মুক্তিযুদ্ধ

মোনায়েম খান নিশ্চিহ্নকরণ অপারেশন

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ার হোসেন (বীরপ্রতীক)। তাদের আদি বাস গুলশান থানার কালাচাঁদপুরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন তিতুমীর কলেজে (তখন ছিল জিন্নাহ কলেজ), ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে আনোয়ার চলে যান ভারতে। মতিনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে ১৫ দিন ও মেলাঘরে এক মাস ট্রেনিং নেন তিনি।

আনোয়ারদের ট্রেনিং শেষ হয় মে মাসের শেষের দিকে। এরপর গ্রুপ করে দেশে পাঠানো হয়। তাদের গ্রুপ কোনটি? এমন প্রশ্নের উত্তরে বীর প্রতীক আনোয়ার বলেন, ‘বৃহত্তর তেজগাঁও ও ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকা মিলিয়ে গেরিলাদের একটি বিশেষ গ্রুপ করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় “ক্যান্টনমেন্ট বিশেষ গ্রুপ”। কমান্ডার ছিলেন এম এ লতিফ। ডেপুটি কমান্ডার করা হয় রহিমুদ্দিনকে। গোয়েন্দাগিরি আর অর্থের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ফেরদৌসকে দেওয়া হয় সাংগঠনিক দায়িত্ব। বীরপ্রতীক মোজাম্মেল, মামাতো ভাই গিয়াসসহ প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ২০ জন গেরিলার দল ছিল এটি। অস্ত্র ছিল ইন্ডিয়ান স্টেনগান, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড, পিকে ফোর বোমা, এন্টিট্যাংক মাইন, ডেটোনেটরসহ এক্সপ্লোসিভ প্রভৃতি।

এ টি এম হায়দার সাহেব একটা ব্রিফিং দিয়ে বলেন, ‘তোমরা ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রুপ। তাই গভর্নর মোনায়েম খানের মতো কট্টর পাকিস্তানিদের ওপর অপারেশন চালাবে। গুলশানে চার্জ করবে গ্রেনেড। একটা মাইন আছে এম সিক্সটিন। প্রচ- শব্দ হয়। ওটা হিট করবে যাতে এলাকায় প্যানিক তৈরি হয়। সবাই যেন বুঝে যায় মুক্তিযোদ্ধারা সব জায়গায় আছে।’

আনোয়ারদের গেরিলা গ্রুপটি জুন মাসের প্রথম দিকে দেশের ভেতরে ঢোকে। নির্দেশ অনুসারে প্রথমদিকে তারা গ্রেনেড চার্জ করে গুলশানের বিভিন্ন জায়গায়।

পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খান ওরফে মোনায়েম খান ছিলেন পাকিস্তানের কট্টর দালাল। পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সহায়তাকারী ছিলেন। তিনি তখনই বাঙালিদের কাছে কুখ্যাত পরিচিতি পান। আনোয়ারদের গ্রুপটি তার ওপর অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কঠোর নিরাপত্তার আবরণ ভেদ করে কীভাবে মোনায়েম খানকে মেরেছিলেন আনোয়ার ও মোজাম্মেল হকের মতো গেরিলারা? আনোয়ারের মুখেই শোনা যাক ওই অপারেশনের কথা।

অকপটে তিনি বলেন, আমি ও মোজাম্মেল হক (বীরপ্রতীক) অপারেশনের প্ল্যান করি আমাদের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারের সঙ্গে। মোজাম্মেলের চাচা আবদুল জব্বারের আসা-যাওয়া ছিল মোনায়েম খানের বাড়িতে।

তার (চাচার) বেশ কিছু গরু ছিল। তিনি গরুর দুধও বিক্রি করতেন। মোনায়েম খানের বাসায়ও ছিল অনেক গরু। সেখানকার দুধও বিক্রির জন্য আসত তার কাছে। এই সূত্রে মোনায়েম খানের বাসার কাজের লোকদের সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। ওই বাড়িতে কাজ করতেন দুজন শাহজাহান ও মোখলেস। তারা মোনায়েম খানের বাড়ি ও গরুগুলো দেখাশোনা করতেন।

জব্বারের মাধ্যমে আমরা তাদের সঙ্গে বসতে চাই। একদিন ছোলমাইদে তারা দুজন আসেন। সেখানে কারী নামে এক মামা থাকতেন। তার বাসায় বসেই কথা হয়। মোটিভেশন দিই তাদের। বোঝাই, ‘যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানিরা শত শত লোককে মারছে। কট্টর পাকিস্তানি দালাল মোনায়েম খানকে মারতে আমাদের সঙ্গে থাকো, তাহলে তোমরা মুক্তিযুদ্ধের একটা অংশ হবে। তোমাদের নাম ইতিহাসে থাকবে। তারা কিছুটা কনভিন্স হয়। কয়েক দিন পরেই তারা জানায়, ঠিক আছে, আপনারা আসেন।

শুধু দেশপ্রেমের খাতিরে শাহজাহান ও মোখলেস ওই অপারেশনে আমাদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা তখন ছিল একটা স্পিরিট (চেতনা)।

মোনায়েম খানের বাড়ির পুরো নকশা তৈরি করা হয় তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। বাড়ির চারদিকে দেয়াল, ওপরে কাঁটাতারের বেড়াও ছিল। পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে। একটা দেয়ালের মাঝখানটা ভাঙা। ভাঙা জায়গা দিয়ে অনায়াসে একজন ঢুকতে পারবে। রেকি করতে গিয়ে ওটা আমাদের নজরে পড়ে। সে সুযোগটিই কাজে লাগাই। অপারেশনের তারিখ ও সময় ঠিক করে জানিয়ে দিই সবাইকে।

বনানী কবরস্থানে তখন খুব বেশি কবর ছিল না। খুব জংলা। আমরা জড়ো হব সেখানেই। আরেক সহযোদ্ধা নুরুল আমিনও থাকবে। মোজাম্মেল তার মতো করে পৌঁছে যাবে সেখানে। মোনায়েম খানের বাড়িটি ছিল কবরস্থান সংলগ্ন।

ছোলমাইদে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে আমি স্টেনগান আনি ফোল্ড করে, বাজারের চটের ব্যাগে। গ্রেনেড ও পি-ফোর বোমাও নিই। পি-ফোরকে ফসফরাস বোমা বলে। ওটার পিন খুলে থ্রো করলেই আগুন জ্বলে উঠবে।

কেউ যেন আমাকে লোকেট করতে না পারে সে জন্য সহযোদ্ধা ও মামাতো ভাই গিয়াস এবং রফিকুলকে ব্যাগটা দিয়ে বলি, এটা পরে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। তারিখটা ১৩ অক্টোবর ১৯৭১। সন্ধ্যার পর রওনা হই। অপারেশন হয় আনুমানিক রাত সাড়ে ৮টায়। গুলশান ২ নম্বরে তখন বড় কাঁচাবাজার ছিল। মিলিশিয়ারা পাহারা দিত গুলশান এলাকা। আমি বাজারে যেতেই গিয়াসরা চটের ব্যাগটা পৌঁছে দেয়। ব্যাগের ভেতর পুঁইশাক ও কিছু সবজি কিনে রাখি। পরনে কালো শার্ট আর একটা লুঙ্গি, হাতে ব্যাগ। বোঝার উপায় নেই মুক্তিযোদ্ধা। ব্যাগ নিয়ে রিকশায় বনানী ব্রিজ পার হয়ে পৌঁছি বনানী কবরস্থানে। মোজাম্মেল ও নুরুল আমিন আমার অপেক্ষায় ছিল।

স্টেনগানটা নিই আমি আর মোজাম্মেলকে দিই হ্যান্ড গ্রেনেডটা। ফায়ার করার পরেও যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে গ্রেনেড ছোড়া হবে। এমনটাই পরিকল্পনা করি। নুরুল সেখান থেকে সরে যায়। ভেতরে ঢুকি আমি আর মোজাম্মেল।

কবরস্থানের দেয়ালঘেঁষা মোনায়েম খানের বাড়ির দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমরা কলাগাছের বাগানে অপেক্ষায় থাকি।

শাহজাহান এসে বলে, ‘আপনারা এখানেই বসেন। সাহেব এখনো ওপর থেকে নামেন নাই।’ ১০ মিনিট পরেই সে ফিরে এসে বলে, ‘সাহেব নামছে।’

মোনায়েম খানের পজিশনটা আমরা জানতে চাইলাম। সে বলে, ‘পশ্চিম দিকে মুখ করা তিনজন লোকের মাঝখানেই সাহেব বসা।’

আমরা আর দেরি করি না। ভয় বলতে কিছুই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে মরলে নাম ইতিহাসে থাকবে। এ কথা দারুণভাবে ভেতরে গেঁথে ছিল।

স্টেনগান নিয়ে নিচতলায় ড্রইংরুমের দরজা ঠেলে ঢুকে যাই। মাত্র ১৫ ফিট সামনে তারা। মাঝের ব্যক্তিকে টার্গেট করেই গুলি করি। সঙ্গে সঙ্গে মোনায়েম খান উপুড় হয়ে পড়ে যান, একটা চিৎকারও দেন। এইটুকু এখনো স্মৃতিতে আছে। পেছনে ব্যাক করতেই মোজাম্মেল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ করে। কিন্তু তার গ্রেনেডটা কোনো কারণে বার্স্ট হয় না। পরে শুনেছি মোনায়েম খানের সঙ্গে (দুই পাশে) ছিল প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন আর মেয়েজামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। কিন্তু তারা আমাদের টার্গেটে ছিল না। শুধু মোনায়েম খানকেই আমরা হিট করেছি।

বাড়ির পাশেই আর্মি-ঘাঁটি ছিল। ফায়ারের আওয়াজ পেয়েই ওরা এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। কবরস্থান থেকে দ্রুত বের হয়ে শাহজাহানসহ আমি একদিকে, মোখলেস একদিকে আর মোজাম্মেল আরেক দিক দিয়ে সরে পড়ি। প্রথমে ছোট বোনের বাড়িতে, পরে চলে যাই ছোলমাইদে কারী সাহেবের বাড়িতে। অপারেশন শেষে ওখানেই একত্র হওয়ার কথা ছিল।

মোনায়েম খান মারা গেছেন এটা আনোয়াররা জানেন পরদিন, রেডিওর সংবাদে। আশপাশের লোকেরা আলাপ করছিল, ‘মোনায়েম খানরে মুক্তিযোদ্ধারা মাইরা ফেলছে।’ আনোয়াররা তখন তৃপ্তির হাসি হাসেন। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে খবরটি।

বীরপ্রতীক আনোয়ার বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সাহসী। ওই অপারেশনের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়। আমার গুলিতেই মোনায়েম খান মারা যান এটা ভাবলে এখনো গর্বিত হই। অপারেশনে আমি আর মোজাম্মেল ছাড়াও শাহজাহান, মোখলেস ও আব্দুল জব্বারের অবদানও কম ছিল না। তারা সহযোগিতা না করলে হয়তো অপারেশনটিই করা যেত না। শাহজাহান এখন বেঁচে নেই। সে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলেও মোখলেসের নাম আসেনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। মোখলেস এখন অসুস্থ। থাকেন কুমিল্লায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি ভাই।

মোনায়েম খানকে মারার পরিকল্পনা হায়দার সাহেবই দেন। অপারেশনের পর আমাদের ডেপুটি কমান্ডার রহিমুদ্দিন যান ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। ভারতীয় সেনাদের তিনি সেই বীরত্বের কথা বিস্তারে জানান। শুনে ভারতীয় সেনারা বাহবা দেয়।

স্বাধীনতা লাভের পরপরই হায়দার সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয় ধানমন্ডিতে। গাড়ি থেকে নেমে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন। গুড গুড বলে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নতুন দুটি নোট বের করে পুরস্কারস্বরূপ আমার হাতে গুঁজে দেন। অন্য রকম লেগেছিল সেদিন। মোনায়েম খানের ওপর অপারেশনটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের উদাহরণ।।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৫ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button