আদিবাসী

কড়াপাড়ার গানের আসরে

সুনিয়া কড়ার গল্প শেষ। কিন্তু তবুও তার রক্ষা নেই। কড়াপাড়ার বাচ্চারা তাকে ছাড়ছে না। আরো গল্প শোনার আবেদন সবার। না-সূচক জবাবেও কাজ হয় না। বাচ্চাদের হৈ চৈ দেখে সুনিয়ার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। যেন এটাই সে চাচ্ছিল।
রাত তখন ৮টা। পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে। স্নিগ্ধ মায়াবী চাঁদের আলোতে চলে মুখ দেখাদেখি। চাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝোপঝাড়ে চলে জোনাকি পোকার উড়াউড়ি। রাতের আঁধারে দিনাজপুরের হালজায় এসে এমন দৃশ্য দেখব ভাবতেই পারিনি।
কড়াপাড়ায় চলছে আনন্দ আড্ডা। সুনিয়ার বাড়ির ঠিক উঠোনে। চাঁদের আলোতে বসা আবাল-বৃদ্ধ সব আদিবাসী। এখানকার আদিবাসী গ্রামগুলোতে এমন আড্ডা আর গানের আসর চলে প্রায় রাতেই। বিশেষ করে পূজার সময়টা যত ঘনায় নাচগান আর আনন্দ আসর ততই বাড়তে থাকে। আদিবাসীদের গল্প-গানের আসরের ভালো লাগা সত্যি অন্যরকম। মনে হচ্ছিল আমরা যেন চলে এসেছি কোনো সুখী মানুষের দেশে।
প্রতিদিন প্রতি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো না-বোধক সংবাদ আমাদের অস্থির করে তুলছে। না পাওয়ার বেদনা ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের আনন্দ-হাসিগুলোকে। কিন্তু আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঠিক উল্টো দৃশ্য। দিনমজুরের কাজ করে যা পায় তা দিয়েই তাদের দু’বেলা চলে কোনো রকমে। কিন্তু তাতেই তারা তুষ্ট। অবহেলা আর বৈষম্যের কষাঘাতেও হারিয়ে যায় না আদিবাসীদের আনন্দগুলো। রাতে যখন তারা আনন্দ আড্ডায় মেতে ওঠে তখন উবে যায় সকল দুঃখ-কষ্ট। এভাবে একেকটা রাত আদিবাসীদের একেকটি দিনের মানসিক শক্তি জোগায়। না পাওয়ার ভিড়েও সুখকে ঠিকই খুঁজে নেয় আদিবাসীরা। হয়ত এ কারণেই যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা সুখ খুঁজতে ছুটে গিয়েছেন আদিবাসী গ্রামগুলোতে।02গল্পের আসরে হঠাৎ মাদলের শব্দ। বেজেই যেন থেমে যায়। গল্প বিরতিতে সুনিয়া গান ধরে। পাশে বসা কয়েকজন নারী সুনিয়ার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। গান থামতেই হাসির রোল পড়ে যায়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নাচতে থাকে কয়েকজন। মাদলের তালে চলে তাদের কণ্ঠগুলোও। ধরাধরি করে নাচতে থাকে যুবতি বয়সী বাবলী কড়া, বিজলী কড়া আর নব্বই বছর বয়সী সেড়তি কড়া। কড়া ভাষার গানটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় গোত্রের প্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। জগেন জানাল, গানটির বিষয়ে নানা তথ্য।
কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিয়েতে চলে নানা আচার। এমনই একটি আচারের কথা জানাল জগেন। কড়া মেয়ে বা ছেলের বিয়ে পাকাপাকি হলে নিজ নিজ বাড়িতে পালন করতে হয় এই আচারটি। কড়া ভাষায় একে বলে ‘লাগান বেনদিয়া’। বিয়েতে হলুদ দেয়াকে কড়ারা বলে ‘তেল হারদি’। তেল হারদি হয় বিয়ের দুইদিন আগে। তেল হারদির একদিন আগে করতে হয় লাগান বেনদিয়া পর্বটি। ঐদিন ছেলে বা মেয়ের বাবা, মা, দাদা, দাদি ও নিকট আত্মীয়রা বিশেষ ধরনের গান গেয়ে আশীর্বাদ করে ছেলে বা মেয়েকে। সুনিয়া গাইছিল সেই গানটিই। কড়া ভাষায় গানটি : ‘বাবা, লাগানা বেনদিয়া/ নানে সুতে লাগানা বেনদিয়া, বাবা/ লাগানা চুমরিয়া বাপা/ বাপা লাগানা চুমরিয়া/ কাকা লাগানা চুমরিয়া…’।
কড়া ভাষায় বাবাকে বলে ‘দাদা’। চুমরিয়া অর্থ আশীর্বাদ। বাপা অর্থ বাবা।  জগেন জানাল লাগান বেনদিয়ার দিনে এই গানটি গেয়ে গেয়ে একে একে নিকট আত্মীয়রা মেয়ের চুলে আর ছেলের হাতে তাঘি (কাইতন) বেঁধে আশীর্বাদ করে। কড়াদের পূর্বপুরুষদের রীতিমতে এই তাঘি বিয়ের দিনের আগে খোলা যায় না। তাই এভাবে মেয়ের চুলে ও ছেলের হাতে তাঘি দেখলেই অন্য কড়ারা বুঝতে পারে তার বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে।
আমাদের কথার ফাঁকেই সেড়তি কড়া কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে শুরু করে আরেকটি গান। জগেন জানাল এই গানটি গোত্রের সুনিয়া কড়ার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুখে মুখেই সে গানটি রচনা করেছে। ১৯৭১-এ যুদ্ধের আগে শেখ মুজিব বন্ধু ভেবে বহুবার গিয়েছিল ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। বন্ধুত্বের কারণেই যুদ্ধের সময় ভারত সাহায্য করে বাংলাদেশকে।
গানটিতে আদিবাসী কড়ারা একে ভিক্ষা হিসেবে উল্লেখ করেছে। এছাড়া শাসন বলতে আদিবাসী কড়ারা বোঝায় শাস্তিকে। সেই সময় আদিবাসীদের নানা অনুষ্ঠানে কড়ারা এই গান গেয়ে সবাইকে দেশ ত্যাগে নিরুৎসাহিত করত। সেড়তির কণ্ঠে শোনা গানটি : ‘টেংরা মাছের তিনটি কাঁটা/ বোয়েল মাছের দাড়ি/ শেখ মুজিব ভিক্ষা করে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি/ বাঙাল ফিরো ফিরো গো/ পাকিস্তানের শাসন হয়েছে/ বাঙাল ফিরো ফিরো গো।’
দেশের জন্য শুধু গান বাঁধাই নয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে কড়াপাড়া থেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল দুইজন আদিবাসী। তাদের নাম সাতান কড়া ও থোপাল কড়া। কিন্তু স্বাধীনের পর থেকে বদলাতে থাকে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের চিত্র। সাতান আর থোপাল এখন দিনমজুর। তারা পায়নি মুক্তিযুদ্ধের কোনো কাগুজে সনদ। মেলেনি কোনো সম্মান। তাই সাতান এবং থোপালের মন থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো।
সেড়তির গানের শেষেই সবাই নীরব থাকে। এরপর কে গান ধরবে? এই নিয়ে চলে চাপাচাপি। সুনিয়ার দিকে সবার চোখ স্থির হয়। সুনিয়াও প্রস্তুতি নেয়।
জগেন জানাল কড়াদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের ঝাড়খ- থেকে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এদের জীবন আর সংস্কৃতির সঙ্গেও মিশে আছে মহাজন, পুলিশ আর দারোগাদের অত্যাচারের স্মৃতি। তাই কড়াদের অনেক গান ও লোককথায় প্রকাশ পায় আদিবাসীদের সেই সময়কার বঞ্চনাগুলো। এমনি একটি গান ধরে সুনিয়া। কড়া ভাষায় গানটি : ‘শুন এলু বোট সে/ ঘুরি এলু কোট সে/ চাল ধেনি জাল দি সাপার/ দারগা পুলিশ সবশে উপার/ চাল ধেনি জাল দি সাপার/ বাংলাদেশ মে নাখলো বিচার/ চাল ধেনি জাল দি সাপার।’
গানটির ভাবার্থ : জমিদারের কাছে বিচার চাইতে গিয়ে তা মিলল না, বিচার মিলল না কোর্টে গিয়েও, এদেশে সবার উপরে দারোগা, পুলিশ। তাই ছোট বাচ্চাদের বলা হচ্ছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, এদেশে থাকা যাবে না। এদেশে বিচার নেই।  জগেন জানাল কয়েক মাস পরেই কড়াদের কারমাপূজা।  ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা চাঁদে আয়োজন চলে পূজাটির। কড়ারা এই পূজায় বন থেকে কেটে আনে খিল কদম গাছের ডাল। সেটিকে মাটিতে পুঁতে কড়ারা পূজা করে রাতের বেলায়। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই আদিবাসীরা মেতে ওঠে নাচগান আর আনন্দ-উল্লাসে। পূজা শেষে কড়াদের নাচগান শুরু হয় পূর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে। বিশেষ এক গানের মধ্য দিয়ে। জগেনের অনুরোধে দরদী কন্ঠে সে গানটি গায় বাবলী কড়া। কড়া ভাষায় গানটি :
‘বন্দোনা বান্দ সাজানি
বান্দি দিয়া চারিও কোন
বন্দোনা বান্দ সাজানি
বান্দি দিয়া আখারে হামার
বান্দি দিয়া রেস্কা পেলেনি
বান্দি দিয়া আখারে হামার।’
জগেন জানাল কড়া ভাষায় বান্দোনা শব্দের অর্থ শুরু করা। আখারে অর্থ পূজার আসর। যারা মাদল বাজায় কড়ারা তাদের বলে রেস্কা। যারা নাচে তারা হচ্ছে পেলেনি। সে হিসেবে গানটির ভাবার্থ : শুরু কর চারপাশ সাজানো। বেঁধে দেও পূজার আসর। মাদল বাদক ও নাচের মেয়েরা বেঁধে দিয়েছে চারপাশ। বাবলীর গান শেষ হতেই সুনিয়ার কন্ঠে চলে কারমাপূজার অন্য একটি গান। সুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও কণ্ঠ মেলায়। কড়া ভাষায় গানটি :
‘সব গাতনি পিন্দ লাল লুগা
নতুন নতুন সুপ দিয়া
নতুন পারবেতি
আজো কারমাকের রাতি’।
গানটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় জগেন। কড়া ভাষায় ভাবীরা ননদকে ডাকে ‘গতনি’ বলে। লাল লুগা মানে লাল শাড়ি। সুপ অর্থ কুলা। দিয়া অর্থ প্রদীপ। আর পারবেতি অর্থ উপোসকারী।
সে হিসেবে গানটির ভাবার্থ : ননদরা লাল শাড়ি পরে নেও। নতুন কুলায় প্রদীপ নিয়ে তৈরি হয়ে নাও নতুন উপোসকারীরা। আজ পূজা করতে হবে। আজ কারমাপূজার রাত।
মাহাতো জানাল কারমাপূজার জন্য খিল কদম গাছের ডাল কাটতে হয় বিশেষ নিয়ম মেনে। তেলের পিঠা গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে এক কোপে কাটতে হয় খিল কদমের ডালটি। কড়াদের কারমাপূজার গানেই পাওয়া যায় সে রীতিটি। কারমা পূজার সময় ঘনিয়ে এলেই আদিবাসী কড়ারা এই গানটি গাইতে থাকে। কথায় কথায় সুনিয়া গায় সেই গানটি।

কড়া ভাষায় গানটি :
‘আন দিনে কারাম গোসায়
শির বিন্দা বন
আজো কারাম গোসায়
মাছ কুলি এলে
রুটি পিঠা খেলে
খিরা উখরি খেলে’।
গানটির ভাবার্থ : চল কারাম ডাল কাটতে যাই বিন্দাবনে। আজকেই পূজা হবে। বছরের মাঝামাঝি এখন। তেলের পিঠা ঝুলিয়ে। এক কোপে কেটে আনি।
কড়াপাড়ায় এভাবে একে একে চলে নাচগানের আসর। বিরামহীন গতিতে চলে মাদলের শব্দ। জগেনের কাছ থেকে বিদায় নেই আমরা। ভ্যানে চেপে ফিরতে থাকি আপন পথে। আকাশে হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ ঢেকে দেয় চাঁদটিকে। চারপাশে নামে অন্ধকার। মাদলের শব্দও তখন বেড়ে যায়। খানিক পরেই আবারও মায়াবী আলোর ছটা। মাদলের শব্দে কড়াদের চাপা কষ্টগুলোর মতোই সরে যায় আকাশের মেঘটিও। চারপাশে তখন শুধুই আলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ০৭ জুলাই ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button