আদিবাসী

ভাগ্য বদল

একদা কারমা ধারমা নামে দুই ভাই ছিল। কারমা শুধু কর্মই করত। ধর্মকর্ম তেমন একটা মানত না। আর ধারমা তার উল্টো, শুধু ধর্মকর্মের মধ্যে ডুবে থাকত।

কারমা প্রতিদিন মাঠে যেত, মাথার ঘাম পায়ে ফেললেও তার ঘরে অন্ন জুটত না। অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। অন্যদিকে শুধু ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ধারমার ঘরে কখনো অভাব ঢুকত না।

একবার ঘটল এক ঘটনা। ধারমা ও তার স্ত্রী খিল কদম গাছের ডাল কেটে আনে। ধর্মের আচার হিসেবে তারা সেটিকে মাটিতে গেড়ে তার চারপাশে নাচগান করতে থাকে। কারমার স্ত্রীও এ আচারে যোগ দেয়। নাচগানে মত্ত হয়ে তারা ভুলে যায় কারমার জন্য মাঠে খাবার পাঠানোর কথা।

কারমা হাল দিচ্ছিল জমিতে। সে অপেক্ষা করে খাবারের জন্য। খাবার না পেয়ে পরদিন ভোরে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু বাড়ি থেকে তখনও কেউ খাবার নিয়ে আসে না। অতঃপর ক্লান্ত দেহে কারমা ফিরে যায় নিজ বাড়িতে।

বাড়িতে পা রাখতেই সে দেখল একটি গাছের ডালকে ঘিরে সবাই নাচগানে মত্ত। এটা সে মেনে নিতে পারে না, ক্ষিপ্ত হয়। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বরং ডালটিকে উপড়ে ফেলে। এতেই সে ক্ষান্ত হয় না। ডালটি তুলে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে নদীতে। নদীর জলে ভাসতে ভাসতে ডালটি দূরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এ ঘটনার পর থেকে কারমার ঘরে অভাব-অনটন আরও বেড়ে যায়। সে তখন পরামর্শের জন্য যায় ভাই ধারমার কাছে। কারমা বলে, ভাই, কেন আমার এ দশা?

উত্তরে ধারমা বলে, তুমি ডালটি কেন উপড়ে ফেললে? এ কারণে তোমার এ দশা। তুমি ডালটিকে খুঁজে আন। তাহলে তোমার ভাগ্য ফিরবে, অভাব ঘুচবে। পাবে সুখের সন্ধান।

ভাইয়ের কথা কারমার মনে ধরে। বাড়ি ফিরে গামছায় মুড়ি বেঁধে সে বেরিয়ে পড়ে ডালটির খোঁজে। নদীর পথ ধরে হাঁটতে থাকে সে। কয়েকদিন পর তার প্রচণ্ড খিদে পায়। গামছায় বেঁধে আনা মুড়ি খেতে গিয়ে সে দেখে মুড়িতে পোকা ধরেছে। ফলে তা খেতে পারে না।

এরপর পানি খাওয়ার জন্য নদীতে নামে সে। হাত দিয়ে পানি তুলতেই দেখে সেখানে অসংখ্য পোকা নড়ছে। ফলে নদীর জলও তার ভাগ্যে জোটে না।

কারমা হতাশ হলো না। পথ চলতে থাকল। অনেকটা পথ পেরিয়ে সে পেল একটি আম গাছ। অসংখ্য পাকা আম ঝুলছিল গাছটিতে।

এমনিতেই ক্ষুধার্ত, তার ওপর পাকা আম দেখে লোভ হলো তার। একটি আম ছিড়ে খোসা ছাড়িয়ে যেই মুখে দেবে ঠিক তখন দেখে আমের ভেতর কালো পোকা কিলবিল করছে। তার আর আম খাওয়া হয় না। এভাবে চেষ্টা করেও কারমা কিছুই খেতে পারে না।

দূরে এক গ্রামের ভেতর সে দেখল এক রাখালকে। গাভির দুধ দোয়াচ্ছিল সে। কারমা মিনতি করে তাকে বলে, ভাই, সাতদিন কিছু খাইনি। আমাকে একটু দুধ দেবে।

রাখালের দয়া হলো। সে তাকে এক মগ দুধ দিল। কারমা খুশি হয়ে খানিকটা দুধ মুখে নিয়েই ফেলে দিল। অসংখ্য বালি মিশে ছিল দুধের সঙ্গে। ফলে দুধও তার খাওয়া হলো না।

গাছের ডালের কথা শুনে রাখাল জানাল কিছুক্ষণ আগে সে ডালটিকে ভেসে যেতে দেখেছে। রাখালের কথায় কারমা আবার ছুটতে থাকে। অনেক দূরে গিয়ে সে পেল এক কাঠুরিয়াকে। তাকে বলল, ভাই, তুমি এই নদী দিয়ে গাছের ডাল ভেসে যেতে দেখেছ? উত্তরে সে বলে, হ্যাঁ দেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে। কাঠুরিয়ার দেখানো পথে কারমা এগোতে থাকে।

এভাবে সে চলে আসে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে। সেখানে কারমা এক পথিকের দেখা পায়। ডালটির কথা বলতে সে বলে, এই সামনেই তো দেখলাম। দৌড়ে সামনে এগোতে কারমা দেখা পায় ভাগ্যদেবতারূপী গাছের ডালটির। তার মনে তখন আনন্দের জোয়াড় ওঠে।

নদীতে নেমে সে ডালটির কাছে যেতে সেটি সরে যায় মাঝ নদীতে। কারমা ডাঙায় উঠলে সেটি আবার চলে আসে কিনারায়। এভাবে বারবার নদীতে নেমে ডালটিকে ধরতে পারে না। সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও হাল ছাড়ে না।

কারমার চেষ্টা দেখে এক সময় ধরা দেয় ওই ডালটি। সে তখন মহাখুশি। ডালটিকে দুহাতে কাঁধে তুলে নেচে গেয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে। অতঃপর উঠানের মাঝে গেড়ে তার চারপাশে নাচগান করতে থাকে। এরপর থেকে কারমা ভাগ্য ফিরে পায়। সে আগের মতো খেতে পারে এবং তার সংসার ধনসম্পদে পূর্ণ হতে থাকে।

এ ঘটনার পর থেকে পাহান আদিবাসী সমাজে কারমা পূজার প্রচলন ঘটেছে। পূজার আগ থেকে উপোস থাকার আচারের মাধ্যমে পাহানরা মূলত কারমার কষ্টকে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করে। আর খিলকদম গাছের ডালের চারপাশে এরা নাচগান করে অভাবমুক্তির আশা নিয়ে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৮ আগস্ট ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button