মুক্তিযুদ্ধ

শৈলকুপায় সাইফুল আলমের যুদ্ধদিন

বিজয়ের গৌরবগাথা

১৯৬৯ সাল। আমি তখন মাগুরা কলেজে। ছয় দফা সম্পর্কে আগেই জানতাম। কলেজে এসে ছাত্রনেতারা নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। চাকরিতে আমাদের সুযোগ ছিল খুবই কম। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৫% কোটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আর পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৮৫%। আর্মিতে কর্নেলের ওপরে আমাদের কেউ ছিল না। সামরিক বাহিনীতে ওরা ৯০% আর আমরা ছিলাম মাত্র ১০%। কাগজ তৈরি হতো পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ সেই কাগজ আমরা কিনতাম বেশি দামে। চালের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২৫ টাকা আর আমরা কিনতাম ৫০ টাকায়। তখন মিছিল হতো। মিছিলে ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন আলাদা থাকত না। সবাই এক হয়ে যেত।

মুক্তিযুদ্ধের আগের নানা ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুল আলম।

তিনি বলে চলেন ১৯৭০ সাল। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইনের ছাত্র। নির্বাচনের সময় চলে যাই গ্রামে। বন্ধু করুনাকান্তসহ ছাত্রলীগের ছেলেদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতাম। ওই নির্বাচন ছিল প্রতিবাদের নির্বাচন। জয়লাভের পরও পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা ক্ষমতা দেয় না। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। স্কুল-কলেজও তখন বন্ধ। দেশ পাকিস্তান, কিন্তু চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। ছাত্ররা স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন একজন বঙ্গবন্ধুই।

বাবা মকবুল হোসেন মিয়া ও মা খতেজান নেছার দ্বিতীয় সন্তান সাইফুল। বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নাগিরাট গ্রামে। এই বীর ডিস্ট্রিক্ট জর্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন দুদকের মহাপরিচালক ও  নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ ডিপার্টমেন্টের প্রধান।

২৫ মার্চের পর আপনারা কী করলেন জানতে চাওয়া হয় এই যোদ্ধার কাছে :

চুয়াডাঙ্গায় ছিল ইপিআরের একটি সেক্টর। সেখানে ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী। তার নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা। স্থানীয়দের নিয়ে কুষ্টিয়ায় আর্মির ঘাঁটি ঘেরাও করে রাখে তারা। এ খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। শৈলকুপায় পুলিশ আর ইপিআর থেকে পালিয়ে আসারা তখন স্থানীয়দের নিয়ে পজিশন নেয় গাড়াগঞ্জে। উদ্দেশ্য কোনোভাবেই যেন শৈলকুপায় আর্মিরা আসতে না পারে। আমরা তখন নানা কাজে তাদের সঙ্গী হই।

যুদ্ধদিনের কথা বলে চলেন সাইফুল আলম : ৩১ মার্চ সকালবেলা। খবর আসে ঝিনাইদহ-মাগুরার মাঝামাঝি হাট গোপালপুর বাজারের পাশে লৌহজাংগা নামক জায়গায় যুদ্ধ চলছে। শুনেই খালেকসহ ছুটে গেলাম। ওখানে দুজন বেলুচ সেনাকে মেরে পাবলিকরাই নদীর পাড়ের মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে রেখেছিল। যারাই আসছে তারাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওদের গোঁফ ধরে টানছে আর বলছে, ‘এদেশের খেয়ে খেয়ে তোমরা গোঁফ বানাইছো।’ পাকিস্তানিদের প্রতি মানুষ কতটা ক্ষিপ্ত ছিল সেদিনই বুঝেছি।

 শৈলকুপায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছেএ খবর জানা ছিল না সাইফুল আলমের। আওয়ামী লীগ করতেন গ্রামের আমজাদ হোসেন মৃধা। তার ছিল একটি দোনলা বন্দুক। তিনিই সাইফুলকে প্রথম বন্দুক চালানো শেখান। অনুশীলনের অংশ হিসেবে একদিন রাতে তারা ফাঁকা গুলি চালান। পরদিন টুকু নামের এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন গুলির উৎস সন্ধান করতে।

বাকি ইতিহাস শুনি সাইফুল আলমের জবানিতে : কোথা থেকে গুলি এসেছে আন্তাজ করে টুকু খোঁজ নিতেই আমরা স্বীকার করি। শুনে উনি বলেন ‘তুমি জানো না সোনা মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দল গঠন হয়েছে। চাইলে আসো। না হয় নিজেরাই আরেকটা দল গঠন করো।

তার ভাষায়, ওইদিনই প্রথম শুনি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি। একেক জায়গায় একেকটা দল  গঠন হয়। থানা কমান্ডার হন রহমত আলী মন্টু। বিশারত নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। উনি লাল চাদর পরতেন, লাল কাপড় গায়ে দিতেন। চুল, দাড়ি কিছুই কাটতেন না। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কাটবেন না। সবাই তাকে বিশারত ওস্তাদজি বলে ডাকেন। উনারও একটা দল ছিল। আর দল ছিল সোনা মোল্লা, রইচ সাহেব আর নজরুল ইসলামের।

সাইফুল আলম বলেন, মন্টুর দলে আমি প্রথম জয়েন করি। পরে গ্রামে নজরুল ক্যাম্প করলে তার দলে চলে যাই। রওশন, সিরাজুল ইসলাম মাখন, সালেক, আলী হায়দার প্রমুখ ছিল সহযোদ্ধা। গোপী বল্লভ কু-ুর বাড়িতে ছিল আমাদের ক্যাম্প। সেখানেই চালনা শিখি থ্রি নট থি, এলএমজি আর এসএলআর। গেরিলা ছিলাম। ৩০-৩২জনের দলের কমান্ড করতেন নজরুল। আমার অস্ত্র ছিল থ্রি নট থ্রি। আট নম্বর সেক্টরের অধীনে আমরা গেরিলা অপারেশন করি শৈলকুপা থানা, আলফাপুর, আবাইপুরসহ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায়।

একাত্তরের কয়েকটি অপারেশনের কথা তুলে ধরেন এই বীর যোদ্ধা ‘আগস্টের ৩০ তারিখ। মন্টু বাহিনী আসে আলফাপুরে অপারেশন করতে। ওটা ছিল মাগুরা আর ঝিনাইদহের শেষ জায়গা। নদী আর খাল এলাকা। তাই কোনো দিকে সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ১৯৭১ এ অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। ওই বৃষ্টিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশীর্বাদ। পাকিস্তানিরা পানি দেখলেই ভয় পেত। সে সুযোগটাই কাজে লাগাই আমরা। ওখানে দুটি অপারেশন হয়। একটি করেন বিশারত ওস্তাদজি, আরেকটি রহমত আলী মন্টু। দুটোতেই সাকসেস ছিল। আমরা ছিলাম ৫০-৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা।

২৫ বা ২৬ নভেম্বরের কথা। ফরহাদের নেতৃত্বে মাগুরা থেকে মুক্তিবাহিনীর একটা দল আসে। ওরা থাকে কামান্না গ্রামে এক কু-ুর বাড়ির পরিত্যক্ত একটি ঘরে। রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা এ খবর পায়। ওইদিন ভোর রাতে এসে চারপাশ থেকে গুলি করে তারা হত্যা করে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। আমরা সকালে গিয়ে দেখি একজন বেঁচে আছে। একটি গুলি তার বুকের সামনে দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে ভোগলা হয়ে বেরিয়ে গেছে। ওর নাম ছিল রাজ্জাক রাজা। একটা ব্ল্যাকবোর্ডে শুইয়ে ওকে পাশের গ্রামে নিয়ে যাই। তখনো তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু শরীর দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। তবুও সে চিৎকার দিয়ে বলছিল ‘রাইফেল একটা দাও, আমি ওদের শেষ করে দেব।’ কথাগুলো এখনো কানে বাজে। এই সব বীরের আত্মত্যাগের কারণেই কিন্তু আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৫ নভেম্বর ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button