মুক্তিযুদ্ধ

গ্রিন রোড মিশন

একাত্তরে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো গ্রুপ ছিল। এখানে গেরিলা অপারেশনে ঝুঁকি ছিল বেশি। কিন্তু তার প্রভাবও ছিল বেশি। বিশ্ব গণমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের খবরগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত। অন্যান্য জায়গার মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো লম্বা পথ পেরিয়ে অপারেশন করতেন। কিন্তু এরপরই তারা ফিরে আসতেন সেইফ জোনে। কিন্তু ভেতরেই আত্মগোপন করে থাকতে হতো, যা সব সময়ই ছিল মারাত্মক ঝুঁকির।

১৯৭১-এ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনগুলো কীভাবে হতো? তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল? এমন প্রশ্নগুলো নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান (বীরপ্রতীক) এর মুখোমুখি হয়েছিলাম একবার। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে এই মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা অপারেশন করেন ঢাকার গ্রিন রোড, ওয়াটার বোর্ডের অফিস, ক্রিসেন্ট রোডে নিউ মডেল স্কুল (তখন সেখানে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিল), লালবাগ থানা আক্রমণ (থানাটি তখন ছিল সায়েন্স ল্যাবের পুলিশ বক্সের পাশে), সেন্ট্রাল রোডে এক বিহারির বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায়।

একাত্তরে গেরিলাদের সবচেয়ে বড় অপারেশনটি হয় গ্রিন রোডে। যার খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে। সে খবর উদ্দীপ্ত করে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। ওই অপারেশনটির পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন গেরিলা শেখ আবদুল মান্নান (বীরপ্রতীক)। সেদিনের আদ্যোপান্ত শুনি তার মুখেই। তার ভাষায়- ‘‘পরিচয় গোপন করে আমরা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম সেন্ট্রাল রোডে, ভূতের গলি মসজিদের পাশে। ওই এলাকায় তখন স্যুয়ারেজ লাইন হচ্ছে। তাই পুরো এলাকার মাটি খোঁড়া। হেঁটে চলাচল করা ছাড়া উপায় নেই। ফলে নিরাপদ ভেবে আমরা আত্মগোপনের জন্য ভূতের গলি এলাকাটাই বেছে নিয়েছিলাম।

ইনফরমার ছিল। ওদের খবরের ভিত্তিতেই রাতে বেরিয়ে গেরিলা অপারেশন চালাতাম। নির্দেশ ছিল ‘প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনাদের ডিস্টার্ব করার। সেটা গ্রেনেড মেরে হোক কিংবা ফায়ার করেই হোক। ইউ মাস্ট ডু সামথিং।’

একটা বিল্ডিংয়ের ওপর বসে এক রাতে দেখছিলাম আশপাশটা। দেখলাম রাত ৯টার পর কোনো লোকজনের চলাচল নেই। শুধু পিআই-এর লোকজন আর আর্মি মুভমেন্ট চলছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিই গ্রিন রোড অপারেশনের।

অপারেশনটা কোথায় করব? খুঁজে বের করলাম নুর হোটেলকে। যেটা এখন ক্যানসার হাসাপাতাল। ওই বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ তখন চলছিল। নিচ থেকে ওপরতলা পর্যন্ত খালি। আশপাশেও কেউ নেই। আমরা পাঁচজন আমি, মনসুর আলম দুলাল, আলমগীর, আবদুল্লাহ এবং বজলুল মাহমুদ বাবলু। কমান্ডে আমি নিজেই। অস্ত্র ছিল দুটি স্টেনগান, দুটি এসএলআর আর আমার কাছে একটা চাইনিজ এসএমজি। দুই ব্যাগ হ্যান্ড গ্রেনেড আর দুই ব্যাগ ফসফরাস গ্রেনেডও ছিল। আমরা আগুন লাগানোর কাজে ব্যবহার করতাম ফসফরাস গ্রেনেড।

২১ আগস্ট ১৯৭১। রাত সাড়ে ১০টার দিকে নুর হোটেলের বিল্ডিংয়ের ওপর গিয়ে বসি। দুলালকে বললাম, যা মাইন বিছিয়ে আয়। স্ট্রিট লাইটটাও ভেঙে দিলাম। রাস্তা তখন অন্ধকার। মাইন ফিট করে সবাই বিল্ডিংয়ের চারতলায় পজিশন নিয়ে থাকি।

আধঘণ্টার মধ্যে একটা ভেসপা আসে। পিআই-এর স্টাফ হয়তো। রাস্তা দিয়ে চলে গেল। মাইনটার বিস্ফোরণ হলো না। এরপর হঠাৎ দেখি লেফট-রাইট করে ৮-১০ ছেলে আসছে। ওরা পুরো রাস্তা পায়ে হেঁটে চলে গেল। এবারও কোনো মাইন বিস্ফোরণ হলো না। আমি দুলালের ওপর ক্ষিপ্ত হই।

এরপর মাইন দেখতে নিচে আসি। হঠাৎ একটা আর্মি জিপ চলে গেল। এবারও বিস্ফোরণ হলো না মাইন। পুরো রাস্তা শুনশান। তখন সব মাইন উঠিয়ে আমি ডব্লিউ প্যাটার্ন করে সেট করি। ক্যামোফ্লেক্স করি ময়লা ফেলে। ওয়ানলি সিক্স সেকেন্ড সাইড প্রেশার সেট করে ব্লিডিংয়ে পজিশন নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি। এক ঘণ্টা পার হয়। কিছু আসে না। রাত তখন সোয়া ২টা থেকে আড়াইটা হবে। দেখলাম, সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে তিনটা হলুদ লাইট পরপর আসছে। বুঝে যাই আর্মির গাড়ি। একটা সামনে এসেই বমবম করে উল্টে ওয়ালের পাশে ধাক্কা খায়। আব্দুল্লাহকে রাস্তার পাশেই অস্ত্র দিয়ে বসিয়েছিলাম। সে শুধু ফায়ার করলেই সব কলাগাছ হয়ে যেত। কিন্তু ওদের পড়তে দেখে গুলি না চালিয়েই সে ভয়ে সরে পড়ে।

প্রথম গাড়ি উল্টে গেলেও পাকিস্তানিরা পেছনের দুটি ব্রেক করেনি। বরং স্পিড বাড়িয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের ফায়ার ওপেন করার আগেই ওরা ফায়ার শুরু করে। গাড়ির তলায় পড়ে মরে গিয়েও ফায়ার করতে থাকে। আমি তখন বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে সমানে গুলি করি। গর্জে ওঠে বাকিদের এসএলআরগুলোও।

১৫-২০ মিনিট গোলাগুলি চলে। এরপরই দুপাশ থেকে সহযোদ্ধারা ছুটে আসে। কারণ তাদের ম্যাগজিন কাজ করছিল না। তখন তিনটা ট্রাকে রিপিট ফায়ারের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। গুলি চালাচ্ছি। হঠাৎ এসএমজিটায় খাট করে একটা শব্দ হয়। গুলি শেষ। পেছন ফিরে দেখি সহযোদ্ধারা নেই। ভয় হয় তখন। নিচে লাফিয়ে পড়ি। ফলে ব্যথা পাই বাঁ পায়ে। অন্ধকারে কোনো রকমে একটা ওয়াল টপকেই বহু কষ্টে এক বাড়িতে লুকাই।

ওই অপারেশনে তিন ট্রাকে স্পট ডেড হয় ৬০-৭০ জন পাকিস্তানি আর্মি। সিএমএইচে নেওয়ার পর মারা যায় আরও ১৫-২০ জন। এ কারণেই রাজধানীতে এটাকেই বিগেস্ট অপারেশন বলা হয়। আর্মিরাও এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনেক যুবককে ওরা হাতিরপুল ও গ্রিন রোড থেকে ধরে নিয়ে টর্চার করে। অনেককে মেরেও ফেলে তারা।”

ভোরে ইনফরমার রফিক এসে বলে, ‘স্যার, ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের রোড থেকে গ্রিন রোড হয়ে আর্মি আসছে। সোনারগাঁও হোটেলের দিক দিয়ে হাতিরপুল পর্যন্ত রাস্তাটাও ব্লক করছে ওরা। ট্রাকের পর ট্রাকে আসছে। তাড়াতাড়ি পালান।’

বিছানা থেকে উঠতে পারি না। বাঁ পা-টা চলছে না। করিম ও জাহাঙ্গীর ছিল সঙ্গে। একটা রিকশা নিয়ে আমরা কোনো রকমে ওই এলাকা ছাড়ি।

বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নানের মতো মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্য ও তাদের বীরত্বপূর্ণ অপারেশনগুলোই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি জীবন্ত ইতিহাস, যা অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।

যুদ্ধ করে স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছেন, এটিই পরম পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল মান্নানের। দেশের উন্নতি দেখলে তৃপ্ত হন তিনি। লুটপাট আর ঘুষ, দুর্নীতি দেখলে খারাপ লাগে তার। প্রজন্মের জন্য শান্তির একটা দেশ গড়ার পরামর্শও দেন তিনি। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো, ‘তোমরা সৎভাবে বেঁেচ থাকার চেষ্টা করো। সৎভাবে বাঁচার আনন্দটা আলাদা, অন্যরকম শান্তিরও। সৎ থাকলে মনে ভয়-ডর থাকে না। আর অন্যায় করলেই তোমার মাথা নিচু হয়ে থাকবে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখো, দেশটাকেও সবার ওপরে রাখো।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৪ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button