আদিবাসী

নিঃশব্দে ধীরে ধীরে…

খানিক এগিয়ে যেতেই এক আদিবাসী নারীর দেখা মিলল। যুবতী সদৃশ্য হলেও মাথায় ভরাট সিঁদুর। মুচকি হেসে নাম জানালো বাবলী। বাঁশের খোটা দিয়ে তুঁতগাছের ছোট ছোট ডালগুলো সর্বশক্তি দিয়ে ভাঙায় ব্যস্ত সে। বাবলীর কোমলমতি চেহারার সঙ্গে তার ডাল ভাঙার পাষাণী ভূমিকাটি ছিল বেশ বেমানান। এই গাছগুলো লাগানোই হয়েছে বাবলীসহ অন্যদের ভাঙার জন্যই। কেননা এই তুঁতপাতাগুলো গুটি পোকাকে খাইয়েই গ্রামের বেশ কয়েকজন যুবতী রেশম উৎপাদন করে তাদের সংসার চালাচ্ছেন। রেশম দিয়ে কি হয়, তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাদের।  জীবনের তাগিদে কারিতাস থেকে ঋণ নিয়ে রেশম উৎপাদন করে সেটা আবার কারিতাসের কাছেই বিক্রি করে এরা। দূর থেকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বাবলী দেখায় সবুজের মাঝে তাদের ভাঙাচোরা বিবর্ণ গ্রামটি। বিলুপ্তপ্রায় একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সর্বশেষ গ্রাম এটি। এদেশে বসবাসকারী আঠারোটির মধ্যে ষোলোটি পরিবারেরই বাস বিরলের এই গ্রামে। তুঁতগাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে বাবলী তার ভাষায় জানায়, ‘হামারা হাদিবাসী কড়া।’
গোটা গ্রামের অধিকাংশ মাটির ঘরই দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে কোনো রকম টিকে থাকার মতো দাঁড়িয়ে। সবুজের সমুদ্রের মাঝে এ যেন বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ। স্থানীয় এনজিওদের তৈরি করা পাকা ল্যাট্রিনটিই গ্রামটিতে আধুনিক সভ্যতার একমাত্র চিহ্ন। ভাদ্র মাসের তাল পাকানো রোদ চারদিকে। কিন্তু আদিবাসী কড়াদের মাটির ঘরগুলোতে অন্য রকম প্রাণ জুরানো শীতলতা। একটি বাড়িতে ঢুকতেই ৯০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধ মহিলার দেখা মিলল। ছোট চৌকির ওপর নাতি-নাতনিদের নিয়ে আপন মনে ভাত খাচ্ছেন সে। নাম সেড়তি কড়া। ভাতের সঙ্গে তেমন কোনো তরকারি চোখে পড়ল না। আশপাশ থেকে কুড়িয়ে আনা কচুশাক দিয়েই তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছেন সেড়তি। ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এই তিন মাস এ অঞ্চলের আদিবাসী কড়াদের কষ্টের সময়। এখানের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এ সময়টাতে কোনো কাজই পায় না এরা। আগে জমির ঘাস তোলার কাজ পেলেও বর্তমানে রাসায়নিক সার ছিটানোর কারণে জমিতে এখন আর তেমন আগাছা হয় না। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ছে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
কড়া সম্প্রদায়ের এই গ্রামটির শেষ প্রান্তের একটি ছোট্ট ছনের ঘরে থাকে জীবন সংগ্রামী সোনিয়া কড়া। মেয়ের বয়স যখন ৫ বছর তখন সোনিয়ার স্বামী মারা যায়। সেই থেকে নিজেকে টিকিয়ে রাখা আর মেয়ে ‘ফুলকড়া’কে বড় করার জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে সে। কিন্তু মেয়ে বড় হতেই সোনিয়ার দুঃখ আরও বেড়ে যায়। কড়াদের সনাতন ধর্ম মতে নিজের গোত্র ছাড়া অন্য গোত্র বা সম্প্রদায়ে বিয়ে নিষিদ্ধ। অথচ এদেশে টিকে থাকা কড়াদের একমাত্র  এই গ্রামটিতে ফুল কড়াকে বিয়ে দেয়ার মতো উপযুক্ত বয়সী কোনো ছেলে নেই। তাই নিজের ধর্মের বিধান ভেঙে বাধ্য হয়েই নিঃশব্দে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয় অন্য সম্প্রদায়ে। জাতি ভেদের কারণে টিকে থাকে না ফুলের সংসার। কয়েক মাসের মধ্যেই গ্রামের মহত গিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনে তাকে। মেয়েকে নিয়ে তাই দুঃখের সময় কাটে সোনিয়ার। সোনিয়া কি করবে তার মেয়েটিকে নিয়ে। কোথায় বিয়ে দেবে।মেয়েকে নিজের গোত্রে বিয়ে দিতে না পারলেও এই গ্রামেই এক সময় ধুমধামের সঙ্গে  বিয়ে হয়েছিল সোনিয়া কড়ার। স্মৃতি হাতরিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সময়গুলোর কথা। বিয়ের প্রথমে ঘটক বা ‘কারোয়া’-এর সঙ্গে সোনিয়াকে দেখতে আসে ছেলের বাবা। আপ্যায়নের পর মেয়ে পছন্দ হতেই পাকাপাকি হয় বিয়ের কথাবার্তা। সে আনন্দে চলে হাড়িয়া খাওয়া। আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের বিয়েতে এখনো মেয়েকে পণ হিসেবে দিতে হয় ২৫ টাকা। এ ছাড়াও মেয়ে পক্ষকে ৭টি শাড়ি, ৩ সের খাবার তেল, ৩ পুরিয়া সিঁদুর আর ‘ডারিয়া ঝোপা’ (কোমরে সাজানোর উপকরণ) দেয়ার বিধান চালু আছে। অন্যদের মতো কড়াদের বিয়েতেও উঠানে গাছের পাতা দিয়ে ‘মারোয়া’ সাজানো হয়। মারোয়ায় মাটি উঁচু করে ৪টি কলাগাছ, ৪টি তির, কাল সাট লিয়া (মাটির ঘটি বিশেষ) রেখে চারদিকে সুতা দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। এ ছাড়া বিয়ে বাড়ির উপরে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে টাঙাতে হয় ‘বাদর’। খড় দিয়ে মানুষ তৈরি করে তাতে তীর ধনুক লাগিয়ে তৈরি করা মূর্তি বিশেষকে আদিবাসী কড়ারা ‘বাদর’ বলে। বাদর টাঙিয়ে গোটা গ্রামে কড়াদের বিয়ের জানান দেয়া হয়।
আদিবাসী কড়াদের বিয়ের পর্ব অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন ও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিয়েতে বর পক্ষকে প্রথমেই কনের বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয় না। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে কোনো জায়গায় তাদের বসতে দেয়া হয়। সেখানেই খাওয়ানো হয় ভাত, ডাল ও সবজি প্রভৃতি। কড়ারা এটিকে বলে জাতি মিলনের ভাত বা ‘জাতি মিলন’। এরপর শুধু বরকে বাড়িতে এনে প্রদীপ, ধান ও ঘাস দিয়ে বরণ করে এরা। একে ‘চুমারে’ বলে। একই সঙ্গে বরকে খাওয়ানো হয় গুড়। কড়া ভাষায় এটি ‘গুড় খিলা’। বিয়ের নিয়ম অনুসারে গুড় খাওয়ানোর পর বর আবার পূর্বের স্থানে চলে যায়। খানিক পরে কনের বাবা বরকে নিয়ে আসে এবং পরিয়ে দেয় রূপার আংটি। আংটি পরানোর পর বরকে আবার চলে যেতে হয় আগের জায়গায়। এরপর কনের বাড়িতে আনা হয় নাপিত। নাপিত কন্যার হাতের কানি আঙ্গুল কেটে সামান্য রক্ত নিয়ে তার সঙ্গে আতপ চাল একত্র করে মেহুয়া পাতা দিয়ে কন্যার হাতেই বেঁধে দেয়। কড়ারা এটিকে ‘নিউওয়ে’ বলে। বরকেও একই প্রথা মেনে মেহুয়া পাতা বেঁধে আসতে হয়। নিউওয়ের পরই কনের গোসলের জন্য কড়ারা বলে, ‘কে নিয়া নাহা বে, এয়া দশ জনা’। এদের বিয়েতে কনেকে গোসল করাতে লাগে  ৫ জন মরত (পুরুষ) ও ৫ জন মেয়ে। আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ে মেয়ের বাবাকেই দিতে হয় বিয়ের শাড়ি। কনে সাজানোর পরই শুরু হয় বিয়ের মূল পর্ব। কড়ারা এটিকে বলে ‘সিমরেত হতে’ বা সিঁদুর পর্ব। কড়া সম্প্রদায়ের বিয়ের এই পর্বটি বেশ নাটকীয়। কনের ভাইকে খালি হাতে আর বরকে গামছা নিয়ে উঠতে হয় তাদের নিজ নিজ দুলাভাইয়ের (বোহনে) কাঁধে। এ অবস্থায় বর তার কাছে থাকা গামছাটি কনের ভাই বা শালাকে দিয়ে দেয়। আর শালা ঐ অবস্থায় বরকে পান খাইয়ে দেয়। পান খাওয়ানোর পরই শালা আবার তাকে দেয়া ঐ গামছাটি বরের কাঁধে পরিয়ে দেয়। গামছা পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই বর তার দুলাভাইয়ের কাঁধ থেকে নেমে আসে মাটিতে। কড়াদের ভাষায় এটি ‘সারা ধতি’। মাটিতে নেমেই বর চলে আসে সাজানো মারোয়ার দিকে। আদিবাসী কড়ারা বলে, ‘হামনি কে বিয়ে অন্য আদমিকে নাই দেখিন দিব’ (আমাদের বিয়ে আমরা অন্যকে দেখতে দেই না)। এই সম্প্রদায়ের বিয়েতে বর-কনের সিদুর পর্ব হয় চাষাবাদের প্রতীক জোয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে। দুই পক্ষের মহতের উপস্থিতিতে জোয়ালের দু’দিকে বর-কনে দাঁড়ালে চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। আর ঐ অবস্থায় বর-কনেকে সিঁদুর পরায়। সিঁদুর পর্বের পরই বর-কনেকে খাওয়ানো হয় ‘খির’। এরপর প্রথা অনুসারে বর-কনেকে পালন করতে হয় ‘খান্দা’ বা দশের খাবার পর্ব সোনিয়া জানায়, নয়া হাঁড়িতে বা যেটিতে সকলের খাবার রান্না হচ্ছে সেই হাঁড়িতে বর-কনে একত্রে হাত দিয়ে একটি কুলায় রাখা ঘাস, চাল ও ধান ঢেলে দেয়। আদিবাসী কড়ারা বিশ্বাস করে খান্দা পালনের পর থেকেই বর-কনে ধর্মীয়ভাবে  একে অপরের স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। সকলের খাওয়া শেষে শুরু হয় হাঁড়িয়া খাওয়া আর কড়া সম্প্রদায়ের ‘ঝুমের নাচ’। আনন্দের সঙ্গে কড়ারা বলে, ‘মারোয়ামে ঝুমের নাচ বে, হেরিয়া সবিল মিলকে পি বে’। আর অন্যদিকে চলতে থাকে দান বা ‘বান্দা পানি’ পর্ব। পরিচিত জনেরা ঘাস আর ধান ছিটিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদ করে আর কনের হাতে গুঁজে দেয় নানা উপহার। এভাবেই শেষ হয় সোনিয়ার মতো আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের বিয়ে।
সোনিয়ার মেয়ে ফুলকড়া ছাড়া এ গ্রামের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সী। এই গ্রামটিতে কড়াদের বিধান মতে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য তাই অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে আরও এক যুগ। কিন্তু তার জন্যও গ্রামটির সব কয়টি পরিবারকে একত্রে টিকে থাকতে হবে। অন্যথায় কড়া সম্প্রদায়ের মেয়েরা হারিয়ে যাবে অন্য আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর মাঝে। ফলে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে আরেকটি আদিবাসী জাতি। এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দারিদ্র্যতা আর ভূমি দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে সব কড়া পরিবার এখনো টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের, প্রকৃতির মতো শক্তি নিয়ে বেঁচে আছে যে সকল কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা তারা কি কখনো হারিয়ে যেতে পারে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৫ অক্টোবর ২০০৯ এ

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button