মুক্তিযুদ্ধ

জল্লাদ কাদের মোল্লা এবং মিরপুর অভিযান

দিনটি ছিল ২৩ মার্চ ১৯৭১, মধ্যরাত। কালসী আহুরা গ্রামে আগুন দেয় বিহারিরা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এক মাস্টারের বাড়ি। শুরু হয় লুটপাট। পরের দিন দুয়ারীপাড়ায় আগুন দেয় তারা। প্রাণভয়ে আমরা চলে যাই তুরাগ নদীর ওপারে। আশ্রয় নিই বিরুলিয়া গ্রামে।ঢাকায় আর্মি নামে ২৫ মার্চ রাতে। লোকমুখে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সবার মধ্যে আতঙ্ক, অজানা ভয়। আর্মি আসার শঙ্কায় কাটতে থাকে আমাদের দিনগুলো।

২৩ এপ্রিল সকাল। ঘরে খাবার নেই। বাবা বললেন, ‘চল, লাল ধান কেটে আনি। গাঙের পাড়ে ছিল আমাদের জমি। বিকেল পর্যন্ত ধান কেটে আমরা মাঠেই স্তূপ করে রাখি। ধান নিতে নৌকা নিয়ে আসবে ছোটভাই আমজাদ মোল্লা। তার অপেক্ষায় থাকি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। তবু আমজাদের দেখা নেই।

পাশেই ছিল আলব্দী গ্রাম, আমার বাবা-মায়ের নানাবাড়ি। গ্রামের প্রায় সবাই নিকটাত্মীয়। আমরা রাতটা ওই গ্রামেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিই। উঠি আমার খালু রোস্তম বেপারির বাড়িতে।

আলব্দী গ্রাম তখন নারী ও শিশুশূন্য। বাড়িগুলোর পাহারায় পুরুষরা। সময়টা ধানকাটার। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কৃষাণরাও আশ্রয় নেন গ্রামে।

২৪ এপ্রিল ১৯৭১। ভোর তখনো হয়নি। আলব্দী গ্রামের পশ্চিমে তুরাগপাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হেলিকপ্টার নামে। দূর থেকে আমরা তা স্পষ্ট দেখি। নেমেই তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। আগুন ধরিয়ে দেয় বাড়িগুলোতে।

গ্রামে ঢোকার একমাত্র পথটি ছিল কাদের মোল্লা, বিহারি আক্তার গুন্ডা, নেওয়াজ ও ডোমাদের দখলে। তারা দলবল নিয়ে আলব্দী গ্রামে ঢোকে সশস্ত্র অবস্থায়। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে অংশ নেয় হত্যাযজ্ঞে। গ্রামের নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে নির্বিচারে। পাশাপাশি চলে বাড়ি বাড়ি লুটতরাজ।

খালুকে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেন বাবা। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হন না। বাবা তখন আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। উত্তর দিকে ক্ষেতের পাশে ছিল একটি ছোট্ট খাল। খালের কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে থেকে আমরা হত্যাযজ্ঞ দেখি।

সকাল তখন আনুমানিক ৯টা। কুয়াশা পুরোপুরি কেটে গেছে। খালের পঞ্চাশ গজ দূরে ধরে আনা হয় ৫০-৬০ জনকে। তাদের লাইন করে দাঁড় করায় যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লোকেরা। হঠাৎ গুলির শব্দ। একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লাইনের সবাই। পড়েই ছটফট করতে থাকে। মা গো, বাবা গো চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আলব্দীর বাতাস।

লাশগুলো পরে ফেলে দেওয়া হয় গ্রামেরই তিনটি কূপে। কিছু লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় তুরাগে। আমার খালুর লাশ পড়েছিল বারান্দাতে। বাড়িটি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও কাদের মোল্লার লোকেরা। আগুনে ঝলসে গিয়েছিল খালুর শরীরের অর্ধেকটা।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ দেখেছি আমি। ওইদিন তারা হত্যা করে ৩৪৪ জনকে। ৬৪ জন ছিল গ্রামের লোক। বাকিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কৃষাণ। স্থানীয়দের ২১ জনই ছিলেন আমার নিকটাত্মীয়। তারা হলেন রুস্তম আলী, সলিমউল্লাহ, আ. আউয়াল মোল্লা, সুলেমান মোল্লা, করিম মোল্লা, জয়নাল মোল্লা, কাশেম মোল্লা, বদরুদ্দিন, জোরা মোল্লা, বিশু মোল্লা, অজল হক, ফজল হক, রহমান বেপারি, নবী মোল্লা, আলামত মিয়া, ধনা মৌলভী, ফুলচান, নওয়াব মিয়া, ইয়াছিন বানু, লালু চান ও সুনু মিয়া।

মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই আক্তার গুন্ডা, ডোমা, নেওয়াজ ও কাদের মোল্লাকে চিনতাম। মিরপুরে বিহারি রিফিউজিদের সংখ্যা ছিল বেশি। মাত্র পঞ্চাশটির মতো পরিবার ছিল বাঙালি। ওরা নির্ভরশীল ছিল সরকারি রিলিফের ওপর। বাঙালিদের গাছ থেকে ওরা আম-কাঁঠাল চুরি করে নিত। এ নিয়ে বহুবার তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কখনো তা রূপ নিয়েছে হাতাহাতিতে।

সত্তরের নির্বাচনে আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ছিল বিহারিরা। মিরপুরে বিহারিদের নেতৃত্ব দিত আক্তার গুন্ডা। তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ও রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সংগঠক কাদের মোল্লা। স্থানীয় মেম্বার লতিফও ছিল তাদের পক্ষে। মিরপুর দশ নম্বরে তাদের একটি কার্যালয় ছিল। ওখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মীর আবুল কাশেম, সরদার আব্দুস সালাম প্রমুখের।

আলব্দী গ্রামের হত্যাযজ্ঞের কথা এভাবেই ব্যক্ত করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা। তার বাড়ি ঢাকা মহানগরের পল্লবী থানার দুয়ারীপাড়ায়। বাবার নাম সুরজত আলী মোল্লা, মা রাহিমা খাতুন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষার্থী।

একাত্তরে আসামের কাছাড় জেলার লায়লাপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে আটাশ দিন ট্রেনিং নেন তিনি। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৯১৯৯৭। ট্রেনিং শেষে দুই নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দারের নির্দেশে যুদ্ধ করেন মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। সাদুল্লাপুর বাজার, বাটুলিয়া গ্রাম, আরিচা থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তা দখল, নতুন বিমানবন্দর এলাকায় ২৮ জন রাজাকার আটক প্রভৃতি অপারেশনে অংশ নেন তিনি। তাদের ২১ জনের গেরিলা দলের কমান্ডার ছিলেন মো. হানিফ। তিনি ছিলেন কোৎ-কমান্ডার (অস্ত্র রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার)।

একাত্তরে মিরপুরের একটি অপারেশনে মারাত্মক আহত হন আমির হোসেন মোল্লা। সেই অপারেশনের বিস্তারিত বর্ণনা করে তিনি বলেন, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। মিরপুর তখনো স্বাধীন হয়নি। আমরা ছিলাম বিরুলিয়ার একটি বাড়িতে। ত্রিশ-বত্রিশজন। রাত তখন ২টা। হঠাৎ খবর আসে বিরুলিয়া ঘাটে পাঞ্জাবি আসার। আমরা দ্রুত সেখানে পজিশন নিই।

ঘন কুয়াশা। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ভোর হতেই দেখলাম নদীর দিকে কুয়াশাভাঙা রাস্তা। জেলেরা বলল, ওই পথেই গেছে সাত জন পাঞ্জাবি। নদীর তে-মোড়ায় (ত্রিমোহনা) গিয়ে তাদের অ্যাটাক করব, এমনটাই পরিকল্পনা ছিল। তুরাগ পার হয়ে আমরা চকে চলে আসি। আমাদের নেতা সহকারী কমান্ডার রফিক। তিনটি দলে আমরা তিনদিকে এগোই। আমি পূর্বপাশে, সঙ্গে সাত্তার ও মহিউদ্দিন। পাঁচজন গেল পশ্চিম পাশ দিয়ে। রফিক কমান্ডার চারজনকে নিয়ে এগোয় মাঝ বরাবর।

আমরা পাঞ্জাবিদের দেড়শো গজের মধ্যে চলে আসি। হঠাৎ পুবদিকের বোটানিক্যাল গার্ডেনের শেষ অংশে জন্দি রাডার ক্যাম্প থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও বিহারিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল সেটি। আমাদের লক্ষ্য করে তারা মর্টার দাগে। আমরাও গুলি ছুড়ি। কিন্তু গোলার মুখে টিকতে পারি না।

ঘণ্টা দুয়েক চলে গোলাগুলি। হঠাৎ পেছন দিকে ‘মাগো’ বলে পানিতে ছিটকে পড়ে সাত্তার। তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায় মহিউদ্দিন। আমি তখনো কাদার মধ্যে লাইন পজিশনে। গুলি ছুড়ছি। ক্রলিং করে মহিউদ্দিন সামনে আসে। জানায় সাত্তারের মৃত্যু সংবাদ। মাথায় গুলি লেগেছিল তার।

আমি মহিউদ্দিনকে পজিশন নিতে বললাম। হঠাৎ সে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘তোর হাঁটুতে রক্ত।’ কখন যে গুলি লেগেছে টেরই পাইনি। গুলিটি আমার ডান পায়ের হাঁটু দিয়ে ঢুকে উরু দিয়ে বের হয়ে ডান হাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়। দেখলাম, রক্তে ভিজে গেছে গোটা পা। হাড়ের হলুদ মজ্জা বেরোচ্ছিল। আমি স্থির হয়ে যাই। মনে তখন মৃত্যুভয়। অবশ হয়ে যাচ্ছিল ডান হাত। ডান পা-ও নাড়াতে পারছিলাম না। শরীর শুধুই ঘামছিল। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ দুটো।

নৌকায় করে আমাকে নেওয়া হয় বিরুলিয়ায়। নবীউল্লাহ নামে এক গ্রাম্য ডাক্তার কাঁথা সেলাইয়ের সুই দিয়ে আমার পা সেলাই করে। ওই অপারেশনে দুজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং পাঁচজন সারেন্ডার করেছিল।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button