আদিবাসী

লোহাডাঙ্গার তুরীদের কথা

শহর থেকে আসা বাসগুলো মুল্লুক দেওয়ানের কাছে এসেই থেমে যায়। বাসের ভেতর থেকে যাত্রীরা  কবরের দিকে ছুড়ে দেয় মানতের পয়সা। ঝন ঝন শব্দে মাজারের নীরবতা ভাঙে। পাকা রাস্তার এক পাশে মুল্লুক দেওয়ান আর অন্য পাশে তার বজরার মাঝির কবর। বিষ্ণপুরবাসীর বিশ্বাসে মুল্লুক দেওয়ান সত্যপীর।

দানের পয়সা আর সরকারি অর্থে মুল্লুক দেওয়ানে তৈরি হয়েছে একটি এতিমখানা।  এতিমখানার পাশেই বেশ পুরনো একটি পুকুর। পুকুরপাড়ে বাবরি দোলানো সারি সারি লিচু গাছ। চারদিকে  গা ছমছমে পরিবেশ। ভোর হতে না হতে বাতাসে ভেসে বেড়ায় কোমলমতি বাচ্চাদের কণ্ঠে তেলাওয়াতের সুর।
মাঝে মাঝে কোনো বিপদগ্রস্ত জনকে নীরবে চোখের পানি ফেলতে দেখা যায় মুল্লুক দেওয়ানে। মোমবাতি আর গোলাপজল ছিটায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও। বিষ্ণপুর গ্রামের লোকদের বিশ্বাস, ‘মুল্লুক দেওয়ান  কাউকে খালি হাতে ফেরায় না’। এ রকম নানা বিশ্বাসের গল্প নিয়ে যুগ যুগ ধরে মুল্লুক দেওয়ান বেঁচে আছে বিষ্ণপুরবাসীর মনে।
মুল্লুক দেওয়ানের অপর পাশেই লোহাডাঙ্গা। সেখানে বাস করে আরেক বিশ্বাসের মানুষেরা। যাদের মনে মুল্লুক দেওয়ান নেই। আছে বিশহরি, কারমা, জিতিয়া, মশানকালি, শ্মশানকালির মতো দেবতারা। গ্রামের সকলের কাছে এরা শিং সম্প্রদায়। কিন্ত আসলে এরা ‘তুরী’। নিয়ম মেনে এরা পুরুষদের নামের শেষে ‘সিং’ আর মেয়েদের নামের শেষে ‘বালা’ বা ‘দেবী’ টাইটেল ব্যবহার করে।
তুরীদের খোঁজ পেয়ে আমরাও রওনা হই বিষ্ণপুর গ্রামের  লোহাডাঙ্গার দিকে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়  এ গ্রামটি। পাকা রাস্তার দুদিকে মাটি আর ছনের তৈরি বেশ কয়েকটি বাড়ি। দুপুরের পর বাড়িগুলো যেন পুরুষশূন্য। বাড়ির ভেতরে বেশ আয়েশ করে আড্ডা দিচ্ছে মহিলারা।  নিজেদের মধ্যে তারা কথা বলছে বাংলা মেশানো  অচেনা এক ভাষায়। এটি আবার কোন ভাষা? উত্তরে মেলে মুচকি হাসি। পাশ থেকে বাসন্তি বালা উত্তর দেয়, ‘হামে তুরী জাতি, হামারা ভাষা তুরী’।
মহিলাদের পেছনে ফেলে আমরা গ্রামটির ভেতরে ঢুকে পড়ি। প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি বাড়ি এখানে। একটি বাড়ির কাছে এসেই আমরা থমকে দাঁড়াই। ভেতরে দরদ দিয়ে বিশহরির গান গাইছে কয়েকজন : ‘সাইয়া পাড়া লোক দুর্গা/মোর বাজে গাইয়ো গো/সাদ গুরু বান্দা মাইগে/জয়া বিশহরি’। আমরা ঢুকতেই গান থামিয়ে দেয় সবাই। একটি টুল টেনে বিনীত ভঙ্গিতে গোত্রের মহত লবানু সিং আমাদের বসতে দেয়। বাড়ির ভেতর মাটি উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট একটি জায়গা। পাশেই সন্ধ্যাতারা ফুলের একটি গাছ। লবানু জানায়, এটি তাদের ‘তুলসি থান’ বা ‘প্রার্থনার স্থান’। তুলসী গাছ না থাকলেও যে কোন একটি ফুলের গাছ সেখানে লাগাতে হয়। এটাই  আদিবাসী তুরীদের রীতি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলা কিংবা বউরা সন্ধ্যাপ্রদীপ দেয় এখানে। সন্ধ্যা হলেই শাশুড়ি বাড়ির বউদের খোঁজ করে। তুরী ভাষায় বলে, ‘বউয়ে, তুলসি থানোন সানবাতি দে, ধূম জ্বালায়ে দে’।লবানু জানায় তাদের পূর্বপুরুষদের কথা। আদিবাসী তুরীরা এখানে বাস করছে ব্রিটিশ আমলেরও পূর্ব থেকে। এসেছে ভারতের ভাগলপুর থেকে। এক সময় এখানে ছিল আদিবাসী তুরীদেরই ৪টি গ্রাম। কালের আবর্তে নানা কারণে এখন টিকে আছে শুধুমাত্র একটি পাড়া।
কৃষিকাজ তুরীদের প্রধান পেশা। কিন্ত স্বাধীনের পর হতে আদিবাসী তুরীদের বাপ-দাদার আমলের জমিগুলো বেদখল হতে থাকে। এখন অধিকাংশ জমিই স্থানীয় ভূমিদস্যুদের দখলে। ফলে এখন তুরীরা অন্যের জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি অনেকেই নাউয়াগিরি (নাপিতের কাজ) করছে।
আদিবাসী তুরীদের গোত্র পরিচালনায় থাকে ৪ সদস্যের পরিষদ। লবানু শিং একে একে বলতে থাকে পদের নামগুলো  ম-ল, মহত, বাসি, ছড়িদার। গোত্রের ম-ল মোহনা শিং মারা যাওয়ায় মহত লবানুই মহতের কাজ করছে। লবানু ছাড়া এখন পরিষদের কেউই আর বেঁচে নেই।
বাসি পদের ছোট্ট সিং আর ছড়িদার পদের পাতলা সিংয়ের মৃত্যুর পর এখানকার আদিবাসী তুরীরা তাদের পরিষদকে আর পুনর্গঠিত করেনি। গোত্রের রাসেন সিংয়ের মতে তুরীদের কাছে মন্ডল বা মহত ছাড়া এখন আর অন্য পদগুলোর কার্যকারিতা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়েছে আদিবাসী তুরী সম্প্রদায়ের সমাজ কাঠামো।
গোত্রের মন্ডল মোহনা সিংয়ের মৃত্যুর পর এখানকার তুরীরা পালন করে নানা আচার। সে কথাগুলোই বলতে থাকে লবানু। আদিবাসী তুরী সম্প্রদায়ের কারো মৃত্যু হলে তাকে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় পরিয়ে কবর দেয়া হয়। বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মাটির হাড়িতে গোবর গুলিয়ে নেয় তুরীরা। অতঃপর গোটা পাড়ার বাড়িগুলোতে ছিটিয়ে দেয়া হয়। গোবর শেষ হলেই হাঁড়িটিকে নিয়মমাফিক বাড়ির মধ্যেই ভেঙে ফেলতে হয়।
অন্য আদিবাসীদের মতো তুরীদের মৃত্যুর পর ৭ দিন পর্যন্ত এরা তরকারিতে হলুদ খেতে পারে না। ১৩ তিনের দিন এরা বাড়িতে নাপিত ডেকে এনে সবার চুল ও দাড়ি কামিয়ে দেয় এবং মহিলাদের কানি আঙ্গুলে নোখ হাল্কাভাবে ঘষে দেয়। এদের বিশ্বাস এতে এদের শুদ্ধি ঘটে। এরপর চলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব। তুরীদের ভাষায় এটি ‘ক্রিড়িয়া’।
লবানু সিংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সেখানে তুরী সম্প্রদায়ের অন্যদের ভিড় জমে যায়। পরিচয় দিতে গিয়ে কথা হয় খিড়ো বালা, বিজলী বালা আর দুলালী বালার সঙ্গে। তাদের থেকে জানা যায় তুরীদের সবচেয়ে বড় উৎসব কারমা পূজার কথা। মূলত এটি গাছের পূজা। আদিবাসী কড়াদের মতোই বন থেকে কেটে আনা বিরল প্রজাতির খিল কদম গাছের পূজা করে এরা।
ভাদ্র মাসে হয় করমা পূজাটি। পূজার পূর্বে মেয়েদেরকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে দাওয়াত করে নিয়ে আসে তার ভাই ও বাবা। তাই ভাদ্র মাসে চারদিকে যখন কাশ ফুল ফুটতে থাকে তখন মেয়েদের মনে বাবার বাড়ি যাওয়ার আনন্দের ঢেউ লাগে। মনের এই আকুতি নিয়ে করমা পূজার সময় দলবেঁধে তারা গায় নানা গান।
আমাদের শোনাতে খিড়ো বালা সুর করে গাইতে থাকে : ‘কাশি ফুলা ফুটেই গেলে/আসা মরা লাগি গেলে/ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক/কারমা পূজাকে রাতে।’
পাশ থেকে বিজলী বালা ধরেন আরেকটি গান : ‘করম ডাল, করম ডাল/চল শশুড়ায়ে/ ভাদ্র মাসে বিয়া হতে গো/আনে ঘুরায়ে।’
আদিবাসী তুরীদের কণ্ঠে আমরা গান শুনছিলাম একমনে। হঠাৎ পাশের বাড়িতে একটি লোকের আর্তচিৎকার। আমরা প্রায় দৌড়ে চলে গেলাম মহতের পাশের বাড়িটিতে। সেখানে সাপে কাটা এক রোগীর শরীর থেকে বিষ নামাচ্ছিল মহতেরই ভাই সবানু সিং। বিশেষ ভঙ্গিতে পরছেন তুরী ভাষায় মন্ত্র  : ‘এখানি পুসকেননি চারি খানি ঘাট/তাতে দিনু পদ্মার পাত/পদং কুমারী মা-বাপার নামÑ জয় বিশহরি/নাব বিষ নাব/বত্রিশে গড়ে গড়ে নাব/নিচ থাকি উপারে যদি ধাউবো/দোহার লাগেÑ শিব, দুর্গা, কার্তিক, গণেশের মাথা খাবো।’
করমা পূজা ছাড়াও তুরীরা বিশহরি পূজা করে ধুমধামের সঙ্গে। পূজার সময় সারা বছর সাপে কাটা রোগীদের কাছ থেকে হাঁস সংগ্রহ করা হয়। অতপর হাঁসগুলোকে বিশহরির সন্তুষ্টি লাভের জন্য বলি দেয়া হয়। হাঁস কেন? এরকম প্রশ্নে সবানু মুচকি হাসে। উত্তরে বলে, ‘হাসো পর বিশহরি বেটলেছে’। তুরীদের বিশ্বাস  বিশহরি বা মনসা দেবী হাঁস পছন্দ করে। তাই হাঁসের মাথায় বিশহরি বসে থাকে।
সবানু জানায়, বিশহরির পূজা হয় পহেলা ভাদ্রে। পূজার পরের দিন এ গ্রামে আদিবাসী তুরীরা ‘তুমরী খেলা’র আয়োজন করে। এ খেলায় মাঠের মধ্যে একটি সাপ ছেড়ে দেয়া হয়। সাপ ছাড়ার পর দুজন মন্ত্র পাঠ করতে থাকে। যার মন্ত্রে সাপ দ্রুত চলে আসে এবং বশ্যতা স্বীকার করে তাকেই জয়ী ধরা হয়।
লোহাডাঙ্গার আশপাশের গ্রামগুলোর আদিবাসীদের অধিকাংশই অভাবের কারণে সুবিধা লাভের আশায় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। তুরীদের কাছেও নানা সময়ে এসেছে ধর্মান্তরিত হওয়ার নানা প্রলোভন। নানা অভাব-অনটনের মধ্যেও সে সব প্রলোভনে পূর্বপুরুষদের জাত বিক্রি করতে রাজি নয় আদিবাসী তুরীরা। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছেন না কেন? এ রকম প্রশ্নে খিড়ো বালা ক্ষেপে যায়। চিৎকার করে তুরী ভাষায় বলতে থাকে- ‘হামিরি ধর্ম হামে চেলবে, তরনিক ধর্ম লিয়ে হামে নে চলবে, হামে খাটিয়ে খাবে, জাতি নে মারবে’।
অন্য রকম শ্রদ্ধা নিয়ে আমরা তাকিয়ে থাকি ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী খিড়ো বালার দিকে। মনে মনে বলতে থাকি স্বজাতীয় চেতনা নিয়ে যুগে যুগে বেঁচে থাকুক আদিবাসী তুরীরা।

লিখাটি প্রকাশিত  হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৩ মে ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button