আদিবাসী

রেংটার খোজে রেংটা পাড়ায়

দিনাজপুরের ভারাডাংগি থেকে ছোট্ট খালটি চলে গেছে সীমান্তের দিকে। শীত মৌসুমে খালটি শুকিয়ে নিচু মাঠ হয়ে যায়। তখন মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে খালের বুকে। কিন্ত ভরা বর্ষায় থাকে খালের ভরা যৌবন। তখন খাল পাড় হতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। প্রতিবার জনপ্রতি এক টাকার বিনিময়ে চলে দুপাড়ের মানুষদের পারাপার। ঘাটের দুপাশে তাই বসে যায় দুএকটা দোকানও।
এই ঘাটটি ভান্ডারা ইউনিয়নের মধ্যে। প্রতিবছর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেব ঢাকঢোল পিটিয়ে ইজারা দেন ঘাটটিকে। ইজারা পেতে কয়েকগ্রামের প্রভাবশালীরা তদবীর করে নানা কায়দায়। ফলে বছর বছর বাড়ে ঘাটের ইজারা মূল্য।
সবার কাছে এটি রেংটা ঘাট। সরকারী নথিতেও নাম একই। ঘাটটির পাশেই রেংটা পাড়া। এটি মূলত আদিবাসী সাঁওতালদের একটি পাড়া। পাড়াটিতে রয়েছে ১৩টির মতো সাঁওতাল পরিবার। গোটা পাড়ার সবাই কোন না কোন ভাবে একে অপরের আত্মীয়।
এই পাড়ার মহতের নাম রেংটা। বয়স ১০৫ বছরের মতো। এই রেংটার নামেই নামকরণ হয়ে যায় পাড়া আর ঘাটটির। বছর বছর রেংটা ঘাটের ইজারা মূল্যও বাড়ে। কিন্ত রেংটা পাড়ার রেংটার ভাগ্যের তেমন ছন্দ পতন ঘটে না।গত বছর বৈশাখের ঠিক আগে গিয়েছিলাম রেংটা পাড়ায়। কন্কাল সার দেহ নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে চলছিলেন রেংটা। বাড়ির খাটিয়ায় বসে দু একটা কথা হয় রেংটার সাথে।
রেংটার বাবার নাম ছিল মায়সা হেমব্রম। বাবার জম্মও হয় এখানেই। কিন্ত রেংটার দাদা লক্ষণ হেমব্রম এসেছিলেন ভারতের দুমকা থেকে। লক্ষণের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এই ভান্ডারায় এসে। সে হিসেবে রেংটারা এখানে বাস করছে শতবছর আগ থেকে। জঙ্গলকেটে এ অঞ্চলকে বসবাসের যোগ্য করে তোলে রেংটারাই। তখন এখানে বাঙালিদের কোন আস্তিত্ব ছিল না। অথচ আজ এই রেংটারাই হয়ে আছে সংখ্যালঘু।
নিজস্ব ভাষা, সংষ্কৃতি আর আচার নিয়ে যুগ যুগ ধরে এদেশে রেংটার মতো আদিবাসীরা বসবাস করলেও আধুনিক সভ্যতার লেবাস পড়ে তাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে চলে নানা খেলা। আদিবাসী নামটিকে আড়ালে রেখে কখনও উপজাতি কখনওবা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নানা নামে নামকরণ করি তাদের। এভাবে নিজের জাতিকে উচুতে রাখার একধরণের হীন চেষ্টা চলে আমাদের মধ্যে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা শুধু নিচুতেই থাকি। রেংটার মতো সাঁওতালদের কাছে এসেও কী আমরা বলব, তারা আদিবাসী নয়?
রেংটার সাথে কথা হয় এটুকুই। সময় নিয়ে রেংটা পড়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ইচ্ছে ছিল কালের ধারক রেংটার কাছ থেকে জানব আদিবাসীদের সংগ্রাম,সংষ্কৃতি আর পরিবর্তনের নানা কাহিনী। কিন্ত ব্যস্ততার টানাপোড়নে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় রেংটা।
এবার শেষ চৈত্রে বের হই আদিবাসীদের পাড়া বেড়াতে। সঙ্গী হয় স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক সুবল। প্রথমেই চলে আসি রেংটা পাড়ায়। সময় নিয়ে কথা হবে রেংটার সাথে। তেমনটাই পরিকল্পনা । কিন্ত রেংটার বাড়িতে ঢুকে দেখি খাটিয়াটি শুন্য। গোটা বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের দেখে পাশের বাড়ি থেকে এগিয়ে আসে বুধু রায় হেমব্রম। রেংটার ভাতিজা সে। রেংটার খোজ করতেই উত্তর পাই তার। বুধুর উত্তরে আমরা স্থির হয়ে যাই। রেংটা মারা গিয়েছে। তাও প্রায় ৯ মাস আগে। আমাদের আফসোস হয়। রেংটার তখনকার তোলা ছবিটি এখন আমাদের কাছে কেবলই স্মৃতি।
রেংটার বাড়ির এক কোনে বসে বুধু রায় হেমব্রমের সাথে চলে আমাদের আলাপচারিতা। বাড়ির পাশেই সিড়ি আকারের সিমেন্ট আর বালির সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে উচু ডিবি। বুধু জানালো এটি তাদের গ্রাম বোঙ্গা। সাঁওতালদের ভাষায় মাঝি থান। সেখানে ঝুলানো হয়েছে ধুপকাঠি। মাটিতে দেয়া হয়েছে সিদুরের ফোটা। বুধু জানালো তাদের পাড়ায় চলছে চৈত বিসুয়া উৎসব। রেংটার আমলে এ উৎসব হতো জমজমাট। উৎসবে অংশগ্রহণ করতো আশপাশের গ্রামের আদিবাসীরা। সময়ের আবর্তে অভাবের কারণে এখন রেংটা পাড়ার উৎসবগুলো চলছে ঢিমেতালে।
রেংটার পরে গোত্রে মহতের হাল ধরেছে রেংটার ছেলে মঙ্গল হেমব্রম। চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের শুরুর দিনের আনুষ্ঠানিকতাকে সাঁওতালরা বলে চৈত বিসুয়া। রীতি অনুসারে মুন্ডা সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বৈশাখের প্রথম দিন দলবেধে শিকারে বের হলেও সাঁওতালরা শিকারে বের হয় শেষ চৈত্রে। সে কারণেই মহত মঙ্গল শিকারে বের হয়েছে তার দল নিয়ে।
পূর্বপুরুষের আমল থেকেই তীরধনুক আদিবাসীদের একমাত্র হাতিয়ার। সাঁওতালদের ভাষায় আ্-পরী। আ্ অর্থ ধনুক আর পরী অর্থ তীর। যার ধনুকের আঘাতে শিকার মিলে আদিবাসীদের নিয়মানুসারে সে পায় এক ভাগ বেশি অংশ।
বুধু জানালো মঙ্গলদের ১০ জনের দলে যদি ২ জনের তীর ধনুক থেকে শিকার আসে। আর যদি শিকার বহনের জন্য কোন ব্যক্তি দায়িত্বে থাকে। শিকারের ভাগ করা হবে ১৩টি। এর মধ্যে শিকারকারী ও বহনকারী পাবে ২ ভাগ করে আর বাকীরা একভাগ করে। এটিই সাঁওতালদের নিয়ম। তবে ভাগ বন্টন নিয়ে কখনও আদিবাসী সমাজে কোন দ্বন্দ সংঘাতের সৃষ্টি হয় না। বরং শিকার থেকে ফিরে এরা গোটা পাড়া দলবেধে আনন্দ করে আর হাড়িয়া খায়।
বুধু জানালো তাদের প্রিয় শিকার কুলাই (খরগোশ), বিজি (বেজি) , কাটাশ, রুন্ডা(বন বিড়াল) প্রভৃতি। খোরগোশের মতো বনের নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করা ঠিক কিনা। জানতে চাইলে। বুধু খানিকটা লজ্জিত হয়। সে জানালো তাদের আদি বিশ্বাসেও জীব হত্যা পাপ। তবে রীতিমতে তাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে শিকার ধরতো বা খেত তারাও তাই করে আসছে। তবে এখন অনেক আদিবাসীই শিকারে যেতে চায় না। নিজের উদাহরণ দিয়ে বুধু জানালো অনেকেই পশুহত্যা কিংবা তাদের রক্তও দেখতে পারে না।
চৈত্রের শেষ দিন শিকার করলেও বৈশাখের প্রথমে এরা পানতা খেয়ে ঠাকুরের কৃপা লাভের আসায় গ্রাম পূজার স্থানে সবাই মিলে ধুপ সিন্দুর দিয়ে ভক্তি করে। সারা বছর ভালো থাকা আর নানা মনোবাসনার নিবেদন করে ঠাকুরের কাছে। অতঃপর দিনভর চলে নাচগান।
বুধু আবার ফিরে আসে রেংটার কথায়। মৃত্যুর সময় রেংটা রেখে যান এক মেয়ে আর সাত ছেলে। মেয়ের বিয়ে হয় পাশের ইউনিয়নে। রেংটার যা জমি ছিল তা ভাগ হয় ছেলেদের মধ্যে।
আদিবাসী সাঁওতালদের পূর্বপুরুষের নিয়ম অনুসারে পরিবারে মেয়েরা বাবার কোন সম্পত্তি পায় না। মেয়েদের বিয়ে পরে যখন স্বামীর বাড়িতে যায় তখনও স্বামীর সম্পত্তির অংশ তারা পায় না। তবে যদি পরিবারে শুধুই মেয়ে থাকে তবে তারা বাবার সম্পত্তির অংশ পায়। বুধু জানালো সম্পত্তি না পেলেও মেয়েরা সব সময় তাদের ভাইদের সহযোগিতা পেয়ে থাকে। বিভিন্ন পূজা পার্বনে উপহারসহ মেলে স্বামীসহ দাওয়াত। বিপদের মুহুর্তেও পাশে পায় ভাইদের। ফলে সম্পত্তি না পেলেও পায় মমতাবোধ, সহযোগিতা আর ভালবাসা। তাই পূর্বপুরুষদের এই নিয়মকে তারা কোন বৈষম্য মনে করে না।
কথায় কথায় আমাদের আসরে আসে গোত্রের গেনে কুসকু। মহাজনদের মাঠ থেকে কাজ সেরে ফিরেছে। গেনে কুসকু জানালো তার দৈনন্দিন কাজের কথা।
সারাদিনই কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আদিবাসী নারীদের। ঘরবাড়ী পরিষ্কার করে, সকলের জন্য রান্না সেড়ে, তুলসী ঠাকুরকে দুবেলা ভক্তি দিয়ে আর স্বামীকে খুশি রেখে আদিবাসী নারীদের রোজগারের জন্যও যেতে হয় বাইরের কাজে। তখন ছোট বাচ্চাকেও তাদের সাথে নিতে হয়। গলার মধ্যে বাচ্চাটিকে বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়েই কাজ করে আদিবাসী মেয়েরা। সততার সাথে কাজ করলেও আদিবাসী ও নারী হওয়ায় গেনে কুসকুকে হরহামেসাই মজুরী বৈষম্যের শিকার হতে হয়। অন্যান্যদের মজুরী একশত টাকার হলে গেনেকে দেয়া হয় আশি টাকা।
রেংটা পাড়ার অভাবী আদিবাসীদের কাছে ধর্ম পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে বার বার। দূর থেকে আসা খ্রীস্টান বিশ্বাসী ফাদারদের পদধুলি পড়েছে কয়েকবার। পূর্বপুরুষদের ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের চিকিৎসা আর ভবিষ্যতে ভালো থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছে তারা। কিন্ত তবুও রেংটা পাড়ার সাঁওতালরা ধর্মান্তরিত হয়নি।
বুধু জানালো পাশের পাড়ায় কয়েকদিন আগে এসেছিল ফাদাররা। গান্ধি মুরমুসহ দুজনকে ধর্মান্তরিত করে তারা। যীশুর বাণী শুনিয়ে, পানি ছিটিয়ে আর গলায় ক্রুস পরিয়ে খ্রীস্টান করা হয় তাদের। বিনা পয়সায় ছেলেমেয়ের পড়াশুনা আর চিকিৎসা মিললেও ঐ পাড়ার আদিবাসীদের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং বোঙ্গা আর আদিবাসীদের পূজা পার্বনের সময় এক ধরণের কষ্টে থাকে তারা। পূর্বপুরুষদের আচার আর সংষ্কতি তাদের কাছে আজ শুধুই কুসংস্কার। আর কুসংষ্কার ভেবে এভাবেই ধর্মান্তরিত আদিবাসীরা হারিয়ে ফেলছে তাদের রক্তে মেশা সংষ্কৃতিগুলো।
বিকেলের দিকে দল নিয়ে শিকার থেকে ফিরে রেংটার ছেলে মঙ্গল। শিকার ভাগ করে আমাদের সাথে বসে সে। ঘরে ঘরে তখন রান্নার তোরজোর। দুএকজন ক্লান্তি মিটাতে মাটির হাড়ি থেকে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে হাড়িয়াতে। টুং টাং করে বাজছে মাদল আর ঢোলগুলো। মঙ্গল জানালো খ্রীস্টান না হয়েও তারা এখন তাদের ছেলে মেয়েদের সরকারী স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সচেতনতা আর আর্থিক উন্নতি লাভের জন্য নিজের জাত ধর্ম বিক্রি করতে নারাজ তিনি। তার বাবা রেংটার সাঁওতালী সংষ্কৃতিকে তিনি টিকিয়ে রাখবেন এটাই মহত হিসেবে তারা আশা।
সন্ধ্যা হতেই চৈত বিসুয়া উৎসব জমে ওঠে। রেংটা পাড়ায় শুরু হয় সাঁওতালদের নাচ। অভাব, অনটন আর নানা বৈষম্য বুকে নিয়েই নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে রেংটা পাড়ার আদিবাসীরা।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে মে ১২, ২০১১, সাপ্তাহিকে http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=5270

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button