আদিবাসী

আদিবাসী উৎসব : চৈতবিসিমা সিরুয়া বিসুয়া

সবার মনে যেন আনন্দের দোলা লেগেছে। একদিন পরেই পয়লা বৈশাখ। লোকসকল ছুটছে মার্কেটের দিকে। শোপিস আর কাপড়ের দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। প্রিয়জনের জন্য উপহার কিনছে সবাই। মাইকে মাইকে ঘোষণা  চলছে নানা অনুষ্ঠানের আগাম খবরের। কাঁচা বাজারেও দেখি মানুষের জটলা। দু’একটা ইলিশ হাতে ঝুলিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে কেউ কেউ। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান  সব ধর্মের লোকই ব্যস্ত বৈশাখ নিয়ে। কোন ভেদাভেদ নেই। নেই কোনো মতভেদ। সবার কাছে বৈশাখ মানেই আনন্দ। বৈশাখ কোনো ধর্ম উৎসব নয়। বৈশাখ হলো বাঙালির প্রাণের উৎসব।

দিনাজপুর শহরেও বৈশাখের তোড়জোড় চলছে।
‘পানতা, ইলিশ, নাগরদোলা
বটের ছায়ায় বৈশাখী মেলা
রাতভর  কবিগান
বাউলেরা গেয়ে যায় – মানুষেরই জয়গান।’
আদিবাসীদের বৈশাখ দেখব সে পরিকল্পনা নিয়েই এসেছি দিনাজপুরে। বন্ধু কাজিম উদ্দিনের বাড়ি দিনাজপুর শহরে। কাছাকাছি আদিবাসী পাড়াগুলো তার চেনা। তার সঙ্গে পরিকল্পনা সেরে নেই আগের দিন রাতেই।
খুব ভোরে কাজিমের মোটরসাইকেলে চেপে আমরাও রওনা হই কালিয়াগঞ্জ আর বহবলদীঘির দিকে। বৈশাখের প্রথম প্রহরে রাস্তার পাশে নানা সাজ-পোশাকে বাঙালিদের ভিড়। কোথাও কোথাও লেগেছে বৈশাখী মেলা। সবকিছু পেছনে ফেলে আমরা চলে আসি বহবলদীঘিতে।

 পূজার আনন্দে নাচছে একদল আদিবাসী
পূজার আনন্দে নাচছে একদল আদিবাসী

এখানকার  ভুনজার পাড়ায় কোনো বৈশাখী আয়োজন চোখে পড়ল না। বিশটির মতো ভুনজার সম্প্রদায়ের আদিবাসী পরিবার আছে বহবলদীঘিতে। এদের বাড়িগুলোর অবয়বই বলে দেয় ভুনজারদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা। একটি বাড়িতে ঢুকে দেখি তুলসি গাছের পাশে মাটিতে বেশ কয়েকটি সিঁদুর ফোঁটা দেয়া। বেশকিছু ফুলও পড়ে আছে সেখানে। বোঝা যায় একদিন আগেই এখানে পূজার আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে।
মহৎ বা গোত্র প্রধানের খোঁজ করতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন জানালাবিহীন একটি ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক বৃদ্ধ। বয়স ষাটের মতো। হাসিমুখে পিঁড়ি টেনে আমাদের বসতে দেয় সে।
নাম তার বাতাসু ভুনজার। বহবলদীঘির  ভুনজার গোত্রের মহৎ সে। এখানে আছেন  পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই। বৈশাখে কি ভুনজারদের কোনো উৎসব হয় না? প্রশ্ন করতেই বাতাসুর হ্যাঁ-সূচক উত্তর। সে জানালো বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবেই  গোত্রের সবাই আজ দলবেঁধে বেরিয়েছে শিকারে। বাতাসুর কথায় আমরা খানিকটা অবাক হই। কিছুটা থেমে থেমে বাতাসু বলতে থাকে ভুনজারদের বৈশাখের কথা।
আদিবাসী ভুনজাররা পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে চৈত্র মাসের শেষদিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বিশেষ পূজা আর আচারের মাধ্যমে পালন করে আসছে। ভুনজারদের ভাষায় এটি চৈতবিসিমা উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিন এরা বাসন্তী পূজা করে থাকে। কেন এই পূজা? প্রশ্ন করতেই বাতাসুর উত্তর- ‘বাপ-দাদারা পূজেছে, তাই পূজি’।
বাসন্তী পূজা নিয়ে ভুনজারদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে কিছু আদি বিশ্বাস। এক সময় যখন চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্তে মারা যেত শত শত আদিবাসী। এই দুটি রোগ থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা চৈত্রের শেষ সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে পূজা করে। বাতাসু জানাল বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির জন্য এই পূজা করা হতো বলেই এর নামকরণ হয়েছে বাসন্তী পূজা।
এ পূজায় একটি মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পূজা দেয়া হয়। কেউ কেউ এইদিনেই বলি দেয় মানতের  হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা।  এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার এরা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও  রুজি বৃদ্ধি। বিনা লবণে আতপভাত খেয়ে উপোস শুরু। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই ফলমূল আর দুধ।
বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা সবাই কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে ওঠে। বাতাসু জানাল সে কারণেই গত রাতে চলেছে খ্যামটা নাচ আর হাঁড়িয়া খাওয়া। বাতাসু ভুনজারের বিশ্বাস প্রতি চৈত্রে এই পূজার কারণেই তাদের গোত্রে এখন আর ডায়রিয়া কিংবা বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হয় না।
কথায় কথায় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রবি ভুনজার। বাতাসুর ছেলে সে। কথা বলছে বেশ চেঁচিয়ে। আমাদের দেখে খানিকটা লজ্জিত  হয়। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তার কথা খানিকটা জড়িয়ে যাচ্ছিল। গতরাতের বাসন্তী পূজার হাড়িয়ার নেশা তার তখনও কাটেনি। কেমন মজা করলেন। বলতেই সে ভুনজারদের খট্টা ভাষায় গেয়ে ওঠেন খেমটা নাচের  একটি গান :
‘কেলা গাছে আয়না টাঙ্গাবে রে
কালো তরী মনো না ভুলারে
হে হাগলে হাগলে…
রবির গান থামতেই বাতাসু আবার কথা শুরু করে। বাঙালিদের মতো বৈশাখে আদিবাসীরা তাদের প্রিয়জনকে নতুন কিছু উপহার না দিলেও বৈশাখের সকালে তারা সবাই মিলে পোনতা (পানতা ভাত) খায়। তবে পানতার সাথে মিলে না কোন ইলিশের টুকরো। পূর্বপুরুষের আমল থেকেই চৈতবিসিমার অংশ হিসেবে ভুনজাররা বৈশাখের সকালে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পানতা খাওয়া। এদের বিশ্বাস বৈশাখের প্রথমে পানতা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পায় না। তাছাড়া পানতার পানি তাদের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে।
বৈশাখের প্রথমদিন ভুনজাররা কাজে না গেলেও তীর ধনুক আর কোদাল নিয়ে তারা দলবেঁধে শিকারে বের হয়। সন্ধ্যা অবধি শিকার করে নিয়ে আসে ধুরা, কুচিয়া আর ইন্দুর। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে শিকারগুলো দিয়ে রান্না হয় খিচরি (খিচুড়ি)। রাতভর চলে আনন্দফুর্তি  আর হাড়িয়া খাওয়া। বাঙালির বৈশাখের আয়োজনকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করলেও আদিবাসী সংস্কৃতিতে খেমটা আর ঝুমের নাচ এখনও আদি ও অকৃত্রিম।
দুপুরের দিকে আমরা ভুনজার পাড়া থেকে বের হয়ে কালিয়াগঞ্জের পথ ধরি। রবি ভুনজার তখনও থেমে থেমে গান গাইছে। চলতে চলতে কানে বাজে আদিবাসী সে গানের সুরটি :
‘পানের ডেলা পানে রইলো
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল
হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে…’
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পার হতেই বিশাল শালবন ঠেকে। লাল মাটির পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের ক্যাম্পকে পেছনে ফেলে আমরা চলে আসি শালবনের একেবারে ভেতরে। চারপাশে গা ছমছমে পরিবেশ। খুব কাছেই সীমান্ত। খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছিল। পাছে ফেলানির মতো অবস্থা হয় আমাদের।
কচি কচি পাতা গজিয়েছে গোটা বনে। বন্ধু কাজিম জানাল কয়েকদিন পরেই শালগাছে আসবে ফুল। আর তখন এ অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের মনে আনন্দের ঢেউ লাগবে। শালফুলকে বরণ করবে সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসী। সাঁওতাল ভাষায় এটি বাহাপরব উৎসব। বাহাপরবের আগে আদিবাসী নারীরা নাকি কোন ফুলই ব্যবহার করে না।
বনের ভেতরেই একটি আদিবাসী পাড়ার সামনে আমরা থামি। পাড়াটি মুন্ডা পাহানদের। মাটি আর ছনের আদিবাসী ঘরগুলোর একপাশে গহিন শালবন। আর অন্যপাশের মাঠ পেরোলেই কালো কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে সবুজ পাহান। তাকে নিয়ে আমরা পাড়াটি ঘুরে দেখি।

লাল নিশান আর ধুপকাঠি ঝুলিয়ে এভাবেই মঈনকাটা গাছের সামনে চৈতালি পূজা করে মুন্ডারা
লাল নিশান আর ধুপকাঠি ঝুলিয়ে এভাবেই মঈনকাটা গাছের সামনে চৈতালি পূজা করে মুন্ডারা

মুন্ডাদের দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে তখন। সবুজ পাহান জানাল বৈশাখের রীতি অনুসারে তারা ভাতের সাথে খেয়েছে ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি দিয়ে। আদিবাসী ভুনজারদের মতোই এরা সকালে খেয়েছে পানতা ভাত।  আর সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে চলবে নাচগানের আসর।
সবুজের দাদা শ্যামল পাহান। বয়স সত্তরের মতো। একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে তার সাথে কথা চলে আমাদের।
কেন পানতা খান? প্রশ্ন করতেই তিনি  আদিবাসী  সুরে গান ধরেন :
‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই
পনতা ভাত ভালোবাসি…
তার গানে আমরা বেশ মজে যাই। কথা চলে চৈত্র-বৈশাখের নানা উৎসব নিয়ে।
বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিনেও মুন্ডা পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। ঐদিন এরা বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রঙ ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রঙ দেয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। মুন্ডারা বিশ্বাস করে এতে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে মুন্ডারা বলে সিরুয়া বিসুয়া।
শ্যামল পাহান জানাল এ ছাড়াও এরা চন্দ্র হিসাব মতে চৈত্রমাসেই আয়োজন করে চৈতালিপূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপা লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরেরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙ্গাই নিয়ম। মঈনকাঁটা বা বেল গাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপ কাঠি টাঙ্গিয়ে, পান, সুপারি, দুধ, কলা, দূর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সাথে বলি দেয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে খিচুরি খাওয়া। রাতভর চলে হাড়িয়া খাওয়া আর নাচগান।
এরই মধ্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। হাড়িয়া খেতে খেতে মুন্ডারা শুরু করে নাচগানের পর্বটি। বৈশাখের আনন্দে বেজে ওঠে আদিবাসীদের মাদল আর ঢোলগুলো। পাশের শালবনের ভেতর ঝি ঝি পোকার ডাক। মাঝে মাঝেই ডেকে উঠছে দু’একটা শেয়াল। এরই মাঝে আমরা ফিরছি। দূর থেকে ভেসে আসছে আদিবাসী গানের সুর। আমিও কান পেতে রই। হঠাৎ যেন হারিয়ে যায় সব সুর। আমরাও মিশে যাই লোকালয়ে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৮ এপ্রিল ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button