আদিবাসী

নদী নিয়ে আদিবাসী মিথ

নদীবিধৌত আমাদের বাংলাদেশ। আদিকাল থেকে নদীকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে গিয়েছে এখানকার মানুষদের জীবন। নদী নিয়ে আছে অনেক কথা-উপকথা-পুরাণকথা। নদী নিয়ে আদিবাসীদের দুটি পুরাণ কথা…

বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক আদিবাসী সমাজেই নদী দূষণকে পাপের সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নদী নিয়ে আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে নানা কাহিনী। সে লোককাহিনীর মাধ্যমেই আদিবাসী শিশুরা ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের শিক্ষা পেয়ে আসছে। লুসাই পাহাড় থেকে উদ্ভূত কর্ণফুলী নদীরই একটি শাখা নদী তুইচং। লুসাই আদিবাসী সমাজে এ নদীর জন্ম নিয়ে প্রচলিত আছে চমৎকার একটি কাহিনী।

‘তুইচংগী ও নোয়েংগী। দুই বোন। দু’জনের ছিল খুব ভাব। একদিন দুই বোন গেল গহিন অরণ্যে। তাদের ইচ্ছে জুম চাষ করার। চৈত্র মাস ছিল। হঠাৎ ছোট বোনের প্রচণ্ড পিপাসা পায়। কিন্তু অরণ্যের কোথাও জলের দেখা নেই। জল না হলে তো তাকে বাঁচানো দায়। বড় বোন তুইচংগী জাদুমন্ত্র জানত। ছোট বোনকে বাঁচাতে সে মন্ত্রবলে নদী হয়ে গেল। সে নদীর জলে ছোট বোন নোয়েংগী পিপাসা মিটিয়ে জীবন বাঁচাল। কিন্তু বড় বোনকে না পেয়ে তার দুঃখের সীমা রইল না। সে নদীর পাড়ে বসে কান্না জুড়ে দিল। বোনের কান্নায় নদীর জল গেল বেড়ে। সে জলে ভাটির দেশ গেল ডুবে। ভাটি অঞ্চলের রাজা অসময়ে এমন প্লাবন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি পানসী সাজিয়ে বের হলেন নদীর উৎস সন্ধানে। দীর্ঘদিন চলার পর রাজা এসে পৌঁছলেন এক পাহাড়ের পাদদেশে। দেখলেন, নদীর উৎসমুখে বসে কাঁদছে এক অপরূপা সুন্দরী। সেখান থেকেই জল গড়িয়ে চলছে ভাটির দেশে। রাজা নোয়েংগীকে দেখে মুগ্ধ হলেন। তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন নিজ বাড়িতে। নোয়েংগী ছাড়াও রাজার ছিল আরও তিন রানী। তাকে দেখে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নোয়েংগী ছিল ধর্মপরায়ণ। অন্য রানীদের সে বেশ শ্রদ্ধা করত।

আনন্দেই দিন কাটতে থাকল তাদের। এক সময় নোয়েংগীর ঘরে জন্ম নিল এক ফুটফুটে ছেলে। কিন্তু অন্য রানীরা ছিল নিঃসন্তান। তারা ভাবল, এই ছেলেকে মেরে ফেলতে হবে। তা না হলে রাজার নজর থাকবে শুধুই নোয়েংগীর ওপর। তারা তাই করল। ছেলেটিকে চুরি করে ফেলে দিল নদীতে। নদী হলো তার মায়ের বোন। বোনের ছেলেকে নদী লালন-পালন করতে থাকল। এভাবে নোয়েংগীর ঘরে পরপর আরও তিনটি ছেলে হলো। সবাইকেই সতীনরা নদীতে ফেলে দিল। কিন্তু এত অত্যাচারের পরও নোয়েংগী কোনো কথাই রাজাকে জানাল না। ওদিকে নদী নোয়েংগীর চার সন্তানকেই লালন-পালন করে বড় করে তুলল। তারাও যোগ্য মানুষ হিসেবে বড় হলো। একদিন নদী তাদের রাজদরবারে পাঠিয়ে দিল। রাজা তাদের সুন্দর চেহারা, নাচ-গান ও মধুর কথাবার্তা শুনে অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কে? চার ছেলে একসঙ্গে উত্তর দিল, আমরা রাজপুত্র, আপনার ছেলে। শুনে তো রাজা অবাক। অতঃপর তারা রাজার কাছে সব খুলে বলল। সব শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি স্ত্রী নোয়েংগীকে ডেকে পাঠালেন। তার কাছে সব শুনলেন। শুনে রাজা প্রচণ্ড গর্জে উঠলেন। নির্দেশ দিলেন তিন রানীর গর্দান কেটে অরণ্যে পুঁতে ফেলার। অতঃপর রাজা তার চার পুত্রসহ আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।’

এ কারণেই তুইচং কেবল নদী নয়, লুসাই আদিবাসীদের কাছে পরম শ্রদ্ধার স্থান।

লুসাইদের মতো চাকমাদের কাছেও গোমতী নদী অতি পবিত্র। এ নদীর জন্ম নিয়ে চাকমা সমাজেও প্রচলিত রয়েছে একটি লোককাহিনী।
‘এক ছিল এক বৃদ্ধ। সে এত অলস ছিল যে, কলার খোসা পর্যন্ত ছাড়িয়ে খেতে পারত না। তার ছিল দুই কন্যা। বৃদ্ধ তাদের ওপর জুম চাষের ভার দিয়ে নিজে শুয়েবসে কাটাত। বৈশাখ মাস। একদিন দুই বোন গেল জুম চাষ করতে। কাজ করতে করতে বেলা শেষ। চারদিকে নামল অন্ধকার। চারপাশ থেকে বইছে বাতাস। কোনো আশ্রয় না পেয়ে দুই বোন কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল। বড়জন বলল, সাপ-ব্যাঙ, দেবতা-দানব, ভূত-প্রেত, রাজা বা প্রজা যেই আমাকে এখানে একটি ঘর তুলে দেবে, আমি তাকেই বিয়ে করব। এ কথা শুনে এক বিরাট সাপ বাঁশ বহন করে এনে ঘর তুলে দিল। বড় বোন তখন ওই সাপকেই বিয়ে করল। সকাল হতেই এ খবর পৌঁছে যায় তার পিতার কানে। সে ওই সাপটিকে ধরে এনে কেটে ফেলল। বাবার এমন আচরণে বড় মেয়ে কষ্ট পায়। মনের দুঃখে বড় মেয়ে কেঁদে দুই চোখ পানিতে ভাসিয়ে দিল। ওই পানি জমে তৈরি হলো একটি নদী। সে নদীতেই সে ডুবে মরল। এই নদীই গোমতী নদী নামে খ্যাত। কথিত আছে, সাপের বেশে টিপরা রাজপুত্রই বড় মেয়েকে ঘর তুলে দিয়েছিল।’

নদী, পাহাড়, বন ও প্রকৃতিই আদিবাসীদের জীবন। কিন্তু দখল হচ্ছে পাহাড়, উজাড় হচ্ছে বন, ভরাট হচ্ছে নদী, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। দেশ, সমাজ ও গোত্র ছাড়া হচ্ছে প্রকৃতজনরা। এখনও আদিবাসী সাহিত্যকে সমৃদ্ধময় করছে তাদের মিথগুলো।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালে, প্রকাশকাল: ১০ মার্চ ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button