মুক্তিযুদ্ধ

চট্টগ্রামে প্রথম এয়ার অ্যাটাক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী (বীরপ্রতীক) ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। ফ্লাইট লাইনে কাজ করতেন; বিমানে রকেট, বোমা, মিসাইল, মেশিনগান প্রভৃতি ফিট করাই ছিল তার কাজ। পদ এলএসিএম। তার সার্ভিস নম্বর ছিল ৮৩১৮৯। তার বাবার নাম মোখলেসুর রহমান আর মায়ের নাম সাঈদা খাতুন। বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার উত্তর ঘোড়ামারা গ্রামে। একাত্তরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে বাড়ি আসেন। ২৫ মার্চ সারা দেশে গণহত্যা শুরু হলে তিনি চলে যান ভারতে, হরিণা ক্যাম্পে। এরপর কীভাবে কিলোফ্লাইট গ্রুপটি গঠন করা হলো? কীভাবে এবং কোথায় কোথায় তারা অপারেশন করলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি তুলে ধরেন ইতিহাসের নানা ঘটনা।

তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করা হবে। তার জন্য চলছে বিভিন্ন ট্রেডের লোক সংগ্রহ। আমি তখন আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্পে। সঙ্গে খন্দকার আর সার্জেন্ট মনির। ক্যাম্প থেকেই বাছাই করে নেওয়া হয় আমাদের। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ডিমাপুরে, আসামের নাগাল্যান্ডে। চারদিকে পাহাড়। মাঝখানে একটা ব্রিটিশ আমলের রানওয়ে। সেখানেই কয়েক মাস চলে ট্রেনিং। একটা এলইউট আর ছিল একটা অর্টার। এলইউট হলো হেলিকপ্টার। আর অর্টার হচ্ছে বিমান। একটি বিমানে রকেট, বোম্বিং, গানারিং এই তিনটা ইউনিট থাকত। আমি ছিলাম এয়ার গানার। বিমানবাহিনীর তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (পরে বীর উত্তম) ছিলেন পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন (সেনাবাহিনীর) আক্রাম। আমি এয়ার গানার আর সার্জেন্ট হক ছিলেন বোম ড্রপিংয়ের দায়িত্বে। ট্রেনিংয়ের সময় পাহাড়ের মধ্যে আমাদের টার্গেট দেওয়া হতো। সেটি ধ্বংস করতাম। এলইউট বা হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ক্যাপ্টেন বদরুল আলম। আরেকটা বিমান ছিল ড্যাকোটা। সেটার পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেক। সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন ও আব্দুল মুহিত। সবাই ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। মেইন অপারেশন ছিল আমাদের। আমি এলইউট ও অর্টার দুটিতেই কাজ করেছি। একটি শেষ করেই উঠতাম আরেকটিতে। আমাদের গ্রুপটির নাম ছিল কিলোফ্লাইট। গ্রুপের কমান্ডার সুলতান মাহমুদ।’

প্রথম এয়ার ফাইটের কথা শোনান বীর প্রতীক রুস্তম আলী:

‘ইন্ডিয়ান বর্ডারে ছিল কৈলাশহর এয়ারপোর্ট। আমাদের নিয়ে আসা হয় সেখানে। এক রাতের পরই বলা হলো অপারেশনের কথা। গোপনীয়তা রক্ষায় কোথায় অপারেশন করতে হবে জানানো হলো না। ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত তখন বারোটা। সবাই প্রস্তুত। বিমানযুদ্ধ ওটাই ছিল প্রথম। বিমান বা অর্টারে ফ্লাই করার আগে জানানো হয় চট্টগ্রাম অ্যাটাক করতে হবে। আমরা চারজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম, এয়ার গানার আমি আর সার্জেন্ট হক বোম ড্রপিংয়ে।

রাত তখন দশটা। কৈলাশহর থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার দিয়ে বিমানটি উড়ে যায়। যাতে পাকিস্তানি রাডার তা ক্যাচ না করে। চিটাগাং দিয়ে ঢুকতেই সীতাকুন্ড, পরে পাহাড়। যখন পাহাড় ক্রস করছিলাম, তখন শামসুল আলম সাহেব বলেন, ‘রুস্তম, নাউ উই আর ক্রসিং সীতাকুন্ড হিল।’ আমি বলি, ‘ইয়েস স্যার। দিস ইজ মাই নেটিভ থানা।’

অতঃপর আমরা বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করি, একেবারে নিচে নেমে। অনেক নিচ দিয়ে ফ্লাই করছি আমরা। চাঁদের আলো ছিল। নিচে সব দেখা যাচ্ছে। আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়েই আসি চিটাগাং, ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারিতে। ওটা ধ্বংস করাই ছিল টার্গেট। ওটা উড়িয়ে দিতে হবে।

প্রথমবারেই রকেট, মেশিনগান, বোমা হামলা একসঙ্গে শুরু করলাম। আমি মেশিনগানের গুলি চালাই আর বোম ড্রেপিং করেন সার্জেন্ট হক। প্রথম অ্যাটাকেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল। বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। শামসুল আলম সাহেব বলেন, ‘শুড আই টেক এনাদার অ্যাটেমপ্ট?’

আমি বলি, ‘নো স্যার, উই আর সাকসেসফুল।’

পাকিস্তানিরা প্রথমে মনে করেছে এগুলো তাদের বিমান। তাই ওরা প্রথমে কিছু করেনি। ধ্বংস আর আগুন দেখে ওরা পাগল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম তখন ওদের নেভির দুর্গ। নেভি আর আর্মি অ্যান্টি এয়ার ক্রাফট গান দিয়ে গুলি করতে থাকে। একটা লাগলেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। একাত্তরে মরতে গিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম।’

ফেরার সময় রুস্তম আলীরা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের কুম্বিরগ্রামে ল্যান্ড করে। তাদের সফলতা দেখে ভারতীয়রা বিশ্বাসই করতে পারেনি। ওরা অবাক হয়ে বলত, ‘এই বিমান চালিয়ে তোরা কেমনে যুদ্ধ করলি!’

রুস্তমদের মতো যোদ্ধারা তখন দেশের জন্য পাগল। তাই অসম্ভবও সম্ভব হয়েছিল। এরপর রুস্তমদের ফুল ব্যাচকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। পরে সেখান থেকে এয়ার অ্যাটাক করা হয় সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকায়। দেশ যখন স্বাধীন হয়, রুস্তম তখন আগরতলায়। খুব ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার খবরে বুকটা ভরে গিয়েছিল তার।

দেশ নিয়ে এই বীরপ্রতীক চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে বলেন, এটা সোনার খনি, দেশ নয়। বিমানবাহিনীতেই ছিলাম। পঁচাত্তরের জুনে বেসরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাই ওমানে। এরপর জাপান, ব্রিটেনসহ (লন্ডন) পৃথিবীর প্রায় ২৫টি দেশ ঘুরেছি। এ দেশের মতো উৎপাদন, আবহাওয়া, মাটি, পানি আপনি কোথাও পাবেন না। এত মানুষ থাকার পরেও অল্প টাকায় চাল আর সবজি খেতে পারি। এটা কোথাও নেই। এখনো স্বপ্ন দেখি সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তির বাংলাদেশের।

অনেকে বলেন, দেশ স্বাধীন করে কী পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের অমর্যাদাও করেন কেউ কেউ। তখন কষ্ট পান বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী। বললেন, একটা পতাকা আর দেশ পেয়েছি। নিজের দেশের পাসপোর্ট পাই। অথচ স্বাধীনতার মূল্যায়ন যখন কেউ করে না, তখন খারাপ লাগে। স্বাধীনতা তো অনেকে হাতের মোয়া হিসেবেই পেয়ে গেছে। কষ্টটা চোখে দেখেনি। ভিয়েতনামে যুদ্ধ হয়েছে বাইশ বছর। আমরা আরও দশ-বারো বছর যুদ্ধ করে দেশটা পেলে, সবাই স্বাধীনতার অর্থটা বুঝতে পারত।

শত বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ একদিন উন্নত হবে এমনটাই বিশ্বাস বীরপ্রতীক রুস্তম আলীর। তার বিশ্বাস, লাখো শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশ কখনো পথ হারাবে না। এই যোদ্ধা তাই স্বপ্নের বীজ বোনেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে।

তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বলেন, দেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু এই তিন বিষয়ে তোমরা আপস কোরো না। দেশের বীরত্বের ইতিহাস জেনে নিও। দেশটাকে ভালোবেসো। মনে রেখো, নিজের কাজটা সততার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button