মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১: খুনিয়া দিঘি গণহত্যা

১৯৭১ সাল। সারা দেশে চলছে পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার। কিন্তু রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের লোকেরা তখনো বেশ শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিল। ডা. আব্দুর রহমান এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ন্যায়নীতি আর আদর্শ রক্ষার মানুষ তিনি। তাই গ্রামের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। নেকমরদ বাজারেই ছিল রহমান চেয়ারম্যানের একটি ওষুধের দোকান। পাশের  আরেকটি দোকানে ব্যবসা করতেন তারই আদরের ছোট ভাই সহমান।

সন্ধ্যা হলেই রহমানের দোকানে চলত মুক্তিযোদ্ধা আর মুজিব আদর্শের লোকদের আনাগোনা। চলত আর্মি আর রাজাকার ঠেকানোর নানা পরিকল্পনা। চারদিকে তখন পুরোদমে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। চলছে রাজাকার, আলবদর আর আলশামস বাহিনীর হত্যা, লুটতরাজ। আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতি রাতেই নির্বিচারে চলত হত্যা উৎসব।

নেকমরদ ইউনিয়নে আর্মি ঢুকলেই গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে সেখানে উপস্থিত হতেন আব্দুর রহমান। রক্ষা করতেন গ্রামের নিরীহ জনগণকে। এ নিয়ে দিন দিন রাজাকার, আলবদরের লোকেরা তার ওপর বেশ নাখোশ হতে থাকে। এরা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেয় পাকিস্তানি আর্মিদের।

খুনিয়া দিঘি বধ্যভূমি। ছবি: সালেক খোকন

একাত্তরের নভেম্বর মাসের শেষের দিকের ঘটনা। হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি এসে নেকমরদ বাজারের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায় চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানকে। খবর পেয়ে ছোট ভাই সহমান তখন ছুটে আসেন। বড় ভাইকে মুক্ত করতে বাধা দেন পাকিস্তান আর্মিদের। গর্জে ওঠে আর্মির মেজর। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘উসকো বি লে লো’। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সহমানকেও তুলে নেয় আর্মিরা। রানীশংকৈল ক্যাম্পে রেখে চালাতে থাকে পাশবিক নির্যাতন।

স্বামীকে বাঁচাতে রহমানের স্ত্রী আয়েশা বানু চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ধর্ণা দিতে থাকে আর্মি ক্যাম্পে। মেজরের পায়ে ধরেও মিলে না স্বামীর মুক্তি। রহমান ও সহমানের ওপর ১৩ দিন ধরে চালানো হয় নির্মম টর্চার। প্রতিদিনই আর্মিদের চেষ্টা চলে তাদের মুখ থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শোনার। কিন্তু ১৩ দিন টর্চার সেলে থাকার পরও তারা বশ্যতা স্বীকার করে না। অবশেষে চোখ বেঁধে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় খুনিয়া দিঘিতে। সেখানে ব্রাশফায়ারে রক্তাক্ত হয় রহমান ও সহমানের বুক। দেশের জন্য শহীদ হন দুই ভাই। খুনিয়া দিঘি পায় আরও দুটি প্রাণের তাজা রক্তের স্বাদ।

মুক্তিযুদ্ধের এ ঘটনাটি শুনছিলাম শহীদ রহমান ও সহমানের ভাতিজা ও অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল করিমের কাছ থেকে।

ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে রানীশংকৈল উপজেলা। উপজেলার উত্তর দিকের পাকা রাস্তাটি চলে গেছে কাঁঠালডাংগির দিকে। এ পথেই যেতে হয় নয়াভিরাম রানী পুকুরে। রাস্তার পাশেই প্রাচীন আমালের বড় বড় আমগাছ। গাছগুলোর অবয়ব দেখলে তেমটিই মনে হয়। দুই পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। মাঠের মধ্যে ঘন বাঁশঝাড়। কিলোখানেক যেতেই রাস্তার পাশের উঁচুতে কালো-সাদা টাইলস খচিত একটি স্মৃতিসৌধ নজরে এলো। ছোট্ট সিঁড়ি পেরিয়ে স্মৃতিসৌধের কাছে যেতেই পেছনে ভেসে উঠল বড় একটি দিঘি। এটিই খুনিয়া দিঘি।
কেন দিঘিটির এমন নামকরণ? এ রকম প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক তাজুল ইসলামের কাছ থেকে।

প্রচলিত কাহিনি মতে, প্রায় দুই শ বছর আগে স্থানীয় কোনো এক জমিদার খনন করেছিলেন দিঘিটি। এই এলাকার ব্যবসায়ীরা সে সময় দিঘির পাশ দিয়েই ব্যবসা করতে যেতেন রায়গঞ্জে। তখন দিঘির এলাকাটি বেশ নির্জন ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। একবার কে বা কারা এখানে এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘির পাড়ে ফেলে রেখেছিল। তখন থেকে দিঘির নাম খুনিয়া দিঘি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করে এই দিঘিটিতে ফেলে রাখে। স্বাধীনের পর এই দিঘির উত্তর দিকে পাওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি। জানা যায়, ১৯৭১-এ রানীশংকৈলসহ হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গি ও পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রতিদিন শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো রানীশংকৈল আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে টর্চারের পর তাদের হত্যা করে ফেলে দেওয়া হতো খুনিয়া দিঘিতে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার, আল বদর আর আলশামসের লোকেরা খুনিয়া দিঘি নামটিকে আরও সার্থক করে তোলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমি হিসেবে খুনিয়া দিঘি স্থান করে নেয় কান্নাভরা ইতিহাসের পাতায়।

রানীশংকৈলের বর্তমান প্রজন্ম ভালোভাবে জানে না খুনিয়া দিঘির কথা। জানে না শহীদদের আত্মাহুতির কাহিনিগুলো। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে ঘটা করে ফুল দেয়া ছাড়া যেন কিছুই করার নেই আর। গোটা দিঘিটিই পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়।
রানীশংকৈলের স্কুল শিক্ষক রুহুল আমিন জানেন না খুনিয়া দিঘির পুরো ইতিহাস। শুধু জানেন কিছু লোককে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে। উপজেলার টগবগে যুবক দিপংকর। ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় সারা পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু নিজের উপজেলার বধ্যভূমিটি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নেই তার।

বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। ছবি: সালেক খোকন

নিরাশার মধ্যেও থাকে আশার আলো। জানা যায়, বেসরকারিভাবে শুধু প্রগতি ক্লাবটি প্রতিবছর আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানের। অধ্যাপক তাজুল থেকে জানা যায় একবার প্রগতির অনুষ্ঠানে হরিপুর থেকে এসেছিলেন প্রয়াত ও খুনিয়া দিঘি থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সূর্য মোহন। জানিয়েছিলেন বেঁচে যাওয়ার লোমহর্ষক কাহিনিটি। দিঘিরপাড়ে অন্যদের সঙ্গে লাইন করে দাঁড় করানো হয় সূর্য মোহনকেও। ব্রাশফায়ারের গুলি তার বুকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দিঘির কচুরিপানার মধ্যে মড়ার মতো পড়ে থাকেন তিনি। পরে কৌশলে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।

তাজুল ইসলাম জানান, ১৯৭১-এ যে খুনিয়া দিঘিতে হত্যা করা হলো হাজার হাজার মানুষ। এখনো যেখানের মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। সে দিঘিটিকে ব দ্ধভূমি হিসেবে সংরক্ষণ না করে একবার মন্ত্রণালয় থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয় জনৈক হামিদুর রহমানের নামে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সুধী সমাজের প্রতিবাদের মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়।

কথা হয় রানীশংকৈল উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা শ্রী বিদেশী চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে চার নেতার অন্যতম কামরুজ্জামান খুনিয়া দিঘি স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন। খুনিয়া দিঘি বধ্যভূমিটিকে সংরক্ষণ করা, বড় একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি, বধ্যভূমির ইতিহাস ও শহীদদের নামের তালিকা বধ্যভূমি স্থলে টাঙানো, শহীদ পরিবারগুলোকে সম্মানিত করা এবং নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বধ্যভূমির ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি জোর দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যারা সাহায্য করেছিল, যারা এ দেশে বধ্যভূমির রূপকার সে সকল রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শেষ করতে হবে। পাকিস্তানি সেনাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস। বাঙালির ত্যাগের ইতিহাস, গর্বের ইতিহাস। স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও এ দেশের বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। ব্যথিত হতে হয় যখন চোখের সামনে দেখি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের মলিন মুখগুলো।
খুনিয়া দিঘি বধ্যভূমির ওপারেই লাল সূর্য ডুবে প্রতিদিন। দিঘির পাশেই একটি বড় শিমুলগাছ। অজস্র টকটকে লাল ফুল ফুটে আছে গাছটিতে। বসন্ত বাতাসের ঝাপটায় চোখের সামনেই কয়েকটি লাল শিমল ফুল এসে পড়ে খুনিয়া দিঘি স্মৃতিসৌধের বেদিতে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপ্রকাশ ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ মার্চ ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button