আদিবাসী

জীবন পেল চন্দ্র-সূর্য

আদিবাসী লোককথা

সে অনেক কাল আগের কথা। ধরমেশ তখন ওরাওঁ জাতির সৃষ্টিকর্তা। তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। একেবারেই নিজের পছন্দ মতো। সে পৃথিবীতে সবকিছু আছে। নেই শুধু চন্দ্র, সূর্য আর তারকা।

মানুষের আকার তখন ছিল অনেক ছোট। এতো ছোট যে, চাষাবাদের জন্য জমিতে লাঙ্গল দেওয়া হতো ইঁদুর দিয়ে। পৃথিবীতে তখন আকাশ আর মাটি থাকতো খুব কাছাকাছি। এতো কাছাকাছি যে, চলতে গেলে লম্বা মানুষের মাথা ঠেকত আকাশে।

একবার মানুষ কী এক অপরাধ করে বসলো। ওমনি মানুষের ওপর ধরমেশও গেলেন ক্ষেপে। তার নির্দেশে আকাশ উঠে গেল অনেক উপরে। তাতে মানুষের অসুবিধা হলো না। চলাফেরায় বরং সুবিধা হলো। কিন্তু চারপাশ তখনও অন্ধকার। সূর্য নেই। নেই চন্দ্র আর তারকা। ফলে মানুষেরও সুখ নেই। মানুষের তো চাই- আলো। অনেক আলো।

বনের মধ্যে ছিল আজব একটি গাছ। তখন আলোর জন্য মানুষেরা ওই গাছটির দিকেই তাকিয়ে থাকত। গাছে যখন ফুল ফুটত পৃথিবী তখন আলোকিত হতো। তখন দিন। ফুল শুকিয়ে গেলেই পৃথিবী আবার অন্ধকার। তখন রাত্রি।

আবার আজব গাছটির ফুলও নিয়মিত ফুটত না। তখন পৃথিবী থাকত অন্ধকারে। কিন্তু আলো ছাড়া তো জীবন চলে না! মানুষকে তাই পড়তে হতো নানা অসুবিধায়।

সবাই ভাবলো, আজব গাছটিই যত অন্ধকারের কারণ। ওটাকে কাটা হোক। তাহলেই আলো মিলবে অবিরত। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। সবাই লেগে গেল গাছ কাটতে।

চল্লিশ দিনে শেষ হলো কাটা। গাছ কেটে সবাই তো অবাক! গোড়া কাটা, তবুও গাছ মাটিতে পড়ছে না। এ নিয়ে সবাই মহা চিন্তিত! এমন সময় দৈববাণী এলো। আজব গাছের আগায় আছে চিলের বাসা। ওই চিলকে মারতে হবে। তবেই গাছ পড়বে মাটিতে।

চিল মারতে সবাই উঠেপড়ে লাগল। কয়েক দিন কেটে গেল সে চেষ্টায়। একদিন মানুষের কুঠারের আঘাতে মারা পড়ল চিলটি। ওমনি ‘ধপাস’ শব্দ। পৃথিবী কাঁপিয়ে আজব গাছটি পড়ল মাটিতে।

পৃথিবীতে তখন এক রাজা ছিলেন। গাছ পড়ার শব্দে তিনি দুঃচিন্তার মধ্যে পড়লেন। ভাবলেন-শক্রুরা বুঝি রাজ্য আক্রমণ করেছে। সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি ছুটে আসেন ওই বনে। আজব গাছটি তখন পড়ে আছে মাটিতে। গাছ কাটা দেখে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন, ‘এতো বড় গাছ কাটার সাহস তোমরা কোথায় পেলে? এর জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে তোমাদের।’

রাজা সৈন্যদের আদেশ করলেন, ‘ধরে নিয়ে আসো সব কয়টাকে। শূলে চড়াও ওদের। আর গাছটিকেও নিয়ে আসো।’

রাজার হুংকারে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু এগিয়ে আসলেন মানুষেরই এক সর্দার। সর্দার যেমন ছিলেন বুদ্ধিমান তেমনি সাহসি। তার কথা সবাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত।

রাজাকে সর্দার সব কথা খুলে বললেন। কিন্তু তবুও রাজার রাগ কমে না। সর্দারও তখন সাহস করে বললেন, ‘রাজা মশাই, আমরা গাছটি কেটেছি পৃথিবীতে আলো আনার জন্য। আমরা কোনো অপরাধ করিনি। তাই এই গাছটি আমাদেরই। গাছ আপনি নিতে পারবেন না।’

সর্দারের কথা ও সাহস দেখে রাজা হুংকার দিলেন। ওমনি দুদলে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মানুষের দল গাছটি আগলে রাখলেন রক্ত দিয়ে। সৈন্যদল সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো গাছটিকে ছিনিয়ে নিতে।

যুদ্ধ চলল কয়েক মাস। শেষে মানুষের মনোবল ও সাহসের কাছে পরাস্ত হলো রাজার সৈন্যরা। গাছের যুদ্ধে পরাজয় মেনে পালিয়ে বাঁচলেন অহংকারি রাজা।

যুদ্ধ তখন শেষ। আলোর আশায় সবাই গাছটাকে কেটে দুই ভাগ করলো। গাছের নিচের বড় অংশটিতে তারা খুঁজে পেল সূর্য-কে। উপরের ছোট অংশে পেল চন্দ্র-কে। তখনও তাদের আলো নেই। চন্দ্র-সূর্যের জীবন দান করলে তবেই মিলবে আলো। কিন্তু জীবনদান হবে কীভাবে? ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মানুষেরা গভীর চিন্তার মধ্যে পড়লো!

সেসময় আবারও দৈববাণী এলো। মনুষ্য রক্ত না হলে চন্দ্র-সূর্য জীবন পাবে না! সত্যবাদী চাষির একমাত্র সন্তানের রক্ত লাগবে তাতে। সবাই আবারও চিন্তিত। কোথায় মিলবে এমন রক্ত? চন্দ্র-সূর্য জীবন না পেলে সব চেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে। পৃথিবীতেও তাহলে আলো আসবে না।

অনেকদিন পর এক দেশে খোঁজ মিলল এক সত্যবাদী চাষীর। তার ছিল একটি মাত্র সন্তান। চাষী গেছে মাঠে কাজ করতে। তার স্ত্রীও গেছে নদীতে জল আনতে। ওই সময় ছেলেটি বাড়িতে একা।

মানুষের সর্দার সুযোগ বুঝে ছেলেটিকে চুরি করে নিয়ে আসলো। আলোর জন্য তাকে হত্যা করে রক্ত দিল গাছের দুই অংশে। ওমনি চন্দ্র-সূর্য জীবন পেল। তারা উঠে গেল আকাশে। সূর্যের আলোয় আলোকিত হলো পৃথিবী। শুরু হলো দিন। সূর্য বেশি রক্ত পান করেছিল। তাই সে লাল ও তেজি। সিগ্ধ আলো নিয়ে চন্দ্র উঠলো রাতে। সে কম রক্ত পেয়েছিল। তাই সে সাদা।

চন্দ্র-সূর্য জীবন পেয়ে এভাবেই আলোকিত করলো পৃথিবীকে।

অলঙ্করণ: সোহাগ পারভেজ

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর কিডজ বিভাগে, প্রকাশকাল: ১২ মার্চ ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button