মুক্তিযুদ্ধ

পীরগঞ্জের গণকবর

উপজেলাটির নাম পীরগঞ্জ। ঠাকুরগাঁও জেলার এ উপজেলার কেন এমন নামকরণ? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চোখ ফেরাতে হবে মোঘল আমলের দিকে। এ অঞ্চলটি তখন ছিল সরকার তাজপুরের অধীনে। ইসলাম প্রচারের জন্য সে সময় বেশ কয়েকজন বুজুর্গ পীর আউলিয়ার আগমণ ঘটে এ এখানে। তাদের মধ্যে অন্যতম দুর্লভপুর গ্রামের পীর বাহরানা সৈয়দ, গাটিয়া গ্রামের পীর শাহজাহী, ভেলাতৈর গ্রামের পীর দরবার গামী, পীরগঞ্জ সদরের পীর সিরাজউদ্দিন আউলিয়া, পীরগঞ্জ সংলগ্ন গগোর গ্রামের বনপীর। কেউ কেউ মনে করেন অনেক পীরের সমাদৃত অঞ্চল বলেই উপজেলার এমন নামকরণ। আবার অনেকেই উপজেলার নামকরণে পীর সিরাজউদ্দিন আউলিয়ার কথাই বলেন থাকেন। এখানেই তার আস্তানা থাকায় উপজেলার নাম হয়েছে পীরগঞ্জ।

পীর সিরাজউদ্দিন আউলিয়ার মাজারটি সরকারী কলেজে পার্শ্বেই। মাজারের উল্টো দিকে উপজেলা সাব-রেজিস্টার অফিস। অফিস তখনও শুরু হয়নি। পাশেই একটি হোটেল। পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। টুলে বসে আনমনে চা খাচ্ছে এক বৃদ্ধ।
এতসব দৃশ্যের ভিড়ে দৃষ্টি পড়ে সাব রেজিস্টার অফিসের প্রধান ফটকের বাম দিকটাতে। বাঁধানো একটি কবর সেখানে। সাধারণ কবরের মতোই আকার। নীলাভ রঙের চুনে বর্ণিল হয়েছে কবরটি। একপাশে লিখা, ‘ভুলি নাই ভুলব না, ১৯৭১ সনের গণকবর।’
কবরের সামনে ইট শুরকি দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করা হয়েছে একটি ফলক। শহীদদের নামের শুরুতেই ফলকে লিখা, ‘তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা।’

পীরগঞ্জ সাব-রেজিস্টার অফিসের সামনের গণকবর
পীরগঞ্জ সাব-রেজিস্টার অফিসের সামনের গণকবর

আমাদের দেখেই এগিয়ে আসেন ওই বৃদ্ধটি। লোকটির নাম আবুল হোসেন। সাব রেজিস্টার অফিসের পাহারা দেওয়াই তার কাজ। কথা হতেই জানালেন প্রায় এক যুগ আগের কথা। বাবু রনজিৎ কুমার সিংহ নামের এক সাব-রেজিস্টার কর্মরত ছিলেন পীরগঞ্জে। তখন গণকবরটি ছিল প্রায় অবহেলিত ও পরিত্যাক্ত। নিজ উদ্যোগে তিনি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই গণকবরটি সংরক্ষণ ও বাঁধাই করে দেন।

কিন্তু কাদের হত্যা করা হয় এখানে? এমন প্রশ্নে আবুল হোসেন আমাদের নিয়ে যান দলিল লেখক ফজলুর রহমানের কাছে।
ফজলুর রহমানের বয়স সত্তর। বাড়ি জগথা গ্রামে। এই গণকবরে শায়িত আছেন তার বাবা আসম আলী সরকার ও ভাই কাশেম আলী। পারিবারিকভাবে সবাই ছিলেন দলিল লেখক। গণকবর নিয়ে কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘ওইদিন ছিল হাটবার। আমার ভাই কাশেম ও বাবা আসম আলী যান কলেজ হাট খোলায়। হঠাৎ হাট খোলার চারপাশ ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা কোনো আন্দোলন বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তবু অনেকের সঙ্গে তাদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা মাগরিবের নামাজটাও পড়তে দেয়নি বাবাকে। সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের সামনে একটি গর্তের কাছে তাদের লাইন করে দাড় করানো হয়। অতঃপর চলে গুলি। মাজারের খাদেম দূর থেকে সবকিছু দেখছিলেন। কয়েকদিন পরে তিনিই আমাদের খবরটি দেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখানেই হত্যা করা হয় জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের মুন্সি মজিরউদ্দিনের ছেলে আবুল কাশেম, জাবেদ আলীর ছেলে আমিরউদ্দিন, ভিমটিয়া গ্রামের কটকআলীর ছেলে হাফিজউদ্দিন ও মছলন্দপুর গ্রামের ডংগো মোহাম্মদের ছেলে স্কুল শিক্ষক মফিজউদ্দিনকে।’
শহীদ মফিজউদ্দিনের ভাগিনা শরিফুল হুদার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়। তিনি জানান মফিজউদ্দিনের শহীদ হওয়ার ঘটনাটি।
মফিজ উদ্দিন ছিলেন ধহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরিবার নিয়ে থাকতেন মস্তাননগরে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও মুক্তিগামী বাঙালিকে গোপনে নানা পরামর্শ দেওয়াই ছিল কাজ। একবার তিনি  গোপনে চলে যান ভারতে। এক রাতে ভারত থেকে আসেন পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। পরদিন ছিল হাটবার। সকালে উঠেই তিনি যান কলেজ হাটখোলায়। এ খবর পেয়ে হাটখোলা ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি  সেনাবাহিনী। প্রথমে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পাশবিক নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় ওই সাব-রেজিস্টার অফিসের সামনে।

পীরগঞ্জ সাব-রেজিস্টার অফিসের সামনের গণকবরটিতে পাঁচজন শহীদের নাম টাঙানো হলেও প্রকৃতপক্ষে কতজনকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি কোথাও। শহীদদের পরিবারও সঠিকভাবে জানাতে পারেনি গণহত্যার তারিখটি। উপজেলার অন্যান্য গণকবরগুলোর অবস্থা আরো করুণ।
এ প্রসঙ্গে পীরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মোঃ শেকুল ইসলাম বলেন, ‘একচল্লিশ বছরেও চিহিৃত হয়নি পীরগঞ্জের গণকবর ও বধ্যভূমি। অবহেলা আর অযতেœ পরে আছে জায়গাগুলো। সংরক্ষণ করা হয়নি মুক্তিযুদ্ধে পীরগঞ্জে শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাসগুলো।’
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭১ এ পীরগঞ্জের প্রায় ৩ হাজার মানুষকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। নির্যাতন চালিয়ে পরে তাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়। আওয়ামীলীগ নেতা ডা. সুজাউদ্দীন, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, আতাউর রহমান, আব্দুল জব্বার ও মোজাফ্ফর আলীসহ ৭ জন নেতাকেও পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করে পীরগঞ্জ- ঠাকুরগাঁও পাকা সড়কের পাশে। কিন্তু সে জায়গাটিও সংরক্ষণ করা হয়নি অদ্যাবধি।’
গণকবরগুলো সংরক্ষণ ও গণহত্যার ইতিহাসকে তুলে না ধরলে পরবর্তী প্রজম্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারবে না? তাই পীরগঞ্জবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবী-অবিলম্বে সংরক্ষণ করে রক্ষা করা হোক উপজেলার গণকবরগুলোকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকারিপোট২৪.কমে, ২৫ মে ২০১৩

© 2013 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button