মুক্তিযুদ্ধ

মিথ্যা দিয়ে ইতিহাসের সত্য বদলানো যায় না

 ‘‘মোজাম্মেল হক সমাজি ছিলেন আমার বন্ধু। বয়সে দু’বছরের বড়। মাস্টার্সের পর কিছুদিন তিনি কলেজে অধ্যাপনা করেন, চাঁপাইতে। পরে ঈশ্বরদীতে, এক কলেজে প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে যোগ দেন। তখন ১৯৬৮ সালের প্রথম দিক। ভ্রমণের জন্য সরকারিভাবে সমাজিসহ কয়েকজন প্রিন্সিপ্যালকে পাঠানো হল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানকার অবস্থা দেখে ফিরে এসে সমাজি ভাই বললেন, ‘ওখানে পাহাড় কেটে দশতলা বিল্ডিং তোলা হচ্ছে। অথচ এখানে, সমতলেই উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া নেই। সরকারের উচ্চ পদে সবই তাদের লোক। এভাবে তো দেশ এগোতে পারে না!’ ’’

‘‘মুসলিম লীগের প্রভাব তখন খুব বেশি। কিন্তু সমাজি ভাই প্রস্তাব করলেন আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের। বিষয়টি তত সহজ ছিল না। আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে আওয়ামী লীগের পক্ষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করলাম। কয়েকদিন পরেই চাটমোহর উপজেলা কমিটি গঠন করা হল। আওয়ামী লীগের প্রথম ওই কমিটিতে আমি ছিলাম সাংগঠনিক সম্পাদক আর সমাজি ভাই সভাপতি।’’
‘‘আমরা তখন পুরোপুরি মাঠে। শেখ মুজিব একবার ট্রেনে করে উত্তরবঙ্গ সফরে আসেন। খবর পেয়ে আমরা স্টেশনে ভিড় জমাই। জানালার পাশেই বসেছিলেন তিনি। সেদিনই তাঁকে প্রথম দেখি। কিন্তু তাঁর ব্যবহারে মনে হল যেন অনেক দিনের চেনা। সামনে যেতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সবাই ভালো তো।’ তার চোখে চোখ রেখে আমিও বললাম, ‘আপনি আমাদের নেতা। আপনি নির্দেশ দিবেন, আমরা কাজ করব। আমরা আছি আপনার সঙ্গে।’ মুচকি হেসে তিনি শুধু আমার মাথায় হাত বুলালেন। নেতার সেই স্পর্শ আজও ভুলিনি।’’
মুচকি হেসে তিনি শুধু আমার মাথায় হাত বুলালেন, নেতার সেই স্পর্শ আজও ভুলিনি
‘‘ঊনিশ’শ ঊনসত্তর। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে চাটমোহরে আমরা লাঠি মিছিল বের করি। সবার মুখে একই স্লোগান, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’। সত্তরের নির্বাচনে আমাদের ওখানে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সমাজি ভাই। তাঁর পক্ষে আমরা গ্রামে গ্রামে প্রচারণা চালাতাম। তখন কর্মীদের টাকা দিয়ে আনতে হত না। প্রায় সবাই ছিল নিবেদিতপ্রাণ। বরং অনেকেই বাড়ির ধান বিক্রি করে পার্টির খরচের জন্য টাকা দিত। নির্বাচনে সমাজি ভাইসহ আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে নানা টালবাহানা করতে থাকে। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।’’

পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ
পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ

‘‘একাত্তরের উত্তাল মার্চের ৭ তারিখ। রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’। ভাষণটি সারা দেশের মানুষের মন ছুঁয়ে দেয়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মনেও উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধু যেন সবার মনের কথাগুলোই বলে দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশমতো চাটমোহরেও সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আমি ছিলাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক।’’
‘‘২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামার খবর লোকমুখে পাই, একদিন পর। তখন পাখি মারার বন্দুক, লাঠি ও কোচ নিয়ে আমরা চাটমোহর থানা আক্রমণ করি। অস্ত্রাগার ভেঙে ১২টি থ্রি-নট থ্রি রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিই। কিন্তু পাকিস্তানি সাঁজোয়া বাহিনীর প্রস্তুতি দেখে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি না।’’
‘‘এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। পাকিস্তানি সেনারা চাটমোহরে আসে শান্তি কমিটি গঠন করতে। শান্তি কমিটির নেতা হন মুসলিম লীগের মাঈনুদ্দিন মোল্লা। ফেরার পথে আর্মিরা কয়েকটি হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা তখন আত্মগোপন করে চলে আসি বড়াল নদীর ওপারে।’’

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ময়েজের মুখে যুদ্ধদিনের বর্ণনার ভিডিও

যুদ্ধদিনের নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ময়েজের মুখে। বাবা বয়েজ উদ্দিন ও মা আবিজান নেসার একমাত্র সন্তান ময়েজ। বাবা ছিলেন সে আমলের এনট্রেন্স পাশ। ময়েজের বয়স যখন তিন, তখন টাইফয়েডে তাঁর বাবা মারা যান। ফলে বড় চাচা আরজ আলী মোল্লা ও ফুপুর আদরেই ময়েজ বড় হতে থাকেন।
মুক্তিযোদ্ধা ময়েজের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার বোথর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বোথর প্রাইমারি স্কুলে। পরে এসএসসি পাশ করেন চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথবাবু সম্ভুনাথ হাই স্কুল থেকে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায়, সবার চাপে একুশ বছর বয়সেই ময়েজ বিয়ে করেন হরিপুর গ্রামের মেয়ে রোকেয়াকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের ঘরে ছিল ছয় ছেলেমেয়ে। এসব পিছুটান ময়েজকে আটকাতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘‘এপ্রিলের শেষের দিকের কথা। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে এক সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে আমরা ঘর ছাড়ি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আবদুর রাজ্জাক ও মতিউর রহমান। প্রথমে নাটোর জমাইল হাট হয়ে গোপালপুর সুগার মিলের রেললাইনের পাশ দিয়ে পদ্মার পার হয়ে চলে যাই কুষ্টিয়ায়। সেখান থেকে প্রথমে ভারতের জলঙ্গীতে, পরে বহরামপুর, মালদহ হয়ে কলকাতায় আসি। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে আমি কেচুয়াডাঙ্গা ইয়ুথ ক্যাম্পে এসে নাম লেখাই।’’
‘‘কয়েকদিন পর ভারতীয় আর্মির সঙ্গে ক্যাম্পে আসেন অধ্যাপক আবু সাঈদ (সাবেক তথ্যমন্ত্রী)। ওইদিনই আমাদের চারশ জনকে বাছাই করে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ২১ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখানো হয় বোম ব্রাস্ট, টুইন্স মর্টার, এলএমজি ফায়ার করা প্রভৃতি। আমি ছিলাম ক্যাম্পের আলফা উইংয়ের ২ নং কমান্ডার। এফএফ নং- ৩৩৮৭। পরে আমাদের অস্ত্র দেওয়া হয় ৭ নং সেক্টরের তরঙ্গপুর থেকে। কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান স্যার ছিলেন সেখানকার দায়িত্বে।’’
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন?
মুক্তিযোদ্ধা ময়েজের উত্তর, ‘‘আমাদের পাঠানো হয় নিজ নিজ এলাকায়। ফলে সহজেই আক্রমণ করে সরে পড়তে পারতাম। ৩১ জনের প্লাটুনে আমি ছিলাম কমান্ডার। আমরা অপারেশন করি পাবনার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নে গফুরাবাদ স্টেশন, চাটমোহর স্টেশন প্রভৃতি এলাকায়।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘ওরা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের খবরাখবর ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। হিন্দুবাড়িতে লুটতরাজ করত। ওরা সাহায্য না করলে পাকিস্তানিরা এত হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারত না।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ বাম পায়ে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁর পায়ে পচন ধরলে হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় কাটছে ঊনআশি বছর বয়স্ক এই যোদ্ধার জীবন। সেদিনকার রক্তাক্ত স্মৃতির আদ্যোপান্ত শুনি তাঁর জবানিতে।

সেদিনকার রক্তাক্ত স্মৃতির আদ্যোপান্ত শুনি তাঁর জবানিতে
‘‘১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। তখন আমরা গোপালপুর ও তেবাড়িয়ার মুক্ত এলাকায় থাকি। চাটমোহরে রামনগর-কুমারপাড়া গ্রামে ছিল রাজাকার কমান্ডার রমজানের বাড়ি। তাঁর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। আমরা তাঁকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করি। কমান্ডার হিসেবে আমি নিজেই ৫ সহযোদ্ধাসহ সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তাকে গুলি করে ফিরতি পথ ধরি। এ খবর ছড়িয়ে পরে চারপাশে। রাত তখন ১০টার মতো। বোথর ঘাটে বড়াল নদীর খেয়াপারের জন্য আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। মাঝি ছিল ওই পারে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল গোপালপুরের দিকে চলে যাওয়ার। চাটমোহর থানাতেই ছিল পাকিস্তানি আর্মির একটি ক্যাম্প। খবর পেয়ে তারা খেয়াঘাটের চারপাশে অবস্থান নেয়। হঠাৎ আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চলে। জীবন বাঁচাতে সবাই তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু তার আগেই একটি গুলি আমার বাম পায়ের হাঁটু ও উরু ভেদ করে বেরিয়ে যায়।’’
‘‘নদীর জলে পা নাড়াতে পারছিলাম না। পায়ে কোনো বোধ নেই। কী হল পায়ে? হাত দিয়ে পা স্পর্শ করতেই হাড়ের গুড়োগুলো বেরিয়ে আসে। বুঝে যাই গুলি খেয়েছি। রক্ত বেরিয়ে শরীরটা দুর্বল হতে থাকে। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ দুটো। ছেলেমেয়েদের কথা খুব মনে হচ্ছিল। তবুও জীবন বাঁচাতে সাঁতরিয়ে পার হই বড়াল নদী।’’
‘‘ওপারে অপেক্ষায় ছিলেন সহযোদ্ধারা। চিকিৎসার জন্য আমাকে প্রথমে নেওয়া হয় নাটোর বড়ইগ্রাম খ্রিস্টান মিশনে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠানো হয় পাবনা হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেশ স্বাধীনের খবরটি পাই। কী যে ভালো লেগেছে সেদিন! মনে হয়েছে আমার পা আছে। কিছুই হারাইনি আমি। কিন্তু তখনই পায়ে ঘা হয়ে সেপটিক হয়ে যায়। ফলে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহী মেডিকেলে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তখন। পা ড্রেসিংয়ের সময় যন্ত্রণায় মনে হত এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। ডাক্তার বললেন, পা-টি রাখা যাবে না। তাকে বললাম, ‘আমি শুধু বাঁচতে চাই। এই যন্ত্রণা আর কষ্ট থেকে মুক্তি চাই।’ পরে পা-টা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়।’’
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশটি কি পেয়েছেন?
এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ মুচকি হেসে বলেন, ‘‘সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে এটাই পরম পাওয়া। স্বাধিকার পেয়েছি এটা ভেবেই শান্তি পাই। কিন্তু বৈষম্য ও দুর্নীতিপূর্ণ দেশে হবে এ কথা আমরা চিন্তাও করিনি।’’
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ বলেন, ‘স্বাধীনতা লাভের পরই ছিল এই তালিকা করার উপযুক্ত সময়। তখন সব রেকর্ড ছিল ভারতীয় ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে। এরশাদের আমলে প্রথম নির্দেশনা ছিল, ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকবে।’ কিন্তু কিছুদিন পরেই এ নির্দেশনা বদলে গেল। বলা হল, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যারা সহযোগিতা করেছে বা স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং নিয়েছে তারাও এ তালিকায় আসবে।’ এরপরই ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়তে থাকল। যারা সহযোগী ছিল তাদের জন্য আলাদাভাবে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ ক্যাটাগরি করে তালিকা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হল না। ফলে সহযোগীদের ভিড়ে আজ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
তেতাল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
ময়েজের উত্তর, ‘‘কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থলোভী কর্মকর্তা আর কিছু অসৎ কমান্ডারাই এর জন্য দায়ী। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এতে সরকার যেমন বিতর্কিত হচ্ছে তেমনি সরকারের বিপুল অর্থও জলে ফেলা হচ্ছে।’’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়, ‘‘স্বাধীনের পর পরই তালিকা করে এদের বিচার করা দরকার ছিল। বঙ্গবন্ধু উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তেতাল্লিশ বছর পার হলেও রাজাকারদের বিচার হচ্ছে এটা ভেবেই আজ শান্তি পাই। কিন্তু রায় নিয়ে কালক্ষেপণ কিংবা কোনো রাজনীতি হোক সেটাও আশা করি না।’’
কথা ওঠে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর মন ছিল বিশাল। দেশের তখনকার অবস্থার প্রেক্ষিতেই তিনি ছোট ছোট অপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তো চিহ্নিত রাজাকারদের ক্ষমা করেননি। বরং বঙ্গবন্ধুর সময়কার আইন থাকাতেই আজ রাজাকাদের বিচার করা সম্ভব হচ্ছে।’’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ খানিকটা নিরব থাকেন। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যার নজির ইতিহাসে আছে। কিন্তু তার পরিবারের নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার নজির পৃথিবীতে নেই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা স্বাধীন দেশে বাঁচাতে পারিনি, এর চেয়ে দুঃখের আর অপমানের আর কী আছে!’’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বদলে যায় দেশের প্রেক্ষাপট। দালাল আইন বাতিল হয়। ফলে বিচারের পরিবর্তে রাজনীতিতে পাকাপোক্ত আসন গাড়ে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকাররা। সে সময়কার একটি ঘটনা বললেন মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ–
‘‘জিয়াউর রহমানের সময় প্রধানমন্ত্রী ছিল শাহ আজিজ। একবার তাকে নিয়ে জিয়াউর রহমান আসেন কলেজ গেইটে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে। ওখানে মধু নামের হুইল চেয়ারধারী এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শাহ আজিজকে দেখে মধু ঠিক থাকতে পারে না। তিনি জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আপনি মুক্তিযোদ্ধা, নিঃসন্দেহে আপনি শ্রদ্ধেয়। কিন্তু এই শালা রাজাকারকে কেন আনলেন?’ বলেই তিনি শাহ আজিজের ওপর চড়াও হন। তাঁর সঙ্গে আমরাও এর প্রতিবাদ করি।’’
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপির সময়ে চিহ্নিত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ ছিল মন্ত্রী। রক্তে পাওয়া আমার এই স্বাধীন দেশে রাজাকাররা যখন তাদের গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে চলত তখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঠিক থাকতে পারতাম না। কষ্টে আর দুঃখে ঘুম আসত না।’’
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘‘আগে দুই চার গ্রামেও একজন সরকারি চাকুরে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন প্রতি গ্রামেই ১০ থেকে ১৫ জন পাবেন সরকারি কর্মকর্তা। গার্মেন্টস শিল্পের তো ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। গণ্ডগ্রামের লোকেরাও চকচকে প্যান্ট শার্ট পরে চলাফেরা করছে। আমাদের দেশের তরুণরা দেশে-বিদেশে নানা কাজে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে, এটা দেখলে ভালো লাগে, মন ভরে যায়।’’
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে এটাই পরম পাওয়া, স্বাধিকার পেয়েছি এটা ভেবেই শান্তি পাই
খারাপ লাগার কথা উঠতেই বললেন, ‘‘মন্ত্রী-এমপিরাও স্বার্থচিন্তা থেকে বেরুতে পারেননি। এখন পয়সা ছাড়া কিছু হওয়াই কঠিন। বিদেশি বন্ধুদের এনে ক্রেস্ট ও মেডেলের স্বর্ণ চুরি করে দেশের অসম্মান করাতেও কেউ দ্বিধাবোধ করে না। দেশটা যেন লোভীদের দেশ হয়ে গেছে! এগুলো দেখলে খারাপ লাগে।’’
কী করলে দেশটা আরও এগোত?
‘‘রাজনীতিবিদরা যদি সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কাজ করত, তবে দেশটা অন্যরকম হত। একইভাবে সাধারণ মানুষকেও লোভ পরিহার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। প্রত্যেকেই যদি নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে পারে, তবে দেশটা একদিন সত্যি বদলে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন তো ইতিহাসে কে প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন, কে ব্যর্থ ছিলেন– তাই নিয়েই অপপ্রচার চলছে। এটা দুঃখজনক। রাজনৈতিক নেতাদের শালীনতার সঙ্গে কথা বলা উচিত। যেটা বিশ্বাসযোগ্য ও সত্য তাই বলতে হবে। মনে রাখতে হবে, মিথ্যা দিয়ে ইতিহাসের সত্য বদলানো যায় না।’’
ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার মুক্তিযোদ্ধা ময়েজের কাছে সর্বনাশের নামান্তর মাত্র। তাঁর ভাষায়, ‘‘ধর্ম এক জিনিস, রাজনীতি আরেক জিনিস। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সাধারণ মানুষ সহজভাবে নেয় না। যারা ধর্মের চাদরে নিজের অপকর্ম ঢাকতে চায়, ভোট বাগাতে চায়– তাদের চরিত্র এক সময় ঠিকই উন্মোচিত হয়।’’
নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেম প্রবল, এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ময়েজের। পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘তোমরাই এ সময়ের মুক্তিযোদ্ধা। তোমরা সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবেই দেখ। ন্যায়নীতির মাধ্যমে নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ কর। আমাদের দোয়া থাকবে তোমাদের জন্য। তোমরাই একদিন দেশটাকে সত্যের পথে বদলে দিবে।’’

লেখাটি প্রকাশিত হবে বিডিনিউজ২৪.কমে, জুন ১৭, ২০১৪

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button