আদিবাসী

ওরাওঁ আদিবাসী কাহিনি

ওরাওঁরা মনে করে, পৃথিবী রয়েছে একটি বিরাট কচ্ছপের পিঠের ওপর কচ্ছপ নড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়

সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। স্নিগ্ধ লাল আলোর কমল ছোঁয়ায় বদলে গেছে চারপাশ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। দিনাজপুরের বহবলদিঘি কবরস্থানের পাশেই একটি খোলা মাঠ। সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়স নিদেনপক্ষে নব্বই। কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে কী যেন ভাবছেন তিনি!

এগিয়ে যাই তার দিকে। এখানকার ওরাওঁ গোত্রের মহত বা প্রধান নিপেন টিগ্গা। তিনিও আমাদের সঙ্গী হন। কথায় কথায় জানালেন গোত্রের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ওই বৃদ্ধটি। নাম তার শংকর টিগ্গা। গোত্রপ্রধান নিপেন হলেও শংকরের পরামর্শ তাদের কাছে সবসময় অগ্রাধিকার পায়।

শংকর টিগ্গার সঙ্গে আলাপ জমাই ওরাওঁদের আদি যুগের নানা বিষয় নিয়ে। তার মুখমণ্ডলের চামড়া ভাঁজ খাওয়া। পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। মুচকি হেসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমাদের সমাজে কোনো মৃত্যু ছিল না’। তার কথায় চোখ স্থির হয়ে যায়। কিন্তু নিপেন বেশ স্বাভাবিক। আপন মনেই বলতে থাকেন মৃত্যু রহস্য নিয়ে ওরাওঁ বিশ্বাসের কথা।

কোন এক কালে ওরাওঁদের জীবনে কোনো মৃত্যু ছিল না। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কেউই মৃত্যুবরণ করত না। এভাবেই চলছিল। মৃত্যু না থাকাতে কিছুদিন পরই অসুবিধা দেখা দিল। কেমন অসুবিধা? থুড়থুড়ে বৃদ্ধদের নিয়ে হলো সমস্যা। তাদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর জন্য তখন আরেকজনের সহায়তা লাগত। ওরাওঁ বৃদ্ধদের অনেক কষ্টও হতো। তারা ভাবলো, এরকম কষ্ট আর অন্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না! বরং এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো।

সমাজের সবাই এতে একমত হলেন। ওরাওঁদের ভগবানের নাম ধার্মেশ। তাদের কাছে ধার্মেশ-সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। সবাই একত্রিত হয়ে তার কাছে গেলেন। আকুতি জানিয়ে ধার্মেশকে বললেন, ‘ভগবান, আমাদের মাঝে মৃত্যু দাও।’ ধার্মেশ বলেন, ‘তোমরা কি সবার জন্যই মৃত্যু চাও?’ সবাই বলে, ‘না, যারা বৃদ্ধ তাদের জন্য শুধু মৃত্যু দাও।’

বেঁচে থাকা ওরাওঁদের জন্য মৃতরা তাদের আশীর্বাদ রেখে যায়। তাই এরা ভক্তি করে মৃতদের। ভাত খেতে বসে এরা ভাতের কিছু অংশ পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করে।

ধার্মেশ তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। ওরাওঁ আদিবাসীদের বিশ্বাস, সে থেকেই পৃথিবীতে মৃত্যুর আবির্ভাব ঘটেছে। তাহলে অন্য বয়সীদের কেন মৃত্যু হয়? এমন প্রশ্নে নিপেনের উত্তর, ‘মানব সমাজে পাপের কারণে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। আর এই অপবিত্র আত্মা তখন দেবতা ধার্মেশের কাছে চলে যায় এবং মৃত্যু কামনা করে। তখনই মানুষের শরীরে রোগ-ব্যাধি দেখা দেয় এবং দেহের মৃত্যু ঘটে।’

অবাক হয়ে শুনতে থাকি নিপেনের কথাগুলো। ওরাওঁ আদিবাসীরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের শক্তিতে বিশ্বাস করে। তাদের ভাষায় এটি ‘পাকবলার’। এর অর্থ ‘অশরীরী আত্মা’। এদের বিশ্বাস পূর্বপুরুষদের আত্মার এই শক্তিই তাদের ভালো আদিবাসী এবং আদর্শ ঐক্যের পথে শক্তি জোগায়। বেঁচে থাকা ওরাওঁদের জন্য মৃতরা তাদের আশীর্বাদ রেখে যায়। তাই এরা ভক্তি করে মৃতদের। ভাত খেতে বসে এরা ভাতের কিছু অংশ পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করে। এভাবে কখনও কখনও নবজাতকের নাম রাখা হয় পূর্বপুরুষদের নামে, যাতে তার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।

ওরাওঁ জাতি বেশ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন। তারা চায় গোত্রের সবাই সমান থাকুক এবং কেউ যাতে আরেকজনকে পেছনে ফেলে বড় না হয়। পূর্বপুরুষদের সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব এখনো রয়েছে ওরাওঁদের মধ্যে। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি কাহিনি। নিপেন টিগ্গা জানালেন কাহিনিটি: ওরাওঁ সমাজ প্রবীণদের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হত। কিন্তু দেশ পরিচালনার জন্য তো কাউকে না কাউকে রাজা নির্বাচন করতে হবে। তাহলে তো সাম্যবাদরীতি থাকবে না। সে সময় তারা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিল। বাইরের একজনকে তারা রাজা বানালেন। তার নাম- ফনি মুকুট রায়। তিনি ছিলেন নাগবংশী সম্প্রদায়ের।

তবে তিনি রাজা ছিলেন নামমাত্র। প্রজারা উপহার হিসেবে যা দিতেন, তাই তিনি নিতেন। আদিবাসীদের কোনো কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না। দীর্ঘদিন স্বাধীনভাবে চলছিল ওরাওঁদের পাঞ্চেস ও পাঁড়হাগুলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজা বাধ্যতামূলক কর প্রথা চালু করেন। ফলে ওরাওঁ সমাজে হিন্দু ও বাইরের প্রভাব জোরদার হতে থাকে। রাজার সঙ্গে ওরাওঁদের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটতে থাকে। এ অবস্থা চলে প্রথম শতাব্দী থেকে ষোল শতাব্দী পর্যন্ত।

কথায় কথায় প্রসঙ্গ পাল্টাই। নিপেনের মুখে শুনি ভূমিকম্প নিয়ে তাদের প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা। ওরাওঁরা মনে করে, পৃথিবী রয়েছে একটি বিরাট কচ্ছপের পিঠের ওপর। কেঁচো পাতাল থেকে মাটি তুলে কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে ওই মাটি সমান করে দেয়। এ কারণে পৃথিবীর কোথাও সমতল, কোথাওবা পাহাড়-পর্বত। কচ্ছপের মুখের সামনে নাগিনী সাপ ফেনা তুলে বসে থাকে, যাতে কচ্ছপ নড়াচড়া করতে না পারে। কচ্ছপ নড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।

ওরাওঁরা এ উপমহাদেশের ভূমিজ সন্তান। এ আদিবাসীদের আদিস্থান দক্ষিণ ভারতের ডক্কানের কংকা নদীর তীরে।

নিপেন থামতেই শংকর টিগগা মুচকি হেসে বলেন, আমরা তো বানর গোত্রের। সবার দৃষ্টি তখন শংকরের মুখপানে এক হয়ে যায়। তিনি বলতে থাকেন- ওরাওঁদের কাছে গোত্র মহামূল্যবান। তাদের কাছে একই গোত্রের সবাই ভাইবোন। ফলে এক গোত্রের মাঝে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ এবং পাপের সমতুল্য। ওরাওঁদের রয়েছে বিশটি গোত্র। নানা প্রাণী ও বস্তুর নামেই নামকরণ হয়েছে গোত্রগুলো। যেমন: টিগ্গা অর্থ বানর, বান্ডো অর্থ বনবিড়াল, বাড়া অর্থ বটগাছ, বাঁড়োয়া অর্থ বন্যকুকুর, বাখলা অর্থ এক প্রকার ঘাস, বেক অর্থ লবণ, কেরকোটা অর্থ চড়ুই পাখি, কিন্ড অর্থ এক প্রকার মাছ, কিসপট্রা অর্থ শূকরের নাড়িভুঁড়ি, কুজুর অর্থ এক প্রকার লতা জাতীয় গাছ, লাকড়া অর্থ বাঘ, মিঞ্জি অর্থ এক প্রকার মাছ, পান্না অর্থ লোথা, তির্কী অর্থ এক জাতীয় মাছ, টপ্প অর্থ এক জাতীয় পাখি, খাখা অর্থ এক জাতীয় কাক, খালখো অর্থ এক জাতীয় মাছ, খেস অর্থ ধান।

ওরাওঁদের আদি সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল? এক সময় ওরাওঁ গ্রামের নানা বিবাদ ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে গ্রাম সংগঠন ছিল তাকে বলা হতো ‘পাঞ্চেস’। গ্রামের বয়স্ক সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো পাঞ্চেস। প্রতিটি গ্রামে একজন হেডম্যান বা মাহাতো এবং একজন পুরোহিত বা নাইগাস থাকত। পাঞ্চেসের ওপরের সংগঠনের নাম ছিল পাঁড়হা। পাঁড়হা সাধারণত সাত থেকে বারোটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। এসব গ্রামের হেডম্যানদের পক্ষ থেকে একজনকে নিযুক্ত করা হতো পাঁড়হা প্রধান হিসেবে। তাকে বলা হয় পাঁড়হা রাজা। কোনো অভিযোগকারী যদি পাঞ্চেসের বিচারে সন্তুষ্ট না হয়, তবে সে পাঁড়হা রাজার কাছে আপিল করতে পারতেন।

ওরাওঁরা এ উপমহাদেশের ভূমিজ সন্তান। এ আদিবাসীদের আদিস্থান দক্ষিণ ভারতের ডক্কানের কংকা নদীর তীরে। বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে তারা কংকা নদীর উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে এবং কনাটকায় কিছুকাল বসবাস করে। পরে পশ্চিম অববাহিকা হয়ে এরা অমরকন্টক ফরেস্ট রেঞ্জে এসে পৌঁছায়। ওরাওঁদের লোককাহিনিতেও এমন তথ্যের সত্যতা মেলে।

আবার কোন কোন গবেষক মনে করেন, খ্রিস্ট জন্মের ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে এ আদিবাসীরা সুতলেজ নদীর অববাহিকায় হরপ্পা অঞ্চলে বাস করত। খ্রিস্ট জন্মের ১ হাজার ৭৫০ বছর আগে হরপ্পা থেকে এরা শাহাবাদের রোহটাস অঞ্চলে চলে আসে, যা বর্তমানে হরিয়ানা এবং যমুনার সমতল ভূমি হিসেবে পরিচিত। সে হিসেবে বলা যায় ওরাওঁরা বর্তমানে আজমগড়ে এবং মির্জাপুরে বসতি স্থাপন করে। শারীরিক গঠন ও ভাষাগত বিচারে এরা দ্রাবিড়িয়ান গোষ্ঠীভুক্ত।

ওরাওঁ আদিবাসীদের নানা ইতিহাস আমাদের মন ভুলিয়ে দেয়। সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশে নামছে অন্ধকার। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার দল। আসর ভেঙ্গে আমরাও তখন ফিরতি পথ ধরি। মনে তখন ঘোরপাক খায় ওরাওঁ বিশ্বাসের নানা গদ্য।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৩০ আগস্ট ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button