মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১: সাধারণ মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ

উনিশশো একাত্তরের মার্চ-ডিসেম্বরের স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের যুদ্ধটি ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন প্রশস্ত বুকে, ভয়শূন্য চিত্তে। এই যুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানাভাবে অংশ নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। এমন সাধারণ মানুষ হতেও প্রয়োজন অসাধারণ গুণাবলি। একাত্তরে এমন কিছু মানুষ ও সাহসী ঘটনার কথা তুলে ধরতেই এই লেখার অবতারণা।

সময়টা ১৯৭১। একবার নির্দেশ আসে বড়লেখায় সাতমাছড়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার। আমার সঙ্গে ১৩ জন। ক্যাম্প থেকে মুভ করি রাতে। প্রথম নদীর পারে এসে নৌকা পেলাম। কিন্তু দ্বিতীয় নদীর কাছে কোনো নৌকা ছিল না। রাত তখন ২টার মতো। নৌকার খোঁজে সহযোদ্ধারা আশপাশে ছোটে। কিন্তু না, কোনো নৌকা নেই। কী করব ভাবছি। হঠাৎ আমাদের পেছনে একটি ঝোপে কী যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক তাক করা হয়। কে ওখানে? কাঁপতে কাঁপতে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। বয়স তার ১৫ বা ১৬ বছর। পরনে শাড়ি। আঁচলের কিছু অংশ কামড়ে ধরে কাঁপছে। সিলেটি ভাষায় বলে, ‘মুক্তি নি? আমি জানতাম আপনারা আইবা।’ সে জানাল, গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসছে এমন খবর পেলে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দেবে। সেই ভয়েই গ্রামবাসী ঘাটের সব নৌকা ডুবিয়ে রেখেছে। ‘আও আমার লগে আও’ বলেই মেয়েটি নদীর এক পাশে ডোবানো নৌকাগুলো দেখিয়ে তুলে নিতে বলে। নিজেই খুঁজে আনে লগি। সহযোদ্ধারা পানি সেচে দুটি নৌকা নদীতে ভাসায়। তাকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যাই। একটি নৌকা ঘাটে রাখি। আরেকটি নৌকা নিয়ে মেয়েটি নদীর জলের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পুরো দৃশ্যটিই স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেতুটি উড়িয়ে ভোরের দিকে আমরা ক্যাম্পে ফিরি।

মনের ভেতর এখনো ভেসে ওঠে মেয়েটির মুখখানা। গ্রামবাসীর চোখ এড়িয়ে, জীবনের ঝুঁকি জেনেও ওই রাতে সে এসেছিল শুধুই মুক্তিযোদ্ধাদের পার করিয়ে দিতে। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কী হতে পারে! সহযোদ্ধাদের কাছে মেয়েটি ছিল পরি বা ফেরেশতা। কিন্তু আমার কাছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে এমন নারী ও সাধারণ মানুষ পাশে ছিল বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাসটিও তুলে আনতে হবে খোকন। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হবে না।  একাত্তরের একটি ঘটনা তুলে ধরে এভাবেই নিজের মত তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবু। তিনি যুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে, কুকিতল ক্যাম্পের কমান্ডারও ছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা শুনি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুস সামাদের মুখে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ছয় নম্বর সেক্টরে। একাত্তরে সাধারণ মানুষের অবদানের কথা তুলে ধরতেই ওই ঘটনার কথা তুলে ধরেন তিনি। তার ভাষায়, ‘একাত্তরের অগাস্ট মাসের ঘটনা। আমরা তখন হিট করেই সরে পরতাম। নীলফামারীর ডিমলায় টুনিরহাট নামক একটি জায়গায় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। ওরা ছিল এক প্লাটুন, ত্রিশজনরে মতো। একটি বাড়ির এক তলার ওপরে পজিশন নিয়ে থাকত। তাদের সঙ্গে পাহারায় ছিল রাজাকাররা।
আমদের কোম্পানি তখন ঠাকুরগঞ্জ নামক জায়গায়। কোম্পানি কমান্ডার অপিল, আমি ছিলাম সেকশন কমান্ডার। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। টার্গেট ছিল ওদের ওপর আক্রমণ করেই ফিরে আসব। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে আসে গ্রামেরই এক ছেলে। নাম রফিকুল্লাহ। নবম শ্রেণিতে পড়ত সে। সে এসে বলে, আপনারা কি মুক্তিযোদ্ধা? প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হই। ভাবলাম পাকিস্তানিদের দালাল। বললাম, তোমার জানার দরকার কী? তার অকপট উত্তর, ‘মুক্তিযোদ্ধা হলে সাহায্য করব। ক্যাম্পে ওরা কয়জন আছে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবেÑ সব আমার জানা। আমি নিয়ে যেতে পারব।’ মৌখিক যাচাই করে তাকে আমরা গাইড হিসেবে সঙ্গে নিলাম।
ও সামনে, আমরা পেছনে। আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। হঠাৎ পাকিস্তানিরা টের পেয়ে যায়। ওদের পজিশন উচুঁতে হওয়ায় সামনে থাকা রফিকুল্লাহকে তারা দেখে ফেলে। ফলে গুলি চালায়। গুলিটি রফিকুল্লাহর বুকে এসে লাগে। মাটিতে পরেই যন্ত্রণায়  সে কাতরাচ্ছে। সমতল ভূমি। ধান কাটাও শেষ। ক্ষেতের শূণ্য জায়গায় আমরা। পজিশন নেওয়ারও সুযোগ নেই। সঙ্গে ছিল না তেমন অ্যামুনেশনও। আমাদের অবস্থান টের পেলে ওরা নিমিষেই শেষ করে দিবে। আমরা তাই নীরব থাকি।
কিন্তু ছটফট করতে করতে রফিকুল্লাহ বলে, ‘ওদের আপনারা ছেড়ে দিয়েন না। আক্রমণ করেন। ওদেরও গুলি করে মারেন ভাই।’ এরপরই তার দেহ নিথর হয়ে যায়। ওর কথাগুলো এখনও কানে বাজে। আমরা তার কথা রাখতে পারিনি। এটা ভাবলেই কষ্ট হয়। রফিকুল্লাহর লাশটা ফেলেই চলে আসতে হয়েছিল। এই ঘটনা এখনও আমাকে পীড়া দেয়। সেও তো ছিল একজন বীর যোদ্ধা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতায় রফিকুল্লাহর রক্তও মিলে আছে। কিন্তু আমরা তো তুলে আনতে পারেনি তার আত্মত্যাগের ইতিহাস। জানি না তার আত্মত্যাগের ইতিহাস পরিবার জানে কিনা!’
কথা হয় আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। বিএলএফের অধীনে যুদ্ধ করেছেন ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা, রাঙামাটির কাউখালী, কুতুবদিয়া থানা ও বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায়। একাত্তরে ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলায় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের স্পিøøন্টারে আহত হওয়ার পর ফিরে আসেন ক্যাম্পে। কী দেখলেন এসে? তিনি বলেন, “দেখি খাবার রেডি, গরম গরম ভাত। যুদ্ধের সময়ও এসব নিয়ে এলো কে? স্থানীয় এক মাদরাসার হুজুরের বউ। তাঁকে ডেকে সবাই বলে, জীবন বাঁচাতে এলাকার সবাই চলে গেছে, আপনি যাননি কেন? উনি বলেন, ‘বাবা, কোথায় যামু, আমার ছেলেরা যুদ্ধে গেছে, মা হয়ে আমি কি পালায়া যাইতে পারি?” এ ঘটনা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, ‘এটাও একটা বড় যুদ্ধ, যা করেছিল সাধারণ মানুষ। একাত্তরে ওই নারীর অবদানও কিন্তু কম ছিল না।’
সরওয়ার আরেকটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন এভাবে, ‘রাঙামাটি এলাকায় এক বুড়ির বাড়িতে আমরা উঠি। উনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই বাড়িতে পানি রাখতেন। শীতের দিন। আমার প্রচণ্ড জ্বর ছিল। জোর করে ওই বুড়ি একটি কাঁথা দিয়ে দেন। নিতে চাই না প্রথম। নেওয়ার নিয়মও নেই। কিন্তু বুড়িটি আধাকিলোমিটার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে কাঁথাটি শরীরে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওটাও তো দেশপ্রেম ছিল। কিন্তু ইতিহাসে কি ওই বুড়ির নাম লেখা হয়েছে?’
একাত্তরে সাধারণ মানুষের অবদান বিষয়ে ঢাকার গেরিলা বীরমুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমানের অকপটে বলেন, ‘একটি দেশে গেরিলা তখনই থাকতে পারে, যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়। জনগণের সমর্থন ছাড়া গেরিলা অপারেশনও হয় না। সেই সমর্থন আমরা শতভাগ পেয়েছিলাম। এ কারণেই একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল একটি জনযুদ্ধ, যেটি না বললে কিন্তু ভুল হবে। আমি গেরিলা, পথে আমাকে গ্রামবাসী খাইয়েছে। প্রতিটি ধাপে এরাই আমাদের হেল্প করেছে। ’
উদাহরণ টেনে তিনি আরো বলেন, ‘সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের গাজীবাড়ি গ্রামে স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং করাই আমরা। এসএলআরের ওপর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। শিমুলিয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান আহম্মেদ আলী সব সময় খোঁজ নিতেন কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। কোন বাড়িতে গিয়ে আমরা থাকতে পারব। ঈদে একটু ভালো খেতে পারব। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একাত্তরে এমন মানুষদের কন্ট্রিবিউশনও কম ছিল না।’
কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু শামার সঙ্গে। একাত্তরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় সেখানে। পাকিস্তানিদের সামরিক শক্তির কাছে টিকতে পারে না আবু শামাদের প্রতিরোধ। ফলে তাদের বন্দি করে টর্চার করা হয়। কয়েক দিন পর ঢাকার পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর জিম্মায় দিয়ে তাদের বলা হয় মিল ব্যারাকে রিপোর্ট করতে। এরপর কী ঘটল? সে ইতিহাস তুলে ধরেন আবু শামা ‘হেঁটে রওনা হই। শরীর তখন খুব দুর্বল, জ¦রও। পুলিশের পোশাক পরা। তাতে শরীরের রক্ত শুকিয়ে টিনের মতো শক্ত হয়ে গেছে। কয়েকজন চিন্তা করলাম মিল ব্যারাকে আর যাব না। বাড়ি ফিরব। তাই গেন্ডারিয়ার দিকে এগোই আমরা। সূত্রাপুর লোহার ব্রিজটার কাছে গিয়ে বুকের ভেতরটা আঁতকে ওঠে। লোহার ব্রিজ থেকে একটা ক্যানেল গেছে বুড়িগঙ্গার দিকে। সেখানে হাজার হাজার লাশ পানিতে ভাসছে। মরা মানুষের দেহ ফুলে ভেসে আছে, তাতে ঠোকরাচ্ছে শত শত কাক। এ দৃশ্য যারা চোখে দেখেনি, তারা একাত্তরকে অনুভবও করতে পারবে না ভাই। আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। তারা কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এক বাড়িতে। কাপড় খুলে ক্ষত জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে পুরনো কাপড় পরিয়ে দেয়। কয়েক বাড়ি থেকে নিয়ে আসে খাবার। গেন্ডারিয়ার ওই মানুষগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে। এরাই শান্তিকামী, মুক্তিকামী মানুষ। আমি এখনো দোয়া করি তাদের জন্য।’
পরে আবু শামা মুক্তিযুদ্ধ করেন তিন নম্বর সেক্টরে। অপারেশন করেছেন কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। একাত্তরে সাধারণ মানুষের অপরিসীম সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। কীভাবে? তিনি বলেন, ‘আমাদের পাক (রান্না) করে দিত এক মেয়ে, নাম মনোয়ারা। সেও জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে এ কাজ করেছে। একাত্তরে প্রচুর বৃষ্টি ছিল। মাথায় আমরা কলাপাতা দিয়ে রাখতাম। গোপনে গ্রামের রাস্তা দিয়ে যেতাম। দেখতাম বৃদ্ধ মানুষ আমাদের জন্য চিড়া, গুড় আর কলসিতে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলত, ‘বাবা, কখন কী খাইছো জানি না। তোমাদের অপেক্ষায় আমরা। একটু পানি খাও, গুড় খাও, চিড়া খাও।’ এই যে একটা মহব্বত, একটা মায়া এটা ভোলার মতো না। সাধারণ মানুষের ভালোবাসাটাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি।’
আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। তার বড় ভাই কর্নেল তাহের (তখন মেজর) ছিলেন এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে একাত্তরে তাদের মা আশরাফুন্নেসার যুদ্ধটি কেমন ছিল? এমন প্রশ্নে অকপটে ডালিয়া বলেন, “গণহত্যা শুরু হলে ময়মনসিংহ থেকে অনেক পরিবার পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় আমাদের বাড়িতে। মা তখন নানা কাজে ব্যস্ত রাখতেন, যুদ্ধের ভয়বহতা বুঝতে দিতেন না। গেরিলা আক্রমণের ভয়ে কাজলা গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা প্রথম আসেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়াত, ‘মিলিটারি আইছে, মিলিটারি আইছে’। সবাই তখন দৌড়ে পালাত। ওই সময়ও মায়ের চোখে ভয় খুঁজে পাইনি। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন, ‘তুলা রাখ সবাই। যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়।’ মুড়ি, চিড়া আর গুড় একত্রে শত শত প্যাকেট করে আগেই রেখেছিলেন তিনি।
কর্নেল তাহেরকে খুঁজতে একবার বাড়িতে আসে পাকিস্তানি আর্মি। তারা জানতে চায় মেজর তাহের কোথায়? প্রশ্ন শুনে মা ভয় পেলেন না। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন, ‘তোমরাই বলো, আমার ছেলে কোথায়? ওকে তো তোমাদের আর্মিতেই পাঠিয়েছিলাম। তাকে কি মেরে ফেলেছ? কোথায় সে?’ শুনে আর্মিরাই ভড়কে যায়। গ্রামের অনেক যুবতীকে তুলে নিতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান মা। চেঁচিয়ে বলেন, ‘কারও গায়ে যদি একটা দাগ তোমরা দাও, তোমাদের ছাড়ব না। আমি কিন্তু ওপরে বলব।’ মা আশরাফুন্নেসার কারণেই ওই দিন কাজলা গ্রামটি পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আর মায়ের এমন প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা আমরা ভুলে গেছি বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ। অকপটে তিনি বলেন, ‘যারা সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আমাদেরকে পাকিস্তানি সেনারা অ্যাটাক করলে ইন্ডিয়াতে সরে যেতে পারতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা গ্রাম বা শহরে ছিলেন তারা কোথায় যাবে? তারাই সরাসরি ওদের অত্যাচার ফেইস করেছে। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আসছে এই অপরাধে গ্রামের বাড়িগুলো পাকিস্তানি সেনারা জ্বালিয়ে দিত। নয় মাসে এভাবেই নির্যাতিত ও সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে সাধারণ মানুষ।
চিলাহাটী থেকে যখন দুটো কোম্পানি নিয়ে মার্চ করি, রাস্তায় দেখি শত শত লোক মুড়ি আর গুড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক জায়গায় অচেনা লোকেরাই রান্না করে খাবার দিয়েছে। এটা যে কত বড় সার্পোট, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন ও অ্যামুনেশন ক্যারি করার জন্য লোক লাগত। গ্রামের মানুষই ভলান্টিয়ার করেছে। সৈয়দপুরে ধরে ধরে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, রংপুরের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, বুড়িমারীতে রেপ করে মেরে ফেলা হয় বহু নারীকে। কই তাদের কথা তো আমরা তুলে ধরেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি আর্মিরা কোথায় লুকিয়ে আছে, তা আগেই এসে আমাদের বলে যেত সাধারণ মানুষ। কারণ তারা আমাদের সাথে ছিল। পাকিস্তানি আর্মিই বলেছিল– ‘যেদিকে দেখি সেদিকেই শক্রু দেখি। উই ক্যান্ট ট্রাস্ট আ সিঙ্গেল বেঙ্গলি।’ শক্তিতে তারা তো কোনো অংশেই কম ছিল না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সাথে ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল এটা। তাই একাত্তরে সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউশন ছিল সাধারণ মানুষের। উই মাস্ট স্যালুট দেম। কিন্তু স্বাধীনতার একান্ন বছর চলছে। উই ডোন্ট স্যালুট দ্য পিপল।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালের সাহিত্য ম্যাগাজিন কালের খেয়ায়, প্রকাশকাল: ২৪ মার্চ ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button