কলাম

বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্প

নানা শঙ্কা ও আশঙ্কা কাটিয়ে পনেরো ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। পহেলা ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনা সংক্রমণের কারণে বইমেলা পিছিয়ে যায়। তবুও লেখক, পাঠক ও প্রকাশকরা আনন্দিত। মেলাটি অন্তত ভাষার মাসে শুরু করা সম্ভব হচ্ছে।বইমেলার প্রাঙ্গণে এখন টুং-টাং শব্দ। স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজাতে ব্যস্ত প্রকাশকরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে নতুন বইয়ের অনলাইন প্রচারও। প্রচ্ছদশিল্পীদের নতুন নতুন প্রচ্ছদের ছবি ঘুরছে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়। মেলার মাঠে পাঠকদের আগাম আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন লেখক-প্রকাশকরা। প্রেসগুলোতে নতুন বইয়ের কাজ চলছে রাত-দিন। বাঁধাইখানার কর্মীদেরও দম ফেলার উপায় নেই। বই ঘিরে এমন আয়োজন বছরের অন্য সময়ে খুব একটা দেখা যায় না।

কিন্তু বইমেলার শুরুটা আসলে কেমন ছিল? অমর একুশে গ্রন্থমেলার (এখন বইমেলা) সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা’ নামটি। এ দেশে প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনিই প্রথম গ্রন্থমেলার সূচনা করেন। প্রথম মেলাটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায়, এক টুকরো চটের ওপর। কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে তিনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেছিলেন। সে বইগুলো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। যা ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ (বর্তমানে যা মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।

১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই গ্রন্থমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী গ্রন্থমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছরই যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিও। ১৯৮৪ সালে এ মেলার নামকরণ হয়ে যায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এভাবে চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলাটিই এখন বাঙালির প্রাণের বইমেলায় পরিণত হয়েছে।

কিন্তু সে প্রাণের বইমেলা পাঠকদের কাছে যেসব বই এখন পৌঁছাচ্ছে সেসব কতটা মানসম্পন্ন? বইমেলা এলেই এ নিয়ে কথা ওঠে। বাংলা একাডেমি বরাবরই মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন বইয়ের একটি সংখ্যা গণমাধ্যমকে জানায়। কিন্তু বইগুলোর তালিকা বা কোন পদ্ধতিতে মান নির্ধারণ করা হলো তা জানানো হয় না। ফলে মানসম্পন্ন বই নিয়ে এক ধরনের ধূম্রজাল থেকেই যায়।

কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশ প্রকাশকের কাছে বইমেলাই বই প্রকাশের বড় উপলক্ষ। বিক্রির বিষয়টি মাথায় রেখে মেলাকে ঘিরেই তারা বই করেন। ফলে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে প্রুফ দেখা ও সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। আবার অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থারই নিজস্ব সম্পাদনা দল নেই। এতে রংচঙা প্রচ্ছদ মোড়ানো ভুলে ভরা যে বইগুলো মেলায় আসে, প্রকৃতপক্ষে তা পাঠককে কতটা আন্দোলিত করে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই দায়টি লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরোবে এমন অনেক লেখকই নিয়মিত লেখেন না। ফলে লেখালেখির অনেক ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও তারা পাঠক তৈরির চেষ্টা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকেন। ভালো পা-ুলিপি ও ভালো সম্পাদনার মাধ্যমে মানসম্পন্ন বই না করলে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাই শুধু বাড়বে, তা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি হবে না। আর এ দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি লেখক-প্রকাশকেরও।

আবার বইমেলা এলেই গণমাধ্যমের তোড়জোড় বেড়ে যায়। পত্রিকাগুলোতে প্রতিদিনই থাকে বইয়ের খবর। চ্যানেলগুলোতে চলে বই, পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান। বই পরিচিতি, লেখকদের সাক্ষাৎকার, পাঠকের চাহিদা, প্রকাশকদের নানা সমস্যা ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশের গুরুত্ব, শিশুদের জন্য শিশু উপযোগী বই প্রকাশ করা, বাংলা বইকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয় সেখানে। এ সময় চ্যানেলগুলোতে বই নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান লেখকরাও। বই নিয়ে তাদের সে কথাগুলো ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। ফলে অনেকের মনেই নতুন বই কেনা-পড়া বা লেখার প্রতিও এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। এভাবে বইমেলাকে ঘিরে বইয়ের পাঠক ও ক্রেতা তৈরিতে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পায় মানুষ সে বিষয়ে চিন্তা করে। এক অর্থে গণমাধ্যম যা ভাবায় মানুষ তাই-ই ভাবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের লাগবে আলোকিত মানুষ। সেই মানুষ তৈরিতে বইকে ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্মের কাছে।

কীভাবে সেটা সম্ভব? বইমেলার সময়ের মতো সারা বছরই পত্রিকাগুলো বইয়ের খবর, প্রচ্ছদসহ বই পরিচিতি বা বই নিয়ে আলোচনা অনায়াসেই ছাপাতে পারে। সেখানে থাকতে পারে বই নিয়ে নানা অর্জনের খবরও। চ্যানেলগুলোতে অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখানো হয় নিয়মিত। কিন্তু ফেব্রুয়ারি ছাড়া বই নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানই আমরা পাই না। আশার কথা, কয়েক বছর ধরে বইমেলার মাঠে বই নিয়ে অনুষ্ঠানগুলো স্পন্সর করছে কথাপ্রকাশ, পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স, জার্নিম্যান বুকের মতো প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তারা চাইলে চ্যানেলগুলোতে প্রতি মাসে বই নিয়ে কমপক্ষে দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে অংশীদার হতে পারে সম্মিলিতভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও। এ নিয়ে উদ্যোগী হতে হবে গণমাধ্যমকেই।

বইয়ের পাঠক বেড়েছে নাকি কমেছে তা নিয়ে নানা মত ছিল ও আছে। পাঠক বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনেক প্রকাশকই কেবল মেলায় বই বিক্রির মাপকাঠি হিসেবেই তুলে ধরেন। আবার অনেকেই ফেইসবুক ব্যবহারের ফলে বই পাঠকের সংখ্যা কমেছে বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ তোলেন। অথচ আমরা দেখি কয়েক বছর আগ থেকেই ফেইসবুকেও গ্রুপ তৈরি করে সাহিত্যচর্চার রীতি চালু হয়েছে। শুদ্ধচর্চা, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও নান্দনিক কিছু সৃষ্টির প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে কাজ করছে ‘পেন্সিল’-এর মতো অসংখ্য অনলাইন গ্রুপ। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের নতুন পাঠক তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।

পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও। প্রতি বছর শুধু অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বই। ফলে করোনা সংক্রমণের এ সময়টায় বড় বড় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান নিজেরাই চালু করেছে বই বিক্রির অনলাইন কার্যক্রম। বইয়ের পাঠক তৈরি ও বই বিক্রিতে যা গতি আনবে বলে মনে করেন অনেকেই।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, এনজিও ও বেসরকারি সংস্থাও বই কেনে প্রতি বছরই। সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলার আয়োজন হচ্ছে। এসব উদ্যোগ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি বইয়ের নতুন পাঠক ও ক্রেতা তৈরিতেও এসব বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বই নিয়ে এমন উদ্যোগ আরও বাড়ানো দরকার।

করোনা সংক্রমণের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, ছাপাখানা ও বাঁধাইয়ের কর্মীরাও। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হতে হবে সবাইকে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিছুদিনের জন্য থাকতে হয় একা। ওই সময় তার সবচেয়ে উপকারী বন্ধু হতে পারে বই। তাই বইমেলায় গিয়ে কিংবা অনলাইনে প্রতি পরিবার যদি ৫টি করে নতুন বই কিনে তাহলেই প্রকাশনা শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। সবাই উদ্যোগী হলে সেটি করা যায় খুব সহজেই।

সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তর প্রতি বছরই বই কিনে থাকে। বাজেট বৃদ্ধি করাসহ সরকার বিশেষ তহবিল গঠন করে প্রকাশকদের কাছ থেকে বই কিনে ছড়িয়ে দিতে পারে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং লাইব্রেরিগুলোতে। এতে একদিকে যেমন পাঠাভ্যাস তৈরি হবে, তেমনি বইয়ের আলোয় আলোকিত হবে প্রজন্ম।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button