আদিবাসী

সিঁদুর যেভাবে এলো

আদিবাসী লোককথা

চার বন্ধু। সবার মধ্যে ভাব খুব। যে কোন কাজই একসঙ্গে করে তারা। একবার কোনো এক কাজে তারা রওনা হয় দূরদেশে। যেতে যেতে তারা পৌঁছায় এক জঙ্গলের ভেতর। সন্ধ্যা গড়িয়ে ঠিক তখনই হলো রাত।

কী করবে তারা? বাধ্য হয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রিযাপনের। কিন্তু জঙ্গলে তো অনেক বিপদ। বন্যপ্রাণীও আক্রমণ করতে পারে। তাহলে কীভাবে থাকবে তারা? চিন্তা করতে থাকলো তারা। শেষে সিদ্ধান্ত হয় গোটা রাতে বিপদ এড়াতে পালাক্রমে একজন করে জেগে থেকে পাহারা দিবে।

চার বন্ধুর মধ্যে একজন কাঠুরে, একজন স্বর্ণকার, একজন তাঁতি এবং চতুর্থজন ছিল সিঁদুর বিক্রেতা। প্রথমে জেগে থাকল কাঠুরে। বাকি তিন বন্ধু তখন ঘুমিয়ে থাকে। কাঠুরে একা একা জেগে কী করবে? সে একটি কাঠ কেটে এনে তা থেকে গড়ল অপরূপ এক নারীমূর্তি। মূর্তিটি তৈরি করেই সে স্বর্ণকার বন্ধুটিকে জাগিয়ে দিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়ল।

স্বর্ণকার বন্ধুটি ঘুম থেকে জেগেই পাহারা দিতে থাকে। এক কোণে নারী মূর্তিটি দেখে তো সে অবাক! সে তখন জেগে জেগে কী করবে? গয়না তৈরি করে তা নিয়ে সাজাল নারী মূর্তিটিকে। তার সময় শেষ হতেই সে তাঁতি বন্ধুকে জাগিয়ে নাক ডেকে ঘুমোতে থাকলো।

তাঁতি জেগে মূর্তি দেখেই চমকে যায়। একা একা জেগে সে কী করবে?  কাপড় তৈরি করে মূর্তিটিকে চমৎকার করে জড়াল। নারীমূর্তিটিকে দেখতে তখন অপরূপ লাগল। এরপর সে সিঁদুর বিক্রেতা বন্ধুটিকে জাগিয়েই নিজে ঘুমিয়ে পড়ল।

সিঁদুর বিক্রেতা নারীমূর্তি দেখে তো অবাক। মধ্যরাত্রে অলংকার ও কাপড়ে মোড়ানো এমন অপরূপ নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? সে তখন কী করবে? সিঁদুর পরিয়ে দিল নারীমূর্তিটিকে। ঠিক তখনই নারীমূর্তিটি প্রাণ পেয়ে কথা বলা শুরু করলো। ওই নারীর কণ্ঠে ঘুম ভাঙল অন্য বন্ধুদের। জেগেই অপরূপ নারীকে দেখে সবাই চমকে যায়। মূর্তি হয়ে গেছে অপরূপা সুন্দরী রমণী।

এবার কাঠুরে বলে, এ রমণী আমার। কারণ আমিই ওকে প্রথম গড়েছি। স্বর্ণকার বলে, আমি ওকে সাজিয়েছি। তাই সে আমারই হবে। তাঁতি বলে, আমি কাপড় বুনে ওর লজ্জা ঢেকেছি। সুতরাং ও আমারই হবে। সিঁদুর বিক্রেতা বলে, আমার সিঁদুরে সে প্রাণ পেয়েছে। তাই এ রমণী আমার। এসব নিয়ে চার বন্ধুর মধ্যে চলছে তুমুল ঝগড়া।

এমন সময় আসমান থেকে নেমে এলো এক দেবতা। তাকে পেয়ে চার বন্ধুই ছুটে আসে। তারা দেবতাকে সব খুলে বলে এবং প্রত্যেকেই সুন্দরী রমণীকে নিজের বলে দাবি করে। সব শুনে তিনি মুচকি হাসেন। তারপর দেবতা রায় দেন, যে কাঠ দিয়ে মূর্তি গড়ল সে রমণীর বাবা। যে অলঙ্কার তৈরি করে সাজিয়েছে সে ওর মামা। যে কাপড় পরিয়েছে সে ওর ভাই। আর যে সিঁদুর দান করে ওর প্রাণ দিয়েছে সে হবে রমণীর স্বামী। দেবতার এ রায় মেনে নিয়ে চার বন্ধু রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

সিঁদুরের প্রচলন নিয়ে আদিবাসী সমাজে খুঁজে পাওয়া যায় এমন কাহিনী। এভাবে আদিবাসী সমাজে সিঁদুর দান থেকে একটি সুখি পরিবারের সৃষ্টি হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজে সিঁদুরের ব্যবহারটি এসেছে মূলত আদিবাসী সমাজ থেকেই। হিন্দুদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ পুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ প্রভৃতিতে ঘট স্থাপনের কথা বলা হলেও কোথাও সিঁদুরের উল্লেখ নেই।

এছাড়া পণ্ডিতেরা সিঁদুর দানের বিষয়ে পৌরাণিক কোনো শাস্ত্রও খুঁজে পায়নি। সর্বপ্রথম পালযুগে হিন্দু সমাজে প্রথানুসারে সিঁদুর দানের স্বীকৃতি পায়। অথচ তারও বহু আগে থেকে স্বীকৃতি ছাড়াই আদিবাসী সমাজে সিঁদুর জনপ্রিয় ছিল।

অলঙ্করণ: সোহাগ পারভেজ

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৩ মে ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button