কলাম

মুজিবনগর সরকার : স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠায় যাদের ভূমিকা

১৭ এপ্রিল ১৯৭১। মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সূর্য উদিত হয়। কিন্তু তার আগের প্রেক্ষাপটটা আসলে কী? তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

২৫ মার্চের পর থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বাঙালি নিধন ক্রমশ বাড়ছিল। ফলে সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বিপন্ন দেশত্যাগীদের ঢল বাড়তে থাকে।

অন্যদিকে ভারত সীমান্তের সব অংশে আশ্রয় নেওয়া ছাত্র-যুবক ও তরুণেরা অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য উদগ্রীব হতে থাকে। ফলে তা নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর জন্য তখন একটি আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ জরুরি হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশে আওয়ামী লীগ নেতারা অনেকে বৈঠকে বসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কার নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হবে, কারা এর উদ্যোগ নেবেন এসব নিয়ে তর্ক শুরু হয়।

শেষ পর্যন্ত হাল ধরেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, জহুর হোসেন চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ প্রমুখ।

১০ এপ্রিল ১৯৭১। বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রদান করে। যা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৭২-এর সংবিধানও এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। ওইদিন সত্তরের নির্বাচনে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি গোপনস্থানে মিলিত হয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন এবং এই সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন।

তারা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। আরও সিদ্ধান্ত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম হবেন উপরাষ্ট্রপতি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন।

মন্ত্রিসভার সদস্য হন এম মনসুর আলী (অর্থ বাণিজ্য ও শিল্প), এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি), খন্দকার মোশতাক আহমদ (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি ও হত্যাকারী) পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ মন্ত্রী।

জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ও মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। এইচটি ইমাম মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ওইদিনই গভীর রাতে (রাত ১২টার পর, ১১ এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ড করা একটি ভাষণ গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই বেতার ভাষণের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সরকার বিশ্ববাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি ছিল শুধুই ঘোষণা ও আনুষ্ঠানিকতার পর্বটি।

অস্থায়ী সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল ১৯৭১, চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু সেই গোপন সিদ্ধান্তটি সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা প্রবল বোমাবর্ষণ করে ওই স্থানে। আর এতে ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা। এমন তথ্য মেলে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে।

কেমন ছিল ১৭ এপ্রিলের সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি?

মেহেরপুরের ওই জায়গাটির নাম আগে ছিল বৈদ্যনাথতলা। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও হাজারো জনতার সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রবাসী) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ নেন সেখানে। সেই থেকে ইতিহাসের হাত ধরেই বৈদ্যনাথতলা হয়ে যায় মুজিবনগর।

১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব ছিলেন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্য মোমিন, জজ মাস্টার, আইয়ুব ডাক্তার, সৈয়দ মাস্টার, রফিক মাস্টার, রুস্তম উকিল, জামাত মাস্টার, সুশীল কুমার বিশ্বাস প্রমুখ।

মাটির ওপরে তক্তা বিছিয়ে স্টেজ এবং কাপড়, দড়ি, বাঁশ, দেবদারুর পাতা দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠানস্থল। দুটি বাঁশ পুঁতে দেবদারুর পাতায় তৈরি করা হয় গেট। চেয়ার, মাইক আর টেবিল আসে ভারত থেকে।

অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। জাতীয় নেতারা মঞ্চে উঠলে কোরআন তেলাওয়াত আর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। আসাদুল হক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস, আইয়ুব প্রমুখ জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ দেন। কোরআন তেলাওয়াত করেন সতের বছরের কিশোর মো.বাকের আলী।

দলের হুইপ এমএনএ আবদুল মান্নান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। শপথ করান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। শপথের পরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। এরপরই নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।

মাগুরা মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) নেতৃত্বে ১১ জন আনসার সদস্য গার্ড অব অনার প্রদান ও সশস্ত্র সালাম দেন। মূলত এই শপথ অনুষ্ঠানের পরেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীন থাকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেয়। তবে ১০ নং বা নৌ সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না।

মূলত এই অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এই প্রথম সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা এবং অসম স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তাই মুজিবনগর সরকারের নামটিও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা, ওই সরকারের বিচক্ষণতা ও কৌশল সম্পর্কে বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদগণ কতটা জানেন তা নিয়ে সংশয় আছে।

পাশাপাশি ১৯৭২-এর সংবিধান থেকে সরে আসায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা দুরূহ হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে এগিয়ে নিতে এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শে অনুপ্রাণিত মুজিবনগর সরকারের ওই সময়ের সাহসী নেতাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকাপোস্ট টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল; ১৭ এপ্রিল ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button