আদিবাসী

ঘটককে বাঘে খায় না

আদিবাসী লোককথা

বলুন তো ‘ঘটককে কেন বাঘে খায় না?’ এমন প্রশ্নে আমাদের চোখ কপালে ওঠার দশা। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার ছাতনি পাড়ায় এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হই। প্রশ্নকর্তা বিমল মার্ডি। ষাটোর্ধ্ব এক সাঁওতাল বৃদ্ধ। আমরা নীরব থাকি। নীরবতা দেখে উত্তরে একটি লোককাহিনী বলা শুরু করেন তিনি।

এক কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের বাড়ি শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশ ও শিলদা থেকে আসা দুটি নদী। কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল জঙ্গলের ভেতর দিয়েই। সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব ছিল খুব। বাঘের সামনে পড়ে জীবন হারিয়েছে অনেকেই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী।

বিয়ের ঘটক থাকে দুজন। একজন কনেপক্ষের। আরেকজন বরপক্ষের। একবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কনেপক্ষের ঘটক নদীর ধার দিয়ে চুপিচুপি যাচ্ছিল বরের বাড়িতে। জঙ্গলের পথে ঢুকতেই দূর থেকে ঘটককে দেখে ফেলে এক বাঘিনী। কাছাকাছি আসতেই সে হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে ঘটকের ঠিক সামনে।

বাঘিনীকে দেখেই ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকে সে। কিন্তু আশপাশ থেকে কেউ-ই তাকে বাঁচাতে আসে না। আসবেইবা কীভাবে? বাঘিনীর সামনে আসার সাধ্যি কার!

ঘটককে পেয়ে বাঘিনীর সেকি আনন্দ। তাকে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলতে থাকে কিছুক্ষণ। এটাই বাঘদের নিয়ম। শিকারকে তারা সঙ্গে সঙ্গে খায় না।

এদিকে ঘটকের বুক ধুপ ধুপ করছে। চোখ তার বন্ধ। এই বুঝি বাঘিনী দাঁত বসাবে তার ঘাড়ে। জীবন বাঁচাতে নানা মন্ত্র পড়তে থাকে সে। কিন্তু তবুও কোনো কাজ হয় না।

একসময় ঘটককে নিয়ে বাঘিনীর খেলা শেষ হয়। এরপর সে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কে হে তুমি? এই জঙ্গল দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে?

বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পায়। ভয়ে ভয়ে সে উত্তর দেয়, মহারানী, আমি তো ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।

ঘটকের উত্তরে বাঘিনী বেশ অবাক হয়। ধর্মের কাজ, সে আবার কি! কেমন ধর্মের কাজ বলোতে হে?

ঘটক খুব সুন্দর করে বলে, মহারানী, আমি দুজন আলাদা লোককে এক করি। দুটি পরিবারকেও একত্রিত করার কাজেও নিয়োজিত থাকি।

ঘটকের উত্তরে বাঘিনী খুব আগ্রহী হয়। জানতে চায়, কেমন করে হয় সে কাজটি?

ঘটক বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দেই। আর যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করি মহারানী। এটাই আমার ধর্মের কাজ।

ঘটকের কথায় বাঘিনী আবেগতাড়িত হয়। তখন তার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। কত বছর ধরে সে একা আছে।

সে দুঃখ করে বলে, যদি তাই হয়, আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দিতে পারবে? ১২ বছর আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকেই আমি একা। দাও না একটা স্বামী জোগাড় করে।

সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হয়ে যায়। মনে মনে তখন বুদ্ধি আঁটে সে। বলে, অবশ্যই পারবো মহারানী। আপনি দেখতে কত ভালো। আবশ্যই স্বামী পাবেন। কিন্তু তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে।

ঘটকের কথায় আশ্বস্ত হয় বাঘিনী। তাকে বিশ্বাস করে সে। স্বামী পাবে। তাই মনে মনে ভীষণ আনন্দিত হয়। কিছু সময় পর সে ফিরে আসবে এমন শর্তে ঘটককে ছেড়ে দেয় বাঘিনী।

ঘটকের ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে যায় বরের সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। সেখান থেকে সে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিলো। তা সেলাই করার জন্য কিনলো একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যে কোনো বিয়েতে তারাই হলুদ বাটা ও পাতা বাছাইয়ের কাজটি করতো।

ঘটক সে বাড়ি খুঁজে বের করে, খুশি মনে তাদের গিয়ে বলল, যাও, একটা বিয়ের জন্য একটু হলুদ বেটে, পাতা বেছে, পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের খালা তৈরি করো। সেই খালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। পয়সা যা লাগবে, তোমরা পাবে। বুড়ো-বুড়ি আনন্দ নিয়ে তাই করল।

ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে যায় জঙ্গলে, বাঘিনীর কাছে।

ঘটককে আসতে দেখে বাঘিনী খুব আনন্দ অনুভব করে। কাছে এসে ঘটক বলে, মহারাণী, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।

শুনে সে তো মহা খুশি। ঘটক বলে, যদি আমাকে বিশ্বাস করো এবং বিয়ে করতে চাও, তবে তুমি এই বস্তার ভিতরে প্রবেশ করো।

বিয়ের আনন্দে বাঘিনীর মন আনচান করে। ঘটকের কথামতো বস্তার ভিতর ঢুকে পড়ে সে।

ঠিক তখনই সেই তেল-হলুদের খালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলে ঘটক। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তাই করে।

ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ওই বস্তাটিকে ভালোভবে সেলাই করে দেয়।

এরপরই বাঘিনীকে ঘটক বলে, মহারানী, নড়াচড়া করো না। তোমাকে বড় নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নিবে, তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিও।

এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।

সে দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামের পাশের জঙ্গলে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে দশ বছর আগে। সেই বাঘটি বান দেখতে প্রতিদিন নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে আসলেই, নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত।

সেদিনও বাঘ নদীর ধারে বসেছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে তীরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তা ছিঁড়তে যাবে ওমনি বস্তার ভিতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।

বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলে। ঠিক তখনই বাঘিনী মনের আনন্দে আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে আসে। বাঘিনী দেখে ওই বাঘ তো অবাক। বাঘিনী হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দেয় ওই বাঘের মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকে। এভাবেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।

ওই বাঘের বাঘিনী ছিল না। আবার বাঘিনীর জীবনেও ছিল না কোনো বাঘ। ঘটক তাদের এক করে দিয়েছে। ফলে সুখে-শান্তিতে কাটে বাঘ-বাঘিনীর বাকি জীবন।

এ কারণেই আদি থেকেই সাঁওতালরা মনে করেন, বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি থাকে। তাই ঘটককে কখনো বাঘেরা খায় না।

কথার পিঠে কথা চলে। কিন্তু একসময় তা একটি জায়গায় এসে থেমে যায়। সাঁওতাল সমাজে আজ বাসা বেঁধেছে সীমাহীন দারিদ্র্য। বৈষম্য ও সংখ্যাগুরু জাতির ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচার তাদের নিত্যসঙ্গী। টিকে থাকার লড়াইয়ে অনেকেই তাই ত্যাগ করেছেন পূর্বপুরুষদের জাতধর্মকে। ফলে কালপ্রবাহে হারিয়ে যাচ্ছে সাঁওতালদের মৌলিক সংস্কৃতি ও এমন সব বিশ্বাসের কাহিনীগুলোও।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১০ এপ্রিল ২০২০

#adibashilokokotha

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button