আদিবাসী

ধাঁধার পরে ধাঁধা চলে

লোহাডাঙ্গায় আজ মানুষের ঢল। নানা সাজপোশাকে, নানা ঢঙের মানুষ। প্রতি ভাদ্রের পূর্ণিমা তিথির পরদিন এ রকমই ঢল নামে এখানে। দিনাজপুরের লোহাডাঙ্গায় মূলত তুরি আদিবাসীদের বাস। এ সময়টায় এরা ধুমধামের সঙ্গে স্মরণ করে মনসাকে। তুরিদের কাছে মনসা হলো বিষহরী। জিন্দা দেবতা। বিষহরী পূজার পরদিন বিকেলে এখানে আয়োজন চলে ‘তুমরি’ খেলার। এটি আদিবাসীদের প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র খেলা। আশপাশের উপজেলা থেকে নামকরা সব ওঝা অংশ নেন এ খেলায়। ওই দিন রাতেই তুরি গ্রামে চলে নাচ-গান আর ধাঁধার আসর। একই সঙ্গে প্রিয় পানীয় হাড়িয়া আর চুয়ানি বাড়িয়ে দেয় আদিবাসীদের আনন্দকে।

ধাঁধা লোকসাহিত্যের প্রচীন এক শাখা। ‘ধন্দ’ শব্দ থেকে ধাঁধা শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ দাঁড়ায়, সংশয় বা দুরূহ সমস্যা। এটি মূলত একটি জিজ্ঞাসা। মূল বিষয়কে আড়াল করে শব্দের জাল বুনে তা করা হয়ে থাকে। ফলে উত্তরদাতাকে চিন্তা করে বা মাথা ঘামিয়ে উত্তর দিতে হয়।

সাঁওতাল, ওঁরাও, কড়া, ভুনজার—নানা আদিবাসীর ভাষা জাতিভেদে ভিন্ন হলেও প্রায় সবাই কথা বলে সাদরী ভাষায়। ফলে এক জাতির লোক অপর জাতির সঙ্গে কথা বলতে পারে সাবলীলভাবেই।

এই গ্রামের তুরি গোত্রের মাহাতো বা গোত্রপ্রধান লবানু শিং। নিয়ম মেনে এরা পুরুষদের নামের শেষে ‘শিং’ এবং মহিলাদের নামের শেষে ‘বালা’ বা ‘দেবী’ পদবি হিসেবে ব্যবহার করে। লবানুর বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে আয়োজন চলছে গান-নাচ আর ধাঁধার আসরের। তুরিদের আমন্ত্রণে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মাহাতো ও বেশ কিছু বয়োজ্যেষ্ঠও এসেছেন এই আনন্দ আসরে।

আমরা বসে পড়ি উঠানের এক কোণে। টুংটাং শব্দে বাজা মাদল আর ঢোল হঠাৎই যেন প্রাণ পেয়ে যায়। দরদি কণ্ঠে বিষহরীর গান ধরেন লবানু শিং :

‘সাইয়া পাড়া লোক দুর্গা

মোর বাজে গাইয়ো গো

সাদ গুরু বান্দা মাইগে

জয়া বিষহরী…। ’

বিষহরীর গান শেষে খিরোবালা ধরেন কারমা পূজার গান। ভাদ্র মাসে যখন চারদিকে কাশফুল ফোটে, তখন শ্বশুরবাড়িতে থাকা মেয়েদের মনে আনন্দের ঢেউ ওঠে। মেয়েরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে, কবে তাদের বাবা বা ভাই আসবে কারমা পূজায় তাদের নিয়ে যেতে। তুরি ভাষায় খিরোবালার গানটি :

‘কাশি ফুলা ফুটেই গেলে

আসা মরা লাগি গেলে

ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক

কারমা পূজাকে রাতে…।’

খিরোবালার গান থামতেই সবাই চুপ হয়ে যান। কড়া আদিবাসীদের প্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া একটি ‘ভান্তা’ বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ধাঁধাকে কড়া ভাষায় বলে ভান্তা। কড়া ভাষায় ধাঁধাটি :

‘ঘার হতো দুয়ার নাকলো’

যার ভাবার্থ হলো : ঘর আছে দুয়ার নাই।

উত্তরে তুরি গোত্রের লবানু ‘ডিমা’ (অর্থ : ডিম) বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।

বিজয়ের আনন্দে তুরিদের মধ্যে হৈ-হৈ রব ওঠে।

একপাশ থেকে সেড়তি কড়া বললেন, ‘দাশটা মারত রাগদেলকে, দুটা মারত পাকারকে মারকে।’

এর উত্তর বলতে পারলেন না কেউ। সবাই চুপ।

কেউ না পারায় সেড়তির মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। হাসতে হাসতেই উত্তর দিলেন তিনি, ‘ঢিলা বাছা।’

মানে উকুন আনা, দুই হাতের দশ আঙুল থাকলেও উকুন মারা হয় দুই আঙুল দিয়ে।

নিপেন টিগ্গা এসেছেন বহবলদীঘি থেকে। ওঁরাও গোত্রের প্রধান বা মাহাতো তিনি। ধাঁধার টানে কিছুটা নড়েচড়ে বসেন। অতঃপর আসরে ছুড়ে দেন একটি ধাঁধা :

‘হাত হায়তো গড় নেখে

খেঁচা হায়তো মুড়া নেখে

আবেদিনকে আগে দানে পালে, গিলকে খাত্রলা।’

যার ভাবার্থ : হাত আছে গলা নাই। শরীর আছে মাথা নাই। সামনে যদি মানুষ পায়, অমনি ধরে গিলে খায়।

নিপেনের ধাঁধায় সবাই নিশ্চুপ। কেউ কেউ মাখা কচলাচ্ছেন। তবুও যেন উত্তর বের হচ্ছে না। আগত ওঁরাওদের মুখে বিজয়ের হাসি। মুচকি হেসে নিপেন ধাঁধার উত্তরে বলেন, ‘জামা’।

রাত বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে জমে ওঠে ধাঁধার আসর। মাঝেমধ্যেই চুয়ানি আর হাঁড়িয়া খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিচ্ছে সবাই। সাঁওতাল গোত্রের বাঠু সরেনের মুখে এবার ধাঁধা ফোটে :

‘সিংহো রাপারাপা

নউমি রাপারাপা

আসুন্ধি লেইমে কুদুম কুড়ি।’

যার ভাবার্থ : দিনে পাখা খোলা, রাতেও পাখা খোলা।

সবাই একেবারে চুপচাপ। পাশ থেকে নিপেন টিগ্গা বলে ওঠে ‘বাকাডুলি’। বিজয়ের আনন্দে সবাই হৈ-হুল্লোড় করতে থাকে। আমরা এর অর্থ বুঝে উঠতে পারলাম না। পাশে বসা এক আদিবাসী বললেন, এর অর্থ ‘ফড়িং’।

এবার কড়া সম্প্রদায়ের সুনিয়া কড়া বললেন আরেকটি ধাঁধা, ‘ভুরুত পাংখি, একজন ডুবেলকে দুজন সাক্ষী।’

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেন লবানু শিং। এটি হচ্ছে সেচ দেওয়ার জন্য টিনজাতীয় বালতি বিশেষের দু’দিকে দড়ি বেঁধে দুজন টেনে ধরা, অর্থাৎ সেচ দেওয়া।

ধাঁধার ফাঁকে খিরোবালা পূজার গান ধরেন।

‘করম ডাল, করম ডাল

চল শ্বশুরালয়ে

ভাদ্র মাসে বিয়া হতে গো

আনে ঘুরায়ে।’

গান শেষেই ওঁরাও গোত্রের নিপেন বলেন আরেকটি ধাঁধা।

‘সাননি বা আকি কিচড়ি কুড়ি

কোহা পারদি হোলে লাংটা মানি।’

এর ভাবার্থ : ছোটকালে কাপড় পরে, বড় হলে নেংটা ধরে।

নিপেন এবার হেরে যান। বাঠু সরেন বিজয়ী মুখে উত্তর দেন। এটি হচ্ছে ‘বাঁশ’।

নিপেন কিছুটা রাগান্বিত। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছুড়ে দেন আরেকটি ধাঁধা :

‘অন্টে খুঁটা আটটা চাল’

এর ভাবার্থ : একটি খুঁটি আটটি চাল।

সবাই এবার চুপ। হাসতে হাসতে নিপেন উত্তরে বলেন, ‘ছাতা’।

কড়া গোত্রের জগেন কড়া বলেন আরেকটি ধাঁধা :

‘রামার বেটি

খোলে পেটি।

বিনা কদারে খুঁড়েলকি মাটি।’

হাত উঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেন তুরি সম্প্রদায়ের লবানুর ভাই সবানু শিং।

এর অর্থ হলো : শূকরের মুখ দিয়ে মাটি খোঁড়া।

শঙ্কর টিগ্গা বসে ছিলেন কিছুটা গোমরা মুখে। ওঁরাও গোত্রের একসময়কার মাহাতো বা গোত্রপ্রধান ছিলেন তিনি। বয়সের ভারে শরীর যেন নুয়ে পড়েছে তার। কাশি দিয়ে গলাটা ঠিক করে নিলেন তিনি। এরপর সবার উদ্দেশে ছুড়ে দেন একটি ওঁরাও ধাঁধা :

‘শুইলে কা আলি

খাইলে বারয়ি।’

এর ভাবার্থ : সোজা যায়, সোজা আসে।

এবার ধাঁধার উত্তর দেন তুরি গোত্রের খিরোবালা। হাসিমুখে বলেন, এটি হচ্ছে ‘খাননে’ অর্থাৎ চোখ।

কড়া সম্প্রদায়ের সুনিয়া কড়া আয়েশ করে চুয়ানি খাচ্ছেন। খেতে খেতে তিনি বলেন কড়াদের একটি ধাঁধা :

‘তয় রাহামে খালমে

হাম রাহাবো ডালমে

এক সাঙ্গে দেখা হতো মরণ কালমে।’

সুনিয়ার ধাঁধা শুনে সবাই মুচকি হাসেন। কিন্তু উত্তর দিতে পারেন না কেউ। হাসতে হাসতে তিনি বলেন এর অর্থ, মাছের তরকারি, অর্থাৎ মাছ আর মরিচের দেখা হয় রান্নার সময়।

সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি ধাঁধা বলেন তিনি :

‘কাটা উপার কাংনা

ঝলেক রাহে আংনা।’

এর ভাবার্থ : কাটার ওপর আগুন জ্বলে, চারদিক আলোকিত করে।

এবারে শঙ্কর টিগ্গা উত্তরে বলেন, ‘দিয়া’, অর্থ প্রদীপ।

ধাঁধার পরে ধাঁধা চলে, আমরা চলি ফিরতি পথে। নিস্তব্ধ রাতে বেজে চলে আদিবাসীদের ঢোল-মাদলের বাদ্যি।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে, প্রকাশকাল: ৩০ মে ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button