আদিবাসী

আদিবাসী লোককথা : বিচিত্র লোককাহিনির সন্ধান

মারজানা সাবিহা শুচি

আদিবাসী লোককথা : সালেক খোকন। প্রচ্ছদ : ইমন ওবায়দুল্লাহ। প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশনস। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২২। মূল্য : ৩৬০ টাকা।

আদিবাসী সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণা সাহিত্য সালেক খোকনের ‘আদিবাসী লোককথা’ গ্রন্থটি। আদিবাসী সমাজে শত শত বছর ধরে প্রচলিত বিশ্বাস এবং রীতিনীতির পেছনে যে কাহিনি বা গল্পগুলো রয়েছে, সেসবের একটি অংশকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে। কড়া, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালি, ডালু, তুরি, মুণ্ডা, গারো, ম্রো, রাখাইন, রাজবংশী, মণিপুরি, হাজং, চাক, মুসহর, খুমি, ভুনজার, ত্রিপুরা, লোহার, পাহাড়িয়া, কোচ, খাসিয়া, মাহাতো প্রভৃতি আদিবাসীর সমাজজীবন এবং ধর্মীয় পূজা-পার্বণ-উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোককথার খোঁজ পাওয়া যায় বইটিতে।

যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত যাদের ভাষার লিখিত রূপ নেই, তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস এই মৌখিক সাহিত্য বা লোককথা।

আদিবাসীরা তাদের লোককথাগুলোর চর্চা ধরে রাখার চেষ্টা করে যত্নের সঙ্গে। দিনাজপুরের কড়াদের গ্রামে রাতে চাঁদের আলোতে বসে ঠাকুমার গল্প বলার আসর। কারমা পূজার উৎসবে গোত্রপ্রধান বা মাহাতো উপস্থিত ছোট-বড় সবাইকে শোনায় পূজার ইতিহাস। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মনে গেঁথে থাকে নিজেদের ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস, টিকে থাকে লোককথাগুলো।

কেমন তাদের লোককাহিনি? লেখকের ভাষ্যমতেই বলি—আদিবাসীদের প্রচলিত বিশ্বাস যেমন অভিনব ও বিস্ময়কর, তেমনি এর পেছনের গল্পগুলোও চমৎকার। আদিবাসীদের নানা বৈচিত্র্যময় বিশ্বাস ও প্রথার সন্ধান পাই বইটিতে। পৃথিবী কিভাবে সৃষ্টি হলো? ছাতিমগাছে কেন বজ্রপাত হয় না? ভূমিকম্প কেন হয়? ঢোঁড়া সাপের বিষ নেই কেন? পৃথিবীতে কেন পান-সুপারি জন্মাল? গাইগরুকে কেন পূজা দেওয়া হয়, ষাঁড়ের মাংস কেন খাওয়া নিষেধ—এমন কত কৌতূহলের যে উত্তর পাওয়া যায় আদিবাসীদের কাহিনিগুলোতে! এই যেমন হাজংরা বিশ্বাস করে, বিরাট এক ষাঁড় পৃথিবীটাকে মাথায় নিয়ে আছে, ষাঁড় নড়ে উঠলেই হয় ভূমিকম্প। আদিবাসী সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ নাচ নিয়েও তাদের প্রচলিত বিশ্বাসগুলো জেনেছেন লেখক।

সাঁওতালরা যেমন বিশ্বাস করে নাচ ঐশ্বরিক। নাচের জন্য বিখ্যাত মণিপুরিদের বিশ্বাস, পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই রয়েছে নাচ।

বইটির পেছনে লেখকের পরিশ্রম বেশ চোখে পড়ে। লোককাহিনি সংগ্রহে তিনি চষে বেড়িয়েছেন গ্রামে গ্রামে। কখনো চলে গিয়েছেন দিনাজপুরের মহেশপুরে সাঁওতাল গ্রামপ্রধানের উঠানে ঝুমুর নাচের আসরে।

নেত্রকোনা জেলার আদিবাসী গ্রাম লেংগুরায় দেখেছেন তাদের ঐতিহ্যবাহী লবান উৎসব এবং প্যাঁক খেলা। দিনাজপুরের ধুকুরঝারির নেহাল গ্রামে বেড়িয়ে লেখক আমাদের জানান মুসহরদের বিয়ের রীতিনীতি, ছট পূজার বিবরণ। দিনাজপুরের লোহাডাঙ্গার তুরি আদিবাসীদের ধাঁধার আসরে উপস্থিত থেকেছেন। গোদাগাড়ী উপজেলার জাওইপাড়া, দলদলিয়া গ্রামের সোহরাই উৎসব; দিনাজপুরের বহবলদীঘি, পিপল্লা গ্রামে গিয়েছেন তিনি। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে মাহালি আদিবাসীদের গ্রামে জেনেছেন তাদের গরয়া পূজার পেছনের কাহিনি। এ ধরনের গবেষণাগ্রন্থ তাই আমাদের বিদ্যমান জ্ঞানের পরিসরে মূল্যবান সংযোজনের কৃতিত্বের দাবি রাখে।

তবে এই বইয়ের আলোচনা শুধু লোককথায় সীমাবদ্ধ নেই। আরো গভীরে ছুঁয়ে আসার প্রচেষ্টায়ই প্রকাশ পেয়েছে আদিবাসীদের হতাশা ও বিপন্নতা। দেশের মূলধারার সামাজিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনে সংখ্যালঘু এসব ভূমিপুত্রকন্যার অস্তিত্ব এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বেশ সংকটাপন্ন। বইটিতে দেখলাম বিভিন্ন আদিবাসী জাতির প্রবীণরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন—তাঁদের প্রথা ও ঐতিহ্য আগের মতো তাঁরা আর ধরে রাখতে পারছেন না। বেশ কিছু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ধীরে ধীরে হুমকির মুখে পড়ছে—এমন অশনিসংকেত রয়েছে এখানে। শত শত বছর ধরে যেসব বিশ্বাস ও আচার প্রচলিত ছিল আদিবাসী সমাজে, হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও। তাই পাঠ শেষে কেমন একটি বেদনার রেশ অনুভব করলাম। তবু আশা করতে চাই, টিকে থাকবে আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বীয় ঐতিহ্য নিয়ে। একটি কথা প্রচলিত আছে—কোনো একটি সমাজের সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যে। টিকে থাকুক আমাদের দেশের বৈচিত্র্য, আমাদের সৌন্দর্য।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালের কণ্ঠের শিলালিপিতে, প্রকাশকাল; ৭ এপ্রিল ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button