কলাম

শিশুদের বই শিশুদের বইমেলা

অমর একুশে বইমেলা চলছে। মেলার মাঠে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সম্মিলন ঘটছে প্রতিদিন। আলোচনা, পর্যালোচনা ও অভিযোগের কথা উচ্চারিত হচ্ছে পাঠক ও লেখকদের মুখে। বই ঘিরেই বাঙালির এই সম্মিলন আমাদের অহংকারের বিষয়ও। কিন্তু বইমেলা কি শুধু ফেব্রুয়ারিতেই আবদ্ধ থাকবে? শিশুকিশোরদের বই পড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? বইমেলায় শিশুরা কি নিজের পছন্দমতো বই কিনতে পারে? চকচকে ছাপার অন্তরালে শিশুরা কী পড়ছে? কী ধরনের বই হওয়া প্রয়োজন তাদের জন্য? এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। তবে শিশুকিশোরদের জন্য ক্লাসরুমের পাশেই বইমেলা আয়োজনের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগের কথা জানাব আজ।

অমর একুশে বইমেলায় শিশু প্রহরের প্রথম দিন। নালন্দা বিদ্যালয়ের শিশুরা নিজেদের হাতে আঁকা ও লেখা বই প্রদর্শন করে শিশু চত্বরের পাশেই। কৈশোর তারুণ্যে বই ট্রাস্ট আয়োজিত এমন অনুষ্ঠানেই অংশ নেয় তারা। শিশুদের হাতে তৈরি প্রায় ৬০০ বই নিয়ে হাজির হয়েছিল নালন্দার শিক্ষার্থীরা। যে বইগুলো দেখে অবাক হয় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ, খ্যাতিমান  লেখক ও  প্রকাশকরা। মেলায় আসা অন্য শিশু ও অভিভাবকরাও বিস্মিত হয় শিশুদের ভাবনাগুলো দেখে। শিশুরাও জানিয়ে দেয় পাঠ্যপুস্তক নয় মননশীল বই-ই তাদের প্রিয় আর প্রয়োজন স্কুলে স্কুলে বইমেলা আয়োজনের। যে কাজটি ২০১৬ সাল থেকে করে আসছে ‘কৈশোর তারুণ্যে বই ট্রাস্ট’। কেন এমন উদ্যোগ? সেটি জানতে খানিকটা পেছনে ফিরতে হবে। এখনকার প্রজন্ম ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর হোয়াটস অ্যাপ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। বই তারা পড়তেই চায় না। বই বলতে পাঠ্যবই নয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই- গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ অন্যান্য। কিন্তু বই না পড়লে এ প্রজন্ম মনের আলোয় কীভাবে আলোকিত হবে! ভালো রেজাল্টের দাবি ছাড়া আমরা কি কখনো তাদের সামনে তুলে ধরেছি ভালো কিছু? ভালো বই, ভালো চলচ্চিত্র, সব ভালো। উত্তরটি অনেকাংশে ‘না’। তাহলে জাতি হিসেবে আমরা আসলে কী রেখে যাচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য?

কৈশোর তারুণ্যে বই ট্রাস্ট্রের উদ্যোক্তা সভাপতি সাংবাদিক তুষার আব্দুল্লাহ। সাংবাদিকতার বাইরে তাকেও আহত করে এই ভাবনাগুলো। সে সময় একই চিন্তার সমমনা কয়েকজন প্রকাশকও যুক্ত হন তার সঙ্গে। কী করা যায়?  কৈশোর তারুণ্যের বই থাকবে ক্লাসরুমের পাশে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা বই দেখবে, বইয়ের গন্ধ নেবে, বই পড়বে আবার পছন্দ হলে বই কিনে নিতেও পারবে। সবকিছু ঘটবে তাদের ইচ্ছে মতো। বই নিয়ে আলোচনাও চলবে তাদের সঙ্গে। এমন চিন্তা নিয়েই শুরু হয় বইমেলা। প্রথম বইমেলার আয়োজন চলে উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অংশ নেয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, প্রথমা, অনুপম, অ্যাডর্ন, সময়, জাগৃতি, অনন্যা, কাকলী, ইউপিএল, ইকরিমিকরি, বেঙ্গল পাবলিকেশনস প্রভৃতি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। মূলত এভাবেই শুরু। এরপর তাদের উদ্যোগে বইমেলা চলে ঢাকার বিএন স্কুল, ধানমন্ডি বয়েজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এবং ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ, পাকশী, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, ফেনী, চাঁদপুর প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন স্কুলে। এ পর্যন্ত মোট ৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বইমেলার আয়োজন করেছে কৈশোর তারুণ্যে বই ট্রাস্ট। যার মধ্যে ঢাকার বাইরে বইমেলা হয় ৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে ‘কৈশোর ও তারুণ্যে বই’ এই স্লোগানটিই রূপ নিয়েছে কৈশোর ও তারুণ্যে বই ট্রাস্টে। ট্রাস্টি হিসেবে আছেন সময়, কাকলী, অনুপম, অ্যাডর্ন, ইকরিমিকরি, তাম্রলিপি, অনন্যা, জাগৃতি প্রভৃতি প্রকাশনী সংস্থার মালিকরা।

একবার বই ট্রাস্টের উদ্যোগে নালন্দা বিদ্যালয়েই হয়েছিল একটি বইমেলা। সেখানে থাকার সুযোগ হওয়ায় এ বইমেলার কার্যকারিতা বিষয়ে কিছুটা ধারণা হয়েছিল। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’ গেয়ে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত পরিবেশনায় শুরু হয় বইমেলাটি। বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় শিশুদের বেশ ভিড়। শিশুরা দেখছে নানা বিষয়ের বইগুলো। কেউ কেউ বইয়ের লিস্ট তৈরি করছে ডায়েরিতে। ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা আয়েশ করে  জটলাবেঁধে দেখছে ইকরিমিকরির বইগুলো। বই নিয়ে শিশুদের এমন লুটোপুটি দেখতে সত্যি অন্যরকম লেগেছে। ক্লাসরুমের পাশে বইমেলা নিয়ে আশার কথা শোনান উদ্যোক্তারা ‘প্রথম মেলাতেই অবাক হলাম। শিশুরা বই দেখছে, বই নিয়ে কথা বলছে, নিজের পছন্দের বইও কিনছে। স্কুলের শিশুদের বই নিয়ে ঝাপাঝাপিটাই আমাদের উৎসাহ ও সাহস জোগায়। আমাদের ভুল ভাঙে। এ প্রজন্মের শিশুরা শুধু ফেইসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে বুঁদ হয়ে থাকে না। তাদের কাছে বই নিয়ে যেতে পারলে তারা অবশ্যই বই পড়ে।’

ক্লাসরুমের পাশেই বইমেলা এ ধরনের বইমেলা নিয়ে শিশুদের ভাবনাটি কেমন? আগ্রহ নিয়ে কথা বললাম নালন্দা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের সবার উত্তর প্রায় একই: ‘বইমেলায় যখন যাই তখন অভিভাবকদের পছন্দে বই কিনতে হয়। তা ছাড়া ফেব্রুয়ারির পরে ভালো কোনো বই আমরা কোথায় গিয়ে কিনব? নিজের পছন্দে, নিজের মতো করে বই ঘেঁটে আমরা বই কিনতেও পারছি বইমেলায়, এটা অনেক ভালো উদ্যোগ। সব স্কুলে এ ধরনের মেলার আয়োজন সারা বছরই হওয়া উচিত। আমরা যদি নিজের পছন্দে বই কিনতে পারি তাহলে সবাই তো নিজ পছন্দের বই-ই পড়ব।’ বইবন্ধু সম্মিলনে অনেকেই কথা বললেন। পাঠ্যপুস্তকে রসবোধ নেই। পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীম উদ্দীন আর হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ দেওয়া নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করলেন অনেকেই। সিলেবাসের বাইরে বই পড়তে অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করেন না বলে অভিযোগ ওঠে। প্রশ্ন ওঠে তাহলে আমরা আমাদের সন্তানদের কী শেখাচ্ছি?

 কৈশোর ও তারুণ্যে বই ট্রাস্টের উদ্যোগে ক্লাসরুমের পাশেই বইমেলা আয়োজনটি সবার জন্যই অনুকরণীয়। এ ধরনের উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দরকার শিশুকিশোরদের জন্য মানসম্পন্ন ভালো বই। যা তাদের চিন্তার জগৎকে আলোকিত করবে। এ ট্রাস্ট শিশুকিশোরদের সঙ্গে লেখক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পীদের মতবিনিময়, শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন বইয়ের ক্যাটালগ তৈরি এবং বই বিষয়ক আরও প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যা বইপড়ুয়া প্রজন্ম গড়তে অনন্য ভূমিকা রাখবে। বই নিয়ে এমন উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকুক। শিশুরা বই কিনুক তার নিজ পছন্দে। বই নিয়ে কথা, বইয়ের জন্য কথা আর বইয়ের কথাতেই আলোকিত হোক নতুন প্রজন্ম।

ছবি: তুষার আব্দুল্লাহ

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button