আদিবাসী

স্বপ্নে যখন বিছানা ভেজাতো ডুংগা

আদিবাসী লোককথা

এক গ্রামে ছিল এক যুবক। তার নাম ডুংগা। বয়স বাইশ বছর। নিজেকে সে খুবই চালাক মনে করতো। কিন্তু তার ছিল বিশ্রি এক রোগ।

কি সেই রোগ? ঘুমের মধ্যে প্রতিরাতেই সে বিছানায় প্রস্রাব করতো। এতো বড় ছেলে বিছানায় এমন কাজ করে! এ নিয়ে ডুংগার বাবা-মার চিন্তার অন্ত নেই।

তারা বড় বড় কবিরাজ ডেকে আনে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় না।

একবার এক নামকরা কবিরাজ আসে ওই গ্রামে। তার পরামর্শে উপকার পেয়েছে অনেকেই। খবর পেয়ে ডুংগাকেও কবিরাজের কাছে নিয়ে আসে তার বাবা-মা।

কবিরাজ ডুংগাকে খুব ভালভাবে দেখলেন। এরপর গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ওকে বিয়ে করিয়ে দিন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ডুংগার বাবা-মা তাই করলেন।

কিন্তু বিয়ের পরও সমস্যা গেল আরও বেড়ে। বুদ্ধিমান ডুংগা নিজেকে বাঁচাতে বুদ্ধি আঁটে। ঘুমের মধ্যে প্রতিরাতে সে বিছানায় প্রস্রাব করে তার দোষ চাপিয়ে দেয় স্ত্রীর ওপর। বলে, ‘আমি নই। এ কাজ ও করেছে।’

লজ্জা আর অপমানে দিন দশেকের মধ্যেই ডুংগার স্ত্রী পালিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ডুংগার বাবা-মার আবার কপালে হাত। ছেলেকে নিয়ে কী করবে তারা?

দূর গ্রামে তখন আরেক কবিরাজ আসে। খবরটা পেয়েই ডুংগাকে নিয়ে বাবা-মা ছুটেন তার কাছে।

কবিরাজ ডুংগার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘কেন তুমি স্বপ্নের মধ্যে প্রস্রাব করো?’

মাথা নিচু করে একরাতের কথা জানায় ডুংগা।

ঘুমের মধ্যে আমি খেলছিলাম। হঠাৎ দলনেতা খেলা বন্ধ করে সবাইকে প্রস্রাব করে আসার নির্দেশ দিলেন। আমি তাই করলাম। ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি বিছানায় প্রস্রাব করে দিয়েছি। এভাবে…।

শুনে কবিরাজ মুচকি আসলেন। ডুংগাকে তিনি পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘ওই দলনেতাই হলো শয়তান। এরপর তোমার দলনেতা বা অন্যকেউ যখনই এটা বলবে তুমি তার কাছ থেকে টাকা চাইবে। স্বপ্নে তো সে টাকা দিতে পারবে না। ফলে তোমাকেও আর বিছানায় প্রস্রাব করতে হবে না।’

কবিরাজের কথা মতোই ডুংগা প্রস্তুতি নিল। রাতে কবিরাজের দেওয়া ঘুমের বড়ি খেয়ে সে ঘুমাতে গেল। স্বপ্নে এবার শয়তানটা মামার রূপে আসলো। সে ডুংগাকে প্রস্রাব করার প্রস্তাব করতেই সে টাকা চাইল।

মামা তখন বললো আমারও কিছু টাকা দরকার। চল একটা কাজ করি। পাশেই তো মন্ডলের বাড়ি। ওই বাড়িতে চুরি করতে যাই। ডুংগাও মামার প্রস্তাবে রাজি হলো।

দুজন ঘরের জানালা কেটে মন্ডলের ঘরে যেই ঢুকলো, অমনি চোর চোর বলে সে চিৎকার করতে থাকলো। ভয়ে দুজনেই বাড়ির আমগাছের উপরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মন্ডল তো গাছের নিচ থেকে সরেই না! চোর ধরতে সে গাছের নিচে এসেই দাঁড়িয়ে থাকে।

ডুংগা পড়ল বিপদে। সে মামাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মামা, এখন কী করব?’

মামারূপী শয়তান এবার ডুংগাকে বললে, ‘মামা, তুমি মন্ডলের মাথার ওপর মলত্যাগ করে দাও। তাহলে সে তা ধুতে পুকুরপাড়ে যাবে। আর সে সুযোগেই আমরা গাছ থেকে নেমে পালিয়ে যাবো।’

ডুংগা ভাবল জীবন বাঁচাতে এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি আর কি হতে পারে? মামার কথামতো মন্ডলের মাথায় সে মলত্যাগ করে দিলো। আর অমনি শয়তান হাততালি দিতে থাকলো। ডুংগারও তখন ঘুম ভেঙে গেল।

সজাগ হয়ে ডুংগা দেখলো বিছানাতেই সে মলত্যাগ করেছে। হতভম্ভ হয়ে সে বলল, হায় হায় একি হলো! আগে তো বিছানায় প্রস্রাব করতাম। এখন দেখি মলত্যাগ করে ফেলেছি। এভাবেই কবিরাজের পরামর্শ মাঠে মারা গেল।

কোচ আদিবাসীদের এমন কাহিনি শুনে সবাই হয়তো হেসে লুটোপুটি খাবে। কিন্তু যুগে যুগে দাদি-নানিদের মুখে শোনা এমন কাহিনিগুলোই আদিবাসী শিশুদের নির্মল আনন্দ দিয়ে আসছে। আদিবাসী সমাজে এক সময় লোকচিকিৎসাই ছিল প্রধান। মন্ত্রপাঠ, পানিপড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি ছিল রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো নিয়ে প্রচলিত ছিল হাস্যরসাত্মক মুখরোচক গল্প যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সাহিত্যকে।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৫ জুন ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button