আদিবাসী

লোকবিশ্বাস ও সাঁওতাল বিবাহবিচ্ছেদ

বিয়ের সিঁদুর দান পর্ব দেখছিলাম আমরা। দিনাজপুরের একবারপুরে সাঁওতালদের আদি রীতি মেনেই বিয়ে হচ্ছে ফিলিপ টুডু ও রান্দন হাজদার মেয়ে ফুল মনি টুডুর। সিঁদুর দান পর্বটি যখন শেষ হলো তখন মধ্য দুপুর। এ সময় শুরু হয় কনের মা ও কনের মধ্যকার একটি বিশেষ আচার।

মেয়ের মা সিঁদুর, তেল, হলুদ, চাউলের গুড়ো মেয়ের মুখমণ্ডল, কপাল ইত্যাদিতে মাখিয়ে দেয় এবং মেয়েও তার মাকে মাখিয়ে দেয়। তখন মেয়ের বড় বোন একটা লাঠির মাথায় পাতায় করে বেঁধে আগুন এনে মায়ের হাতে দেয়। মা সে লাঠি একবার বাম হাতে নিয়ে ডান হাত আকাশের দিকে তুলে। একইভাবে ডান হাতে নিয়ে বাম হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে। এভাবেই এ পর্বটি শেষ হয়। অতঃপর বড় বোন এসে জল ঢেলে ওই আগুন নিভিয়ে দেয় এবং মা-কনে ও জামাতাকে মিষ্টি ও জল খাইয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।

সাঁওতাল সমাজে কনে বিদায়ের আগে বর পক্ষের কিছু লোক এবং কনে পক্ষের কিছু লোকসহ কনের বাবা মিষ্টি ও জল হাতে নেয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকে গ্রাম্য মোড়ল। সবার মধ্যে তখন মিষ্টি ও জল খাবারের পালা চলে। কনেপক্ষ তখন বরপক্ষকে তাদের মেয়েকে সুখে-শান্তিতে রাখার অনুরোধ জানায়। অতঃপর উভয় পক্ষ নবদম্পতির সুখময় জীবনের জন্য মারাং বুড়োর কাছে প্রার্থনা করে। এর পরই শুরু হয় কনে বিদায়ের অনুষ্ঠান। এ সময় সাঁওতালরা বিদায়ের গান ধরে-

আতো গাতি কুড়ি কোড়া

মায়া জালাং ছাড়া ফিঁদেই

ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে

ঈং রেনাং মায়া জালা মিনা

আনাং মেন খান।

কাদাম বাতে চাপা দিন পে

ত্রিয়ে ডুচিয়ে তে গেদু জিন পে

দেউড়ে চিতাং কুলি শহর নূর।

ভাবার্থ : গ্রামের যতো যুবক যুবতী আছে/ মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে/ ছিলাম আমি। এখন বোঙ্গার জালা/ ছিঁড়লো মায়া, আমার যাওয়ার পালা/ কদম ফুলে ইশারায় দিস্ ডাক/ আসবো আমি, মিথ্যে নয় এ হাঁক।

কনে নিয়ে বর গ্রামে এলে প্রতি বাড়ি বাড়ি চলে বর ও বধূকে মিষ্টি খাওয়ানোর পালা। এ সময় ধান, দূর্বা, চাল, সিঁদুর দিয়ে নবদম্পতিকে বরণ করা হয়। অতঃপর দুজনকে একত্রে বসিয়ে যে ঝুড়িতে কনেকে আনা হয়েছে সেই ঝুড়ি দুজনের ওপরে সাতবার ঘোরানো হয় এবং আগুনের তাপ দিয়ে হালকা সেঁক দেওয়া হয় তাদের গাল ও মুখে। এভাবেই সাঁওতাল বিয়েতে বর-কনেকে বরণ করে নেওয়া হয়।

সাঁওতাল বিয়ের নৃত্য

সাঁওতালরা কনে দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের শেষ পর্ব পর্যন্ত হাড়িয়া (প্রিয় পানীয়) ব্যবহার করে থাকে। হাড়িয়া ছাড়া এ আদিবাসী জাতির বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হয় না। এটি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। কনের বাড়িতে বরপক্ষকে হাড়িয়া দিয়ে বরণ না করলে তা অপমানের সমতুল্য হিসেবে ধরা হয়। এ ছাড়া বিয়ে বাড়িতে শুকর বা ছাগলের মাংস, গুড়-ভাত, আম, কলা প্রভৃতি খাবার দেওয়া হয়।

বিয়েবাড়িতে সাঁওতালরা ধামসা, মাদল, বাঁশি, বানাম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। অনেক জায়গায় কাঁসার থালাকেও বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিয়েতে ছেলেরা বাদ্যি বাজায় আর মেয়েরা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে মাদলের ছন্দে ছন্দে নাচতে থাকে। একের বাহুতে এরা বেঁধে নেয় অন্যের বাহু। একে দোন বা ঝিকা নৃত্য বলে।

সাঁওতালরা মনে করে সিঁদুর দান থেকে একটি সুখী পরিবার তৈরি হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজে সিঁদুরের ব্যবহারটি এসেছে মূলত আদিবাসী সমাজ থেকেই। হিন্দুদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ পুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ প্রভৃতিতে ঘট স্থাপনের কথা বলা হলেও কোথাও সিঁদুরের উল্লেখ নেই। বাংলার ভট্টভবদেব এবং পশুপতি পণ্ডিতসহ অনেকেই সিঁদুর দানের বিষয়ে পৌরাণিক কোনো শাস্ত্র খুঁজে পায়নি। ফলে সর্বপ্রথম পালযুগে ভট্টভবদেব এবং পশুপতি ভদ্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত প্রথানুসারে শিষ্ট সমাচারাৎ মারফত সিঁদুর দানের স্বীকৃতি দেয়। অথচ তারও বহু আগে থেকে স্বীকৃতি ছাড়াই আদিবাসী সমাজে সিঁদুর জনপ্রিয় ছিল। সিঁদুরের প্রচলন নিয়ে সাঁওতাল সমাজেও খুঁজে পাওয়া যায় নানা কাহিনী।

সাঁওতাল পরিবারগুলোতে স্বামীকে দেবতাতুল্য মনে করা হয়। তাদের গানেও এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে। যেমন :

নিঞগাঁ নাপুন সারি কান্দো বড়বারী

গতেঞ তালুক তুকু-এ বরোবারিক;

জিয়ী বো গে বারিক গাতিং গে নাতাঁ

জিয়ী বোগে বারিক গোতিং তিঙগুন

নিনান জিয়ী দোরো গতেন তাই রে।

ভাবার্থ : পিতা আর মাতা দেবতা সদৃশ;/ কিন্তু স্বামীর সমকক্ষ কে আছে?/ জীবনের সকল সুখ এবং দুঃখ/ একমাত্র স্বামীই ভাগ করে নিতে পারে;/ একমাত্র স্বামীই বিপদ রুখে দাঁড়াতে পারে।/ আমার গোটা জীবন স্বামীর হাতেই নির্ভরশীল।

এরা বিশ্বাস করে জলের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। যে অর্থে জলের অপর নাম জীবন সে অর্থে জলে রয়েছে অতিমাত্রায় জীবনসার। সাঁওতালরা মনে করে জীবনসার দিয়েই জীবনকে দীর্ঘায়ু করা যায়। এ কারণেই বিয়ের আচারে জলের ব্যবহার বেশি। বিবাহ-অনুষ্ঠানে কুলোতে ধান-দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। সাঁওতালরা মনে করে কুলো লক্ষ্মীর শূর্প অর্থাৎ যাতে সৌভাগ্য আসে। ধান-দূর্বা দীর্ঘায়ু ও নবদম্পতির সুখী জীবনের চিহ্ন বহন করে। আবার আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি অপদেবতাদের খাবার। সাঁওতাল বিয়েতে কনের আঁচলে যে ধান ও আতপ চাউল গচ্ছিত রাখা হয় তা পরে ঘরের চালে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। অপদেবতার খোরাক হিসেবেই তাদের কোপানল থেকে বাঁচতেই এমন আচার পালন করা হয়।

সাঁওতালদের বিয়েতে সিঁদুরদান উৎসবের পর বর ও কনে একত্র বসে খায় এবং একজনের মুখের খাবার মুখ থেকে বের করে আর একজনকেও খাওয়ানো হয়। এরা বিশ্বাস করে এতে দুই জনের আত্মা এক হয়ে যায়। তবে তাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে খাওয়া সেটিই প্রথম এবং শেষ। কেননা তাদের সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে খাওয়ার রীতি নাই। এছাড়া সিঁদুরদান উৎসবে রব ও কনে পরস্পরের কনিষ্ঠ আঙুল থেকে রক্ত বের করে সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে কিছুটা জিহ্বায় দেয় এবং বাকী অংশ কনের কপালে পরিয়ে দেয়। এদের কাছে সিঁদুর যৌনতা ও বিজয়ের চিহ্ন।

আবার এরা বিয়ের নির্ধারিত দিনে যদি জ্বালানি কাঠ ভর্তি গাড়ি কিংবা কোন শিয়ালকে ডানদিক থেকে বামদিক যেতে দেখে তবে সেদিনের জন্য যাত্রা স্থগিত রাখে। তাছাড়া কোন গাভীর মৃতদেহ দেখলেও তারা আর যাত্রা করে না। তবে কোন লোকের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কিংবা ভরা কলসী দেখলে যাত্রা শুভ বলে মনে করে।

সাঁওতাল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা

নবদম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখের এবং পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে সাঁওতালরা পালন করে এক ধরনের রীতি। বিয়ের পর কনে যখন শ্বশুর বাড়ী রওনা হয় তার আগে তাদের যেতে হয় পার্শ্ববর্তী নদী বা পুকুরে স্নান করতে। কনে যাবে আগে এবং বর তার পেছনে পেছনে। বরের হাতে থাকবে তীর ধনুক। নববধূ স্নান সেরে কলসিভর্তি পানি নিয়ে ডাঙায় ওঠে এবং বর তার কাঁধে আস্তে করে হাত রেখে তীর ছুড়বে সামনের দিকে। অতঃপর দুজন হাঁটতে হাঁটতে আসে তীরের কাছে। কনে পায়ের আঙুল দিয়ে তুলে সেই তীর দেয় স্বামীর হাতে। পানিভর্তি কলস তখনো থাকে কনের মাথার ওপরে। এই নিয়মের মধ্যে দুটো বিশ্বাস রয়েছে। প্রথমত তীর ছুঁড়ে অপদেবতার চক্ষু নষ্ট করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত নববধূ যে স্বামীকে হাত, পা ও মাথার সাহায্যে আজীবন সহায়তা করবে তার প্রমাণ মাথায় কলস ভরা জল, হাত দিয়ে কলস ধরে রাখা এবং পা দিয়ে স্বামীকে তীর তুলে দেওয়া।

সাঁওতালদের বিশ্বাস বাল্যকালে কোনো ছেলে বা মেয়ের ওপরের মাড়িতে যদি প্রথম দাঁত ওঠে তবে তার ওপর দেবতার কুনজর থাকে। আর এই কুনজর থেকে রক্ষা পেতে তাকে প্রথমে কুকুর বা শেওড়া গাছ অথবা মহুয়া গাছের সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। এই ধরনের বিয়েকে সাঁওতালি ভাষায় যথাক্রমে শেতা বাপলা, দাইবান বাপলা, মাতকোম বাপলা বলে। তবে বর্তমনে এ ধরনের বিয়ের প্রচলন নেই বললেই চলে।

সাঁওতাল সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ব্যক্তিগত কারণে বিবাদ তৈরি হলে তালাক প্রথা চালু রয়েছে। স্ত্রীকে স্বামী তালাক দিতে চাইলে তাকে কুড়ি টাকা জরিমানা প্রদানসহ বিশেষ আচারের মাধ্যমে তালাক দেওয়া হয়। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী উপস্থিত হয়ে স্বামী তালাক ঘোষণা করেন এবং শালপাতা টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেন। শালপাতা ছিড়ে ও পানি ফেলে দিয়ে মূলত প্রতীকী অর্থে সম্পর্কচ্যুতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

একইভাবে যদি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় তবে গোত্র প্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তাকে পণের সমস্ত টাকা পরিশোধ করে এবং একই রীতি অনুসরণ করতে হয়। যদি স্বামী জরিমানার টাকা কিংবা স্ত্রী পণের টাকা পরিশোধ করতে না পারে সেক্ষেত্রে কারো তালাক সম্পন্ন হয় না।

সাঁওতাল সমাজে বিধবা নারী ও তালাকপ্রাপ্তদের দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রচলন রয়েছে। আবার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে। আবার অবিবাহিত যুবক যদি বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করতে চায় তবে তাকে প্রথমে একটি ফুলকে বিয়ে করতে হবে। অতঃপর সেই ফুলটি সিঁদুররাঙা করে মহিলাকে দিতে হবে। তবেই তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করতে পারে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩১ মে ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button