয় কারমাগাছ।’
আদিবাসীরা আজো বিশ্বাস করে কারমা পূজা তাদের অভাবমুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা।
নানা বিশ্বাসের মিথগুলো আদিবাসী সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। কাহিনীগুলোতে আদিবাসীদের মননশীল উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ যেমন ঘটেছে তেমনি আদিবাসী সমাজ ও সাহিত্যকে করেছে আকর্ষণীয়। দারিদ্র্যতা আর নানা বৈষম্যের শিকার আদিবাসীরা দিন দিন হারিয়ে ফেলছে নিজের জাতিসত্তাটুকুকে। ফলে নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে গল্পের মতো মিথগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button