মুক্তিযুদ্ধ

 শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষদের কথা ঠাঁই পায়নি ইতিহাসে

`বায়ান্ন বছরে কি তাদের কোনো তালিকা হয়েছে? আমরা অন্যদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরলেও ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, যারা বিশ্ব জনমতকে স্বাধীনতার পক্ষে প্রভাবিত করেছিলেন, বিশ্ব যাদের দেখে হতভম্ব হয়েছিল, যারা বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সেই মানুষগুলো কিন্তু উপেক্ষিত হয়েই আছে উঠে আসেনি শরণার্থী ক্যাম্প তাদের জীবনের ইতিহাস

লালমনিরহাটে তখন এইট্টি পারসেন্টই ছিল বিহারী। রেলওয়ে কলোনিতে থাকত ওরা। ব্যবসা বাণিজ্য তখন তারাই নিয়ন্ত্রণ করত। স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা কোনোকালেই ভালো ছিল না।’

কেন?

‘ওরা খুব মারমুখী ছিল। ঘরে ঘরেই গরু-ছাগল পালত। কিন্তু তাদের গলায় কখনও দড়ি দিত না। ফলে আশপাশের বাঙালিদের জমিগুলোতে গরু-ছাগলগুলো হানা দিয়ে ধান, পাট, সবজি প্রভৃতি খেয়ে ফেলত। কোনো বাঙালি ওই গরু-ছাগলগুলো বেঁধে রাখলেই বিহারীরা তাকে টার্গেট করত। শহরে ঢুকলেই তাকে তারা দলবেঁধে বেদম পেটাত। এটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তাদের এমন মারমুখী আচরণ দেখেছি ছোটবেলা থেকেই।

বিহারীদের জন্য ছিল উর্দু হাই স্কুল ও গার্লস স্কুল। ওরা খেলার মাঠগুলো দখল করে রাখত। খেলতে গেলেই বড়রা এসে আমাদের মাঠ থেকে বের করে দিত। ফলে মারামারির ঘটনা ঘটত প্রায়ই। ওদের শেল্টার দিত পাকিস্তানের মদদপুষ্ট মুসলিম লীগ ও বিহারী নেতারা। লালমনিরহাট থেকে যদি বাঙালিদের তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে পুরো এলাকার মালিকানা থাকবে তাদের হাতে। এমন চিন্তা ছিল তাদের। স্থানীয় বাঙালি মুসলমানদের তারা ভেজাল মুসলমান বলেও গালি দিত।

তখন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ছাড়াও ন্যাপ মোজাফফর ও ভাসানীর ন্যাপ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) লালমনিরহাটে সক্রিয় ছিল। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়ত তারাও চলে আসায় শহরে ওই সময় ছাত্রআন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন থাকলেও সম্মিলিতভাবে সবাই ছিল এন্টি বিহারী। ফলে পাকিস্তানি বলতে লালমনিরহাটে আমরা বুঝতাম বিহারীদেরকেই।’

একাত্তরপূর্ববর্তী সময়ের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সামাদ। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই একাত্তর নিয়ে চলে আলাপচারিতা।

মোসলেম উদ্দিন ও ছালেহা খাতুনের বড় সন্তান সামাদ। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তবে কৃষিজমিও ছিল তাদের। ফলে স্বচ্ছলতা ছিল পরিবারে। তাদের বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার খোর্দ্দো সাপটানা, বিডিআর রোডে।

ট্রেনিং ক্যাম্পে লেখা সামাদের তথ্যাদি, ছবি: সালেক খোকন

সামাদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি লালমনিরহাট মিশন স্কুলে (বর্তমানে চার্জ অব গড স্কুল)। পরে লালমনিরহাট মডেল হাই স্কুল (বর্তমানে লালমনিরহাট বয়েজ স্কুল) থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৭০ সালে। অতঃপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন লালমনিরহাট কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। আব্দুস সামাদ কথা বলেন ছয় দফা ও এগার দফা আন্দোলন প্রসঙ্গে।

‘ছয় দফা দাবি ওঠার পরই ছাত্রসমাজের ভেতর সেটা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় সোনার বাংলা শ্মশান কেন? গ্রামেগঞ্জে গিয়ে এমন একটি লিফলেটও বিতরণ করি আমরা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যগুলো লিফলেটে তুলে ধরা হয়েছিল। ছয় দফা ছিল বাঙালির শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির উপায়। তখন এর বিপক্ষে অবস্থান নেয় ইসলামি ছাত্রসমাজ, মুসলিম লীগ ও বিহারীরা। এই ছয় দফাই পরে এগার দফায় উঠে আসে। আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করলেও ছাত্র-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিরা তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে নির্বাচনও দিতে হয় তাদের।

৭০-এর নির্বাচনে লালমনিরহাটে এমপিএ নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আবুল হোসেন আর এমএনএ হন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া। ভোটের আগে আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বোঝাতাম– নৌকা ও বঙ্গবন্ধুকে যদি ভোট দেন এত শোষণ নির্যাতন থাকবে না। বিহারীদের কাছে আমাদের আর মার খেতে হবে না। পাট বিক্রি করে ওরা বিনিয়োগ করছে পশ্চিম পাকিস্তানে। চিনি উৎপাদন করেও বেশি দামে কিনতে হয় আমাদের। আওয়ামী লীগ জিতলে এ বৈষম্য থাকবে না। গ্রামের মানুষ তখন প্রশ্ন করত, ‘বাহে, শেখের ব্যাটা যদি জিতে, পাটের দাম কি বাড়বে? আমরা বলি, ‘হ্যাঁ বাড়বে।’ বাঙালি চাকরি পাবে? তাও পাবে। লালমনিরহাটের মানুষ শেখের ব্যাটাকে নিয়ে এভাবেই স্বপ্নবিভোর হতে থাকে।’

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। মানুষও তখন বিশ্বাস করতে থাকে তাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। শেখের বেটাই হবেন প্রধানমন্ত্রী।

১ মার্চ ১৯৭১। দুপুরবেলা। বেতারে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

লালমনিরহাটে কী ঘটল?

সামাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়পত্র , ছবি: সালেক খোকন

সামাদের ভাষায়, ‘ছাত্রনেতা ছিলেন শরিফ উদ্দিন বাচ্চু ভাই, শহিদুল্লাহ ভাই, বাবলু ভাই প্রমুখ। তাদের নেতৃত্বে ক্লাস বন্ধ করে কলেজ থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। প্রতিবাদ মিছিলে স্লোগান তুলি– ‘মানি না মানব না, ইয়াহিয়ার ঘোষণা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ভুট্টো না কুত্তা– কুত্তা কুত্তা।’

এর পর থেকেই লালমনিরহাটে বিহারী-বাঙালি সংঘর্ষ বেড়ে যায়। বিহারীরা চোরাগুপ্তা হামলাও করতে থাকে। প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন সৈয়দ আলী। বড় বড় বিহারী ব্যবসায়ীরাও তাদের শেল্টারে থাকে। বিহারীদের নেতৃত্ব দিত কালু গুন্ডা। বাঙালি পেলেই সে চড়াও হতো।

২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। লালমনিরহাটে তখনও কিছু ঘটেনি। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ মোজাফফর ও ভাসানী ন্যাপ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে একটা কমিটি করে। এই কমিটি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহে নামে। এর পরই শুরু হয় বিহারীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।’

ভিডিও-১৯৭১: কীভাবে লালমনিরহাট শহর দখল করে নেয় পাকিস্তানি আর্মি?

সে ইতিহাসের কথা শুনি সামাদের মুখে, ‘প্রথম মাইকিং করা হয় লালমনিরহাট শহরে। যাদের কাছে অস্ত্র আছে তারা যেন আবুল এমপির কাছে অস্ত্রগুলো জমা দেয়। বিহারীদের কাছেও অস্ত্র ছিল। আপ-ইয়ার্ড নামে একটা জায়গায় ছিল বিহারী কলোনী। সেখানে অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে ২৭ মার্চ বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা বেধে যায়। আশাপাশের গ্রামগুলো থেকে এসে বাঙালিরাও যোগ দেয়। ওই সময় শাহজাহান নামে ছাত্রলীগের এক ছেলে গুলিতে মারা যায়।’

লালমনিরহাটে পাকিস্তানি আর্মিরা এলো কোন সময়টায়?

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে। ইপিআরের কুড়িগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। খবর পেয়ে তার কমান্ডে বাঙালি সদস্যরা তিস্তা ব্রিজে প্রতিরোধ গড়ে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষও। কেউ অস্ত্র ক্যারি করে, কেউ খাবার দিয়ে সহযোগিতা করে। পাকিস্তানিরা আর্টিলারি ব্যবহার করলেও দুই-তিনদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। পরে ওরা হারাগাছ হয়ে তিস্তা পার হয়ে ঢোকে। এপ্রিল মাসের দুই তারিখে আর্টিলারি ও গুলি করতে করতে লালমনিরহাটে আসে পাকিস্তানি আর্মি।’

পাকিস্তানি সেনারা গান পাউডার দিয়ে রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেয়। আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। রাস্তায় যাকে পেয়েছে পাখির মতো গুলি করেছে। সামাদরা পরিবারসহ আশ্রয় নেন বাঁশঝাড়ের ভেতর। ফলে গুলির আঘাত থেকে রক্ষা পান। ওইদিন বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা এয়ারপোর্টে ক্যাম্প বসায়। বিহারীরা পাকিস্তান জিন্দাবাদসহ নানা স্লোগান দিয়ে মিছিল ও পাকিস্তানি পাতাকাসহ তাদের স্বাগত জানায়। সামাদরা তখন এক মাইল দূরে সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। রাতে দূর থেকে দেখেন তাদের বাড়িসহ গোটা গ্রামটি জ্বলছে। তার বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে।

বিহারীদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা গ্রামগুলোতে হানা দিতে থাকলে শত শত মানুষ পালাতে থাকে। সামাদরাও পরিবারসহ লোহাকুচি সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যান ভারতের সীতাই থানার গীদারি গ্রামে, এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

কোথা থেকে কীভাবে ট্রেনিংয়ে গেলেন?

তার ভাষায়, ‘ওখানে দেখা হয় বন্ধু আব্দুর রহমান ও লুৎফর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে। ট্রেনিংয়ের খোঁজখবর জানতে আমরা যাই দীনহাটা শহরে। দেখা করি কমল গুহর সঙ্গে। তিনি ছিলেন নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি বামপন্থী দলের নেতা। আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে তিনি একটি চিঠি লিখে আমাদের বাসে করে পাঠিয়ে দেন কুচবিহারে, সুবোধ অধিকারীর কাছে। বিকেলের দিকে সেখানে পৌঁছলে সুবোধ বাবু গুপ্ত গোডাউন নামক একটা বড় পাটের গুদামে থাকার ব্যবস্থা করেন। একদিনেই সেখানে জড় হয় আরও শতাধিক ছেলে। পরে ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়ান আর্মি বাছাই করে চারটি ট্রাকে প্রথমে টাপুরহাট এবং পরে মূর্তি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পেই এক মাস ট্রেনিং হয়। দ্বিতীয় ব্যাচে ব্রাভো কোম্পানিতে ট্রেনিং করি। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৩৫/১২। আমি ছিলাম মর্টার স্পেশালিস্ট।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ প্রায় ৩৫টি অপারেশন করেন ছয় নম্বর সেক্টরের ডিমলা, ডোমার, জলডাকা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। একটি অপারেশনের কথা শুনি তার মুখে।

তার ভাষায়, ‘কেটকিবাড়িতে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ডিফেন্স। ওখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রামে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করত। তাই ওখানে অ্যাটাক করতে হবে। এমন প্ল্যান করেন ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী। উনার আন্ডারেই ছিলাম আমরা।

কিন্তু তার আগেই একটি খবর আসে। ডিমলা উপজেলায় আমবাড়ি নামক জায়গা আছে, সীমান্তের খুব কাছাকাছি। সেখানে একটা হাট বসে। দুপুর বেলা শুরু হয়ে বিকেলেই শেষ হয়ে যায়। ওই হাটে পাকিস্তানি মেজর আসবেন, শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিটিং করতে। আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেখানে অ্যাটাক করার। ক্যাপ্টেন চক্রবার্তী প্রথম ৫ জনকে সিলেকশন করেন– আমি, আব্দুর রাজ্জাক ভাই, রওশন-উল-বারী, শহিদুল হক মঞ্জু ও নূরুল ইসলাম। আরেকটা ছেলেও যুক্ত হয়। ওরা নাম শাহ আলম। বাড়ি চাঁদপুরে। ট্রেনে হকারি করত। যুদ্ধ শুরু হলে সে আর বাড়ি ফিরতে না পেরে রংপুরে আটকা পড়ে। সেখান থেকেই ভারতে ট্রেনিংয়ে যায়। দুর্দান্ত সাহসী ছেলে।

জুন মাসের শেষের দিকের ঘটনা। বর্ষাও তখন এসে গেছে। লুঙ্গি পরলাম সবাই। গামছা ও ছেড়া জামা গায়ে, কোমরে গ্রেনেড বাঁধা। মর্টার শেল, এলএমজি, এসএলআর, অটোমেটিক রাইফেল ছিল অস্ত্র। বড় ডালায় অস্ত্রগুলো রেখে তার ওপর কিনে আনা কাঁচামরিচ ঢেকে দিয়ে ক্যামোফ্লাজ করি। প্রথম গ্রেনেড চার্জ, এরপর গুলি ও মর্টার ফায়ার করব। এমনটাই পরিকল্পনা।

ছিলাম হিমকুমারীতে। সকাল ১১টার রওনা হয়ে অল্প সময়েই আমবাড়ি হাটের পাশে খালের ধারে পজিশন নিই। পাশেই সাদা কাশবন। ওখানেই অপেক্ষায় থাকি। আর্মিদের ট্রাক তখন এসে গেছে। ওরা রেঞ্জের ভেতর আসলেই অ্যাটাক করব। রাজ্জাক ভাই ও রওশন ভাই বলেন, এখনই ফায়ার ওপেন করলে ওরা হাটের শত শত লোককে মেরে ফেলবে। সিদ্ধান্ত নিলাম আগে পাকিস্তানি মেজরের অবস্থান জেনে আসার। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাটের ভেতর কে যাবে? শাহ আলম বলে, আমি যাব। এর মধ্যে গ্রামের লোকজন আমাদের দেখে নানা প্রশ্ন করছে। হাটের কোলাহলও বাড়ছে।

শাহ আলম তখন হাটের ভেতর ঢুকে দুটো গ্রেনেড চার্জ করে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই পালাতে থাকে। কিন্তু কী ঘটল কিছুই বুঝতে পারি না। আক্রান্ত না হলে তার গ্রেনেড চার্জ করার কথাও না। হাট ভেঙ্গে গেল। পাকিস্তানি আর্মিরাও দ্রুত ট্রাকে ব্যাক করল। কিছুই করতে পারলাম না। শাহ আলমও ওই যে গেল আর ফিরল না। খুঁজে তার লাশও পাইনি। কোথায় গেল তা আজও অজানা। ওর কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে।’

এরপর কি আপনারা ফিরে গেলেন?

‘না। শাহ আলমকে হারালাম। এটা ঠিক মেনে নিতে পারিনি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই কেটকিবাড়ি আক্রমণের। কিন্তু সেটার জন্য আগে রেকি করতে হবে। মর্টারম্যান হিসেবে দেখতে হবে কোন জায়গা থেকে ফায়ার করা যায়, মাটির অবস্থা শক্ত কিনা, নিলডাউন পজিশন নেওয়া যাবে কিনা– এমন নানা বিষয়।

রাজ্জাক ভাই বললেন, তুমি তোমার মতো রেকি করো। আমরা সার্পোট দেব। বললাম, একটা সাহসী লোক দেন। তার পরিচিত এক বাড়িতে অবস্থান নিই। বুড়া-বুড়ি ছিল। তারা চাল ভাজা আর কলা দেন খাওয়ার জন্য। ওখানে অপিল উদ্দিন নামে এক লোক আসে। বয়স ৪৫ বছর হবে। গ্রামের আনসার কমান্ডার ছিলেন। খুব সাহসী লোক। সম্পর্কে তিনি রাজ্জাক ভাইয়ের মামা হন। কেটকিবাড়ি গ্রামেই তার বাড়ি। উনি নানা তথ্য ব্রিফ করলেন এবং আমাকে নিয়ে গিয়ে রেকি করালেন।

সবকিছু ঠিক করলাম। ওইদিন মাগরিবের আজানের আগেই পজিশনে যাই। আধামাইল দূর থেকে ক্রলিং করে এগোই। কলাগাছের বাগানে বুনো কতগুলো কলাগাছ পাই। সেগুলো মাটিতে রেখে শক্ত জায়গা তৈরি করে মর্টারটা ফিট করি। ওদের ডিফেন্স লাইনটা খুব কাছে, দেখা যাচ্ছে। ওরা একটা গান গাইছে…তুম হে রে মেহেবুবও মেরে..। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা সবাই। হাতে থালা নিয়ে কেউ কেউ গানের তাল দিচ্ছে।

রওশন ভাই আমার বামে, তার সঙ্গে অপিল উদ্দিন। তাদের কাছে এসএমজি। সংখ্যায় কম হলেও ওরা যেন মনে করে অনেকজন মিলে অ্যাটাক করেছে। তাই আমরা তিনটি গ্রুপ করি। আমার সঙ্গে টোয়াইসি ছিল নূরুল ইসলাম। ডানে এলএমজিম্যান শহিদুল হক আর উনার টোয়াইসি রাজ্জাক ভাই। আমি মর্টার মারলে সব গুলি আমার দিকে আসবে। তার আগেই এলএমজির গুলি চলবে। বাম পাশ থেকে তখন রাইফেল, এসএমজি ফায়ারও শুরু হবে। এমনটাই পরিকল্পনা করি।

মাগরিবের আজানের ঠিক পূর্বের ঘটনা। ট্রেনিংয়ে বলা ছিল তিনটি মর্টার শেল ফায়ার করার পরই ফায়ার প্লেস চেঞ্জ করতে হবে। কিন্তু ওখানে তো পজিশন চেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। নূরুলকে বলি, তুই ১০টা সেলের ক্যাপ ওপেন করে দে। সে ওপেন করে ডান দিকে রাখে। নিলডাউন পজিশন নিলাম। সে শেল ঢোকালেই ফায়ার করি। তিনটা দেওয়ার পরই ব্যারেলটা গরম হয়ে যায়। এক মিনিট পরই আবার শুরু করি। এভাবে সাতটি শেল মারা হয়। একটা পড়ার আগেই বাকিগুলো ছিল আকাশে। মনে হচ্ছে যেন মর্টারের বৃষ্টি হচ্ছে। হিট করতেই আগুন জ্বলছে। দেখলাম, ওরা চিৎকার দিয়ে বলছে– ‘পজিশন লো, শালা লোক অ্যাটাক কারা।’

প্রথম আমরা ওদের টার্গেটে পড়ি। মাথা তুলতে পারি না। গুলি আর গুলি চলে। পরিকল্পনা মতো তখন বাকিরাও বিভিন্ন পজিশন থেকে ফায়ার করে। পাকিস্তানিরা তখন ভয়ে হিমকুমারী বিএসএফ ক্যাম্প, সামিলাবাস ক্যাম্প ও ভজগড়িপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের দিকে একযোগে হেভি আর্টিলারি ছুড়তে থাকে।

রাজ্জাক ভাই ও অপিল উদ্দিন কোথায় চলে গেছে জানি না। শহিদুল্লাহ তখনও গুলি করছে। চারাপাশের অবস্থা দেখে নূরুল ইসলাম অজ্ঞান হয়ে যায়। বেঁচে আসব কিনা কোনো ধারণা নেই আমাদের। পরে নূরুলকে নিয়ে ক্রলিং করে পেছনে সরে আসি। গ্রামের ভেতরে এক লোক চিনিয়ে নিয়ে যায় ইন্ডিয়ার ভেতর, সামিনাবাজ ক্যাম্পে।

সঙ্গে তখনও মর্টার ছিল। ফলে ইন্ডিয়ান আর্মি হ্যান্ডস অ্যাপ করায়। আমি বলি ‘হাম মুক্তি হ্যায়।’ কাহাছে আয়া, ‘হিমকুমারী ছে। ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী ছে আয়া।’ তারা যোগযোগ করলে পরদিন সকালে ক্যাপ্টেন সাহেব গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেন। কেটকিবাড়ি অপারেশনে ৮ পাকিস্তানি সেনা মারা গিয়েছিল। আমাদের সাহস দেখে ক্যাপ্টেন চক্রবর্তীও অবাক হন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও অপারেশনের খবরটি প্রচার করা হয়।’

ভিডিও-একাত্তরে সাধারণ মানুষের অবদান কেমন ছিল?

মুক্তিযোদ্ধা সামাদ মনে করেন, একাত্তরে সাধারণ মানুষই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও প্রাণ। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের রাস্তা চিনিয়েছে, খাবার দিয়েছে। শেষ সময়ে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সাধারণ মানুষই টেনে নিয়ে গেছে। আবার পাকিস্তানি সেনারা ছিল মরুভূমির যুদ্ধে অভ্যস্ত। ফলে ষড়ঋতুর দেশে ওরা টিকতে পারেনি। ওরা যে দিক দিয়েই যেত ওদের পজিশন ওপেন হয়ে যেত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। সাধারণ মানুষ ছিল তাদের পক্ষে।

মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে থাকা মানুষের কষ্টের কথা এখনও ইতিহাস ঠাঁই পায়নি। যা হওয়া প্রয়োজন ছিল। এ নিয়ে আব্দুস সামাদ আক্ষেপ করে বলেন– ‘একাত্তরে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে গড়ে ওঠে শরণার্থী ক্যাম্পেগুলো। সেখানে দেখেছি কলেরা, ডায়রিয়া ও ছোঁয়াচে রোগে মানুষ মারা গেছে শত শত। লালমনিরহাটের এক পারিবারের ১০ জনের মধ্যে ফিরে এসেছেন মাত্র দু-জন। অনেক কষ্ট ছিল ক্যাম্পগুলোতে। শরণার্থী ক্যাম্পের ওই মানুষগুলোর কথাও স্মরণ করতে হবে ভাই। বায়ান্ন বছরে কি তাদের কোনো তালিকা হয়েছে? আমরা অন্যদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরলেও ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, যারা বিশ্ব জনমতকে স্বাধীনতার পক্ষে প্রভাবিত করেছিলেন, বিশ্ব যাদের দেখে হতভম্ব হয়েছিল, যারা বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সেই মানুষগুলো কিন্তু উপেক্ষিত হয়েই আছে। উঠে আসেনি শরণার্থী ক্যাম্প ও তাদের জীবনের ইতিহাস। অথচ তাদের ঋণও শোধ হবার নয়।’

কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধার?

এই বীর যোদ্ধার অকপট উত্তর, ‘স্বপ্ন ছিল শোষণহীন মানবিক বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। শ্রম ও মেধা দিয়ে মানুষ গড়ে উঠবে। সততা ও দক্ষতাই হবে দেশপ্রেমের মাপকাঠি। সেটা তো নাই। যাদের কোটি টাকা আছে তারাও এখন দেশপ্রেমিক না। তারা দেশের বাইরে চলে যেতে চায়, যাচ্ছেও। আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না পেলে এটা আরও বাড়বে। কালো টাকায় রাজনীতি ভরে গেছে। এটা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়।’

পরিবারের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সামাদ, ছবি: সালেক খোকন

একাত্তরের তৃণমূলের ইতিহাস তুলে আনলে আর স্বাধীনতার জন্য লাখো মানুষের ত্যাগের ঘটনা একত্রিত করলে একটি মহাসমুদ্র হবে। সে ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ। তৃণমূলের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরারও আহ্বান জানান তিনি।

আগামী প্রজন্মকে নিয়ে পাহাড়সম আশা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, ‘তোমরা দেশের জন্য পূর্বপুরুষের ত্যাগের ইতিহাসটা মনে রেখো। দুর্নীতিকে ঘৃণা করো। মনে রেখো সততার সঙ্গে নিজের কাজটি করাই দেশপ্রেম। স্বাধীন এই দেশটা তোমাদের হাতেই আমরা দিয়ে গেলাম।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ মার্চ ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button